ভালোবাসা ও সহমর্মিতা শব্দগুলো কি হারিয়ে যাবে?
সহমর্মিতা |
সম্প্রতি দেশের সর্বচ্চ বিদ্যাপীঠসহ
বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু নিষ্ঠুর, অমানবিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যেসব ঘটনাগুলো
বিবেকবান মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে, কাঁদিয়েছে। যে কোন হত্যাকাণ্ডই অপরাধ ও পাপ।
আগে জানতাম, যারা অসামাজিক, যারা চোর-ডাকাত, ছিনতাইকারী, মাদকাসক্ত তারাই অপরাধ করে,
তারা নির্দয়-নিষ্ঠুর, মানুষ হত্যা করতে তাদের হাত কাঁপে না। কিন্তু যখন দেশের সর্বচ্চ
বিদ্যাপীঠে লেখাপড়া করা ছাত্ররা জীবন্ত মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলে সেটা কিসের ইঙ্গিত
দেয়? সাধারন মানুষ হিসেবে মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে আমরা কি হিংস্র জাতিতে পরিনত হচ্ছি?
আমাদের বিবেকবোধ লোপ পাচ্ছে? সমাজ থেকে কি ভালোবাসা ও সহমর্মিতা শব্দগুলো হারিয়ে যেতে
বসেছে?
মানব সমাজের প্রাচীন ও ক্ষুদ্রতম সংঘ হলো পরিবার। পরিবার শিশুদের প্রথম ও প্রাথমিক শিক্ষালয়। একজন শিশু তার পরিবার থেকে শিখে সহমর্মিতা-সহভাগিতা, আদব-কায়দা, শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধসহ মানব জীবনের মৌলিক আদর্শগুলো। যা শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করে। কিন্তু পরিবার যদি কোমলমতি শিশুদের ভেতরে পারিবারিক মৌলিক আদর্শের বীচ বপন করতে না পারে তবে শিশুর নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে না। সেই শিশু হয়ে উঠে সমাজের বোঝা।
এরপর বিদ্যালয়ে শুরু হয় শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন। যেখানে শিশুর মেধা, মানবিক ও সামাজিক গুণাবলীসহ ব্যক্তিসত্তার সুষম বিকাশ ঘটে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শিশুদের সামাজিক করে তোলে। বিদ্যালয়ে শিশু শিখে কিভাবে সমাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে হয়। কারণ যখন কোন শিশু সমাজের সাথে সম্পৃক্ত বা অভিযোজন করতে না পারে তখন শিশু অসামাজিক কার্যকলাপের সাথে জড়িয়ে পরে। তখন নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটে, সমাজে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা, অরাজগতা। অন্যদিকে সুশিক্ষা ও আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিতরাই একটি সমাজকে সফল ও আদর্শ করে গড়ে তুলে।
এখন প্রশ্ন আসে, একটা পরিবার থেকে বেড়ে উঠা দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়ন করে কেন ছাত্ররা এমন নিষ্ঠুর, নির্দয় ও হিংস্র হয়ে উঠল? কেন জীবন্ত মানুষ পিটিয়ে মেরে তারা পৈশাচিক আনন্দ পায়? কেন তাদের মধ্যে অপরাধবোধ জাগে না? কেন মানুষের প্রতি তাদের মমত্ববধের উদয় হয় না।
এ তো গেল মোটা দাগের অপরাধের কথা! আমরা যারা লাঠি দিয়ে জীবন্ত মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলি না তারাও কিন্তু ধোয়া তুলশি পাতা নই। প্রতি নিয়ত আমরাও হিংস্র অমানবিক হয়ে উঠছি। ছোটখাটো অপরাধ করে আমাদের মনেও অনেক সময় অপরাধবোধ জাগে না। প্রতিবেশির বিপদ-আপদ দেখলে আমরাও মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করি। অন্যকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে দেখলেও আমরা না দেখার ভান করে থাকি। সুযোগ পেলে আমরাও যে দুই একটা চড় থাপ্পর দিতে পিছপা হই না এমন অনেক উদাহরণ সমাজে আছে। এছাড়া ছোটদের স্নেহ, বড়দের সম্মান, পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব কর্তব্যের বিষয়গুলোর প্রতি আমরা অনেকেই উদাসীন।
সন্তান হচ্ছে ঈশ্বরের কাছে থেকে পাওয়া বাবা-মায়ের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি। পৃথিবীতে বাবা-মায়ের সবচেয়ে আনন্দের কারণ হচ্ছে সন্তানের সাফল্য আবার পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে বড়ো ব্যর্থতার অন্যতম হলো সন্তানদের মানুষ করতে না পারা। বার্ধক্যে উপনীত হবার পরে সন্তানের কাছে পরাজয় মানুষের সবচেয়ে কষ্টের। কোন বাবা-মাই চান না তার সন্তান বিপথগামী হোক, অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ুক কিংবা খুনি নামের তকমা অর্জন করুক। বাবা-মা হিসেবে তারা তাদের সর্বচ্চ দিয়েই সন্তান মানুষ করতে চেষ্টা করেন। সন্তানকে সেরা মজাদার খাবারটা খাইয়ে, স্বনামধন্য স্কুলে লেখাপড়া করিয়ে, নিজেদের অনেক চাওয়া-সাধ-স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে সন্তানের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে নিঃশেষ হয়ে যান।
তাই সন্তানের পেছনে পিতামাতার
সর্বোচ্চ
বিনিয়োগটা শুধুমাত্র অর্থের না হয়ে হোক
ভালবাসার, ধর্মের, প্রজ্ঞার, নৈতিকতা আর বিবেক বোধের। লেখাপড়ার পাশাপাশি আমাদের
সন্তানরা মেধায়-মননে
হয়ে উঠুক অনন্য। আমাদের পরিবার আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে উঠুক
সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারখানা।
No comments