লোনলিনেস-একাকীত্বতা
ডাঃ সারা মুরমু মিতু
একাকীত্বতা |
পরিচিত অনেকে ঘন্টার পর ঘন্টা, এমন কি রাত অবধি অনলাইনে থাকে। তারা যে খুব ব্যস্ত, অথবা কোন মিনিংফুল কাজে সময় ব্যয় করছে, এমন নয়। কারো লেখা, মন্তব্য চোখ বুলাচ্ছে, লাইক, শেয়ার ,
ইউটিউবে গান, ছবি, কারো আপলোড দেখছে। সময় পেরিয়ে যায়, খেয়াল থাকেনা। পাশেই তার প্রিয়তমা স্ত্রী, ছেলে মেয়ে , গভীর ঘুমে অচেতন। কাছের মানুষ পরিবেষ্টিত অবস্থাতেও সে একা, নিঃসঙ্গ। পরিবারের সবার হাতে স্মার্ট বা আইফোন। পছন্দমাফিক প্রোগ্রামে আঙুল চালায়। পাশে থাকা মানুষের সাথে কথা নেই, শেয়ারিং অথবা ইন্টার্যাকশন নেই। একজন গান শুনে, অন্যজন ছবি দেখে, কেউ ইউটিউবে ভ্রমন কাহিনী বা রান্নার রেসিপি শেখে। বড়জন অফিসের মেইল চেক করে, রেসপন্স করে, ফিডব্যাক দেয়। কি আশ্চর্য রকমের একাকীত্বতা, পাশে থেকেও কেউ কারো নয়।
অফিসের সাবেক সিনিয়ার ম্যানেজমেন্ট টীমের একজিকিউটিভ, প্রতিদিন কাজে-অকাজে অনেক স্টাফ, পার্টনারদের লীডার, প্রজেক্ট-প্রোগ্রামের কর্মী, অনুদান-চাকরী প্রার্থীর ভীড়। কর্মজীবন শেষ, কেউ তার কাছে আসেনা, আসবার প্রয়োজন বোধ করেনা। চাকরী শেষ, একাকীত্ব শুরু। সন্তানরা প্রযুক্তিগত-পেশাগত শিক্ষায় ডিগ্রীধারী। ডিগ্রী নিয়ে কেউ গ্রামে থাকেনা। কেউ শহরে, কেউ বিদেশে। আলীশান বাড়ী কিন্ত বাড়ীতে ষাটোর্ধ স্বামী-স্ত্রী। আগে গ্রামের অনেকেই আসতো গল্প করতে, এখন আসেনা। সবার ছেলেমেয়ে রোজগার করে টাকা পাঠায়। ডিনারের পর স্ত্রী টেলিভিশনে সিরিয়াল দেখে, খবর শুনে, সিনেমা দেখে। স্বামীর করার কিছু নেই-স্মার্ট বা আইফোন তেমন চালাতে পারেনা। ঘরের ল্যাপ্টপে ময়লা জমে আছে। প্রতিদিন অপেক্ষা করে কখন ছেলেমেয়েরা কল দেবে। কল আসেনা।
একাকীত্বের সাথে মিতালী।
বাবা ব্যবসায়ী, হরহামেশ বিদেশে যায়, আসে। মা সমাজ কর্মী, আজ এখানে, কাল সেখানে। সামাজিক,
ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক আগডুম-বাগডুম নিয়ে ব্যস্ত। ঘরে ছেলেমেয়ে যার যার রুমে। একাকীত্ব-
সিগারেট এবং বোতল তাদের বসম ফ্রেইন্ড।
স্ত্রী মারা গেছে। সন্তানরা নিজ নিজ সংসার-ছেলেমেয়ে নিয়ে মহাসুখে। বাবার জন্য আর সময় নেই। তারা চাকরীর সুবাদে অন্যখানে, বিদেশে। কাজের ছেলে আব্দুল আর আসেনা, বিদেশ যাওয়ার বেসিক প্রশিক্ষনে ব্যস্ত। হোম মেকার সখিনা আর আসেনা, তারা স্বামী পক্ষাঘাতগ্রস্ত। দু'ছেলে টাকা পাঠায়, আর কাজ করতে হয়না। একাকীত্বের বাস্তবতা। কবে এর থেকে পরিত্রাণ পাবে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় এ
অবস্থায় চেয়ে আগে বিদায় অনেক শ্রেয় ছিল।
সুমন একজন ধর্মগুরু। মরাল, এথিক্যাল, স্পিরিচুয়াল শিক্ষা দিতে দিতে জীবন নাটকের শেষ এপিসোড। অবসর এবং অফুরন্ত সময়। সে লক্ষ্য করছে, তার কাছে আসা লোকজনে সংখ্যা তলানীতে।
যারা তার তর্জনীতে চুম্বন দিয়ে আশীর্বাদ নিতো, তাদের কোন হদিস নেই। কি আর করা, কোন সেমিনারী
অথবা ধর্মগুরুদের জন্য নির্মিত অল্ড এজ হোমে থাকতে হবে। লোনলিনেস অভারহোয়েলমস।
সদ্য অবসরে যাওয়া এক সরকারী কর্মকর্তা। প্রাতঃভ্রমনে পার্কে প্রথম দিন। নতুন নাকি ? হ্যা বলা মাত্রই
ফুল আর পানি বিক্রি করা টোকাই বলছে, দাবা খেলায় রাজা-মন্ত্রী-প্রজা ঘোড়া ক্ষমতার লড়াই, খেলা শেষে সব গুটি এক বাক্সে । রিটায়ার্ড ক্লাবে স্বাগতম! । ডায়াবেটিক্স আছে? হ্যা বলাতে মুচকি হেসে বলে, জীবনে অনেক ঘুষ...... । হাটাহাটি, ডাবের পানি এবং প্রেসার মেপে বাসায়। অবসরের একদিন আগেও নিজেকে অন্য রকম ভাবতো। বাসায় কাজের মানুষ নেই, স্ত্রী অসুস্থ। অফিসে ডানে বামে সামনে পেছনে তাকালেই মানুষ। আজ যেদিকে তাকায়, শুধু শূন্যতা, একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা। বারান্দায় একাকী দাঁড়িয়ে, পাশের ফ্লাট থেকে ভেসে আসছে গান, "মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে, আমি আর বাইতে পারলামনা।"
এ ধরনের আরও লেখা পড়তে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন
No comments