Header Ads

এয়ারপোর্টে হয়রানি

 

এয়ারপোর্ট অভিজ্ঞতা 

 

সম্প্রতি জুনায়েদ নামের এক শিশু ভাইরাল হয়েছে বিনা পাসপোর্ট-টিকিটে কুয়েতের একটি বিমানে উঠে। শিশুটি যে দারুণ বুদ্ধি সম্পন্ন তা মানতেই হবে। এয়ারপোর্ট-এর এতগুলো নিরাপত্তা তল্লাশির ধাপ এড়িয়ে কিভাবে শিশুটি প্লেনে উঠলো সেটা বিস্ময়ের ব্যাপার। আমার মনে হয় বাংলাদেশে বৈধ উপায়ের চেয়ে অবৈধ উপায়ে যে কোন কাজ করা সহজ।

বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে আমার কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করি-

আমি ২০০৪ সালে প্রথম যখন দেশের বাইরে যাই আমাকে হয়রানীর শিকার হতে হয়েছিল। মালয়েশিয়ার ফ্লাইটে করে আমি যাচ্ছিলাম ফিলিপাইনে। ফ্লাইট রাত ১১ টায়। চেকিং দিয়ে বোর্ডিংপাস নিয়ে ইমিগ্রেশনে যাওয়ার আগে আমাকে আটকানো হল। বয়স কম, প্রথম বিদেশযাত্রা, জীবনের প্রথম চাকরি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কষ্ট সব মিলিয়ে খুব ভয়ে-আতঙ্কে ছিলাম। ইমিগ্রেশনের উদ্দেশে লাইনে দাঁড়ালে একজন এসে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছেন?  

বললাম, ফিলিপাইনে।

কেন যাচ্ছেন?

আমি রেডিও ভেরিতাস এশিয়া থেকে পাঠানো আমার নিয়োগপত্র দেখালাম। তখন আর চারজন লোক আমাকে ধরে বসলেন। বুঝলাম, রেডিও ভেরিতাস এশিয়া সম্পর্কে তারা জানেন না। আমি তাদের বিষয়টি বুঝালাম।

এবার তাদের প্রশ্ন, আমি একা যাচ্ছি কেন?

আমি একাই জবটা পেয়েছি।

একজন বললেন, আপনি উঠতি একজন মেয়ে ফিলিপাইনের মতো একটি দেশে একা যাচ্ছেন বিষয়টি সন্দেহের।

এবার পাঁচজন লোক আমার ইন্টারভিউ নিতে শুরু করলেন। আমার বাড়ি, থানা, জেলা কোথায়, বাবা-মায়ের নাম, ভাইবোন কয়জন, আমি কোথায় লেখাপড়া করেছি, কিভাবে রেডিও ভেরিতাসের সাথে যুক্ত হলাম নানান প্রশ্ন।

এরপর দুইজন লোক উধাও হয়ে গেলেন। বাকি তিনজন আমার পাসপোর্ট, নিয়োগপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলেন। ২০ মিনিট পর চলে যাওয়া দুইজন আরও একজনকে সংগে করে নিয়ে এলেন। তিনি এসে আমার পাসপোর্ট উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখলেন, নিয়োগপত্র যাচাই করলেন। তিনিও বেশ কিছু অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করলেন। প্রায় এক ঘণ্টা পর আমাকে ছেড়ে দেওয়া হল।

জীবনের প্রথম প্লেনে করে দেশের বাইরে যাওয়া এবং হয়রানীর শিকার হওয়ায় আমি কতটা ভীত ছিলাম বুঝতেই পারছেন।

 

এয়ারপোর্ট অভিজ্ঞতা 

এরপর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে, আমার বিয়ের পর স্বামীর সাথে যাচ্ছিলাম শ্রীলঙ্কা। আবারো আমাকে আটকানো হল।

এবারও ইমিগ্রেশনে যাওয়ার আগে দুইজন ধরলেন। কোথায় যাচ্ছেন?

শ্রীলঙ্কা।

কেন যাচ্ছেন?

এরই মধ্যে আমার কয়েকবার এয়ারপোর্ট ব্যাবহার করা হয়েছে। আগের চেয়ে অনেক কিছু স্মার্টলি বলতে পারি আর সাথে আমার স্বামী থাকায় ভয় না পেয়ে বললাম, আমার স্বামীর বাড়ি যাচ্ছি।  

মানে?

আমি আমার স্বামীকে দেখিয়ে বললাম, উনি আমার স্বামী। আমরা গত ডিসেম্বরে বিয়ে করেছি। এখন যাচ্ছি তার বাড়িতে।

উনি যে আপনার স্বামী, তাকে যে বিয়ে করেছেন তার প্রমান কি?

এয়ারপোর্ট-এ এমন ঝামেলা হতে পারে ভেবেই আমরা গির্জায় বিয়ের পরও কোর্টে বিয়ে করেছিলাম। আমাদের কাছে বিয়ের ধর্মীয় সার্টিফিকেট ও কোর্ট ম্যারেজের সব কাগজ পত্র ছিল। সেসব দেখালাম। তারা সব দেখে মিলিয়ে নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলেন,

বিদেশি ছেলে বিয়ে করেছেন কেন?

বললাম, একসাথে জব করার সময় দুজন প্রেমে পড়ে গেলাম। তাই বিয়ে করেছি।

এক অফিসার প্রশ্ন করলেন, দেশে কি ছেলে ছিল না।

বললাম, ছিল তবে বিদেশিদের বিয়ে করা যাবে না এমন তো কোন আইন আমাদের দেশে নেই।

এবার অফিসার আর কোন কথা বললেন না। আমার স্বামীর দিকে হাত বাড়িয়ে সেক করে বললেন, আপনি আমাদের দেশের জামাই। শ্রীলঙ্কা চায়ের জন্য বিখ্যাত। এরপর যখন আসবেন আমাদের জন্য চা নিয়ে আসবেন।

সেবারও আমাদের আধাঘণ্টা জেরা করা হয়েছিল।

২০১৫ সালের বড়দিনে দেশে এসেছিলাম। শ্রীলঙ্কায় মিঠা পানির মাছ পাওয়া যায় না। সব সামুদ্রিক মাছ। তাই শ্রীলঙ্কা ফিরে যাওয়ার আগেরদিন দাদা পুকুরে জাল ফেলল। অনেক মাছ উঠেছিল। মা অনেকগুলো মাছ কেটে- ধুয়ে, ভেঁজে একটা বৈয়ামে ভরে দিল। বৈয়ামটি একটা মোটা প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে হ্যান্ড লাগেজে নিয়েছিলাম। ফ্লাইটে উঠার আগে যেখানে শেষ বোর্ডিং পাস চেক করে সেখানে অযথাই আমার লাগেজ খোলা হল।

বৈয়াম দেখে একজন মহিলা বললেন, এর ভেতর কি? এটা নেয়া যাবে না।

বললাম, রান্না করা খাবার।

নেয়া যাবে না। নিচে রেখে যান।

বললাম, মা রান্না করে দিয়েছে। শ্রীলঙ্কা পাওয়া যায় না তাই।

মহিলাটি আমাকে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, বাংলাদেশি টাকা আছে?

বললাম, অল্প কিছু আছে।

কত আছে?

ব্যাগ খুলে বললাম ২০ টাকা। মহিলা আমার দিকে রাগান্বিত হয়ে তাকিয়ে বললেন, এসব নেয়া যাবে না। আপনি যান।

আমার মাথায় কি বুদ্ধি এল জানি না। আমি বললাম, ঠিক আছে রেখে দেন আপনি। এর ভেতর শুকরের মাংস আছে বলেই আমি সোজা হাঁটা দিলাম।

মহিলা নাক ধরে জোরে জোরে বলতে লাগলেন, নিয়ে যান, নিয়ে যান এখান থেকে এইটা।

আমি কোন কথা না বলে বৈয়াম হাতে নিয়ে চলে গেলাম।

 এই যে আমাদের বৈধ কাগজ পত্র থাকা সত্ত্বেও হয়রানি করা হয়, এই হয়রানি করার অর্থ হচ্ছে ভয়ভীতি দেখিয়ে কিছু টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়া। আমার মতো একজন মেয়ে ফিলিপাইনে যাবে সেটা তদন্ত করতে যদি পাঁচজন অফিসারের দরকার পড়ে তবে তাদের কাজের ধরন সম্পর্কে একটা ধারনা হয়েই যায়। ওই পাঁচজনের দায়িত্ব নিশ্চয় তদন্ত করা না। আশেপাশের অফিসাররা তাদের কাজ রেখে এসেছেন সার্কাস দেখতে।

আর এভাবে সার্কাস দেখতে গিয়েই হয়তো জুনায়েতের অবৈধ প্রবেশ কর্মকর্তাদের চোখে পড়েনি। কারণ তারা নিজেদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের চেয়ে উদগ্রীব থাকেন কোন যাত্রীর ভুল ধরা যাবে, কোন যাত্রীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে, জিম্মি করে কিছু অবৈধ আয় করা যাবে।

বিদেশে ইমিগ্রেশনে গেলে অফিসাররা প্রথমেই একটা হাসি দেন। তাদের হাসি দেখলে পরিবেশ সহজ হয়ে যায়। কোন সমস্যা থাকলে তারা হাসিমুখে বুঝিয়ে দেন। আর আমাদের দেশের অফিসাররা মুখটা এমন রাগান্বিত করে রাখেন যে দেখলেই ভয় করে। এই বুঝি কি একটা ভুল ধরা পড়ে। আমাদের অফিসাররা সহযোগিতা করার চেয়ে সমস্যা তৈরি করতে আগ্রহী।  

আজ এই পর্যন্তই। এয়ারপোর্ট নিয়ে আমার আরও অনেক অভিজ্ঞতা আছে। সেসব অন্য এক সময় সহভাগিতা করব।   

 

আরও পড়তে ক্লিক করুন 

যেভাবে আমি প্রবাসী হলাম 

যেভাবে আমি প্রবাসী হলাম-২ 

যেভাবে আমি প্রবাসী হলাম-৩ 

No comments

Theme images by Deejpilot. Powered by Blogger.