Header Ads

পরিচয় না হলেই ভাল হত

 

পরিচয় 


 

আমি সব সময় সব কিছুতেই মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত। আমার অভিযোগ খুব কম তবে সমস্যা হল মেয়েকে নিয়ে।

শ্রীলঙ্কায় তখন অর্থনৈতিক অবস্থা চরম পর্যায়ে। কারেন্ট নেই, গ্যাস নেই, জ্বালানী তেল নেই, পেট্রোল নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আবার টাকা আছে জিনিস নেই। এই অবস্থায় স্কুল কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হল। অনেকেই বলেছিল দেশে ফিরে যেতে কিন্তু শত কষ্টের মধ্যেও থেকে গেছি। সেসব সঙ্কটের কথা আর একদিন বলা যাবে। আজ বলব আরেক কাহিনী।

একটা পর্যায়ে এসে স্কুল খুলে দেয়া হল। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব তখন দেড় কিলোমিটার। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আগে স্কুলে যেতে সিএনজি ভাড়া গুণতে হতো মাত্র ৬০ টাকা। আসা-যাওয়ায় মোট ১২০ টাকা। আমাদের মাস হিসেবে ভাড়া করা একটা সিএনজি ছিল। মাসে ২০ দিন স্কুল সেই হিসেবে মাস শেষে তাকে ২৫০০ টাকা দেয়া হত। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় সিএনজি ওয়ালা সিএনজি বিক্রি করে সবজি ব্যাবসায় নেমেছেন। তো আমাদের স্কুলে যাতায়াতে দুর্ভোগ শুরু হল।

এখন স্কুলে যেতে লাগে ২৫০ টাকা এবং ফিরতে লাগে আরও ২৫০ টাকা। এছাড়া মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আমাকে ফিরে আসতে হয় আবার আনতে যেতে হয়। এতএব দৈনিক খরচ এক হাজার টাকা। মাসে ২০ হাজার।

আমাদের বাড়ি থেকে গ্রামের ভেতর দিয়ে শর্টকাট একটা রাস্তা নাকি আছে। অনেকেই সেই রাস্তা দিয়ে যায়। ভেতর দিয়ে গেলে রাস্তার দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার।

মেয়ের সাথে ডিল হল আমরা হেঁটে স্কুলে যাব আর ফিরব সিএনজি করে। মেয়ে রাজি হল। প্রথম দিন গেলাম। রাস্তা বেশ সুন্দর, প্রশস্ত এবং কিছুদুর গেলে একটা ছোটখাটো বিলও পরে। বিলের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। একদম গ্রাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে রাস্তার এক জায়গায় একটা বাড়িতে গরু পালে, সেই বাড়ির কাছে এলে গোবর আর চনার দুর্গন্ধ বের হয়। আমরা সেই গরুওয়ালা বাড়ির কাছে এলেই মাস্ক পরা অবস্থাতেই নাক ধরে পাড় হই। মৈত্রী ওই রাস্তাটুকু দৌড়ে পাড় হয় আর আমি যত জোরে হাঁটা যায় সেই হাঁটা দেই। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে গরু ওয়ালা বাড়িতে একটা বছর খানেকের শিশু আছে। বাড়ির সবাই মিলে শিশুটিকে রাস্তায় ওই দুর্গন্ধের মধ্যে দাঁড়িয়ে খাবার খাওয়ায়। শিশুটির বাবা, মা ও নানি গরু দেখায়, আর রাস্তার মানুষ দেখিয়ে দেখিয়ে শিশুটিকে খাওয়ায়। এইটি দেখে আমার আর আমার মেয়ের বিস্ময়ের সীমা নেই। এই দুর্গন্ধের মধ্যের খাবার খাওয়া কিভাবে সম্ভব। যাই হোক, এভাবেই চলছিল আমাদের যাতায়াত। সকাল ৭টায় স্কুলে যাই হেঁটে, দুপুর দেড়টায় সিএনজিতে করে বাড়ি ফিরি।

একদিন গির্জায় গিয়ে দেখি গরু পালিত বাড়ির মানুষ আমাদের পাশে বসেছে। গির্জা শেষ হলে আমার স্বামী সেই পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। শিশুটির মা আমার স্বামীর ছাত্রী ছিল। মেয়েটি আমার স্বামীর আর আমার পায়ে ধরে সালাম করল। আমিও সৌজন্যসুলভ ছোট শিশুটির দিকে হাত বাড়াতেই শিশুটি আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বেশ কিছুক্ষন কথা হল মেয়েটির মা, স্বামী ও মেয়েটির সঙ্গে। মেয়েটি এটিও জানালো যে প্রতিদিন সকালে আমাদের স্কুলে যাওয়ার সময় তারা আমাদের দেখতে পায়।

 

এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। পরের দিন স্কুলে যাওয়ার সময় দেখি তারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। যে রাস্তাটুকু আমার মেয়ে দৌড়ে পালায় আর আমি বড়বড় পা ফেলে হাঁটি সেখানে তারা দাঁড়িয়ে ছোট শিশুটিকে দেখাচ্ছে আর বলছে, ওই তো দেখ অ্যান্টিরা আসছে, দিদি আসছে, দিদিকে ফ্ল্যাইং কিস দাও। অ্যান্টিকে একটা দাও।

 

এই পরিস্থিতিতে দৌড়ানো বা বড়বড় পা ফেলে পালানো সম্ভব না। মনুষ্যত্বের খাতিরেই হোক আর আত্মীয়তার খাতিরেই হোক একটু দাঁড়াতে হয়, কথা বলতে হয়। কিন্তু আমরা তো গরু-গোবর আর গন্ধের সাথে থেকে অভ্যস্ত না। আমার মেয়ে অক অক করতে করতে দৌড়ে চলে গেল। আমি বেচারা না পারি কথা বলতে না পারি নিঃশ্বাস নিতে। প্রাণ যায় যায় অবস্থা।

 

আমরা হাটি আর শিশুটির মা বলে, ওই তো দিদি স্কুলে যায়, তুমি যাবে? দিদিকে বাই বল। বল টাটা টাটা। আমি আর পেছন ফিরে তাকাই না। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

 

পরেরদিন মেয়ের আবদার মা আমি হেঁটে যাব না। সকালে ওরা রাস্তায় থাকবে আর ওদের সাথে কথা বলতে হবে। চল মা আমরা স্কুলে যাওয়ার সময় সিএনজিতে যাই ফিরে আসার সময় হেঁটে ফিরব।

মেয়ের কথায় আমি রাজি হলাম। যাক সমাধান হল, ভর দুপুরে নিশ্চয় শিশুটির পরিবার রাস্তায় থাকবে না। আমরা সকালে সিএনজিতে গেলাম। ফেরার সময় হেঁটে রওনা দিয়েছি।

সেকি? দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি পুরো পরিবার সেই রাস্তায়। তারা শিশুটিকে দুপুরের খাবার খাওয়াচ্ছে!

আমার মেয়ে পেছন ফিরে এক দৌড়। বলছে, মা আমি হেঁটে যাব না। আমি এমনেই ক্লান্ত। এখন আমি ওই দুর্গন্ধের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাই বাই, টাটা বলতে পারব না।  

অগত্যা আমাদের সিএনজিতে করেই বাড়ি ফিরতে হল। শুধু তাই নয়, এর পর থেকে আসা-যাওয়া দুইবারই মেয়েকে সিএনজিতে করে নিয়ে যেতে হয়। আর আমি সিএনজিতে করে স্কুলে দিয়ে পায়ে হেঁটে ফিরে আসি আবার পায়ে হেঁটে স্কুলে গিয়ে সিএনজিতে করে বাড়ি নিয়ে আসি।

আমাকে প্রতিবারই গন্ধের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দম বন্ধ করে হাসি হাসি মুখে বলতে হয়, বাবু বাই বাই, টাটা, টাটা।

আর মনে মনে বলি, এই পরিবারটির সাথে পরিচয় না হলেই বোধ হয় ভাল হত।


আরও পড়তে ক্লিক করুন 

যেভাবে আমি প্রবাসী হলাম 

যেভাবে আমি প্রবাসী হলাম- ২ 

যেভাবে আমি প্রবাসী হলাম- ৩ 

No comments

Theme images by Deejpilot. Powered by Blogger.