যেভাবে আমি প্রবাসী হলাম
প্রবাসী আমি |
দিনটি ছিল ২০০৪ সালের ১২ই এপ্রিল।
জীবনের প্রথম দেশের বাইরে যাত্রা তা-ও আবার কর্মসূত্রে। এর আগে দেশের কোথাও আমার চাকরি
করার সুযোগ বা অভিজ্ঞতা হয় নি। আমার জীবনের প্রথম পেশাটিই ছিল আমার জীবনের টার্নিং
পয়েন্ট।
সেদিন ইস্টার সানডে ছিল। সকালে
গির্জার অনুষ্ঠানের পর আমাকে বিশেষভাবে বিদায় জানানো হয়। এর কারণ হচ্ছে আমি দক্ষিণ
এশিয়ায় অবস্থিত খ্রিষ্টানদের একমাত্র শর্ট-ওয়েভ রেডিও ষ্টেশন ‘রেডিও ভেরিতাস এশিয়া’র
বাংলা বিভাগে প্রযোজক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছি। এমন একটি সংস্থায় এমন একটি পদে কাজের সুযোগ
পাওয়া শুধুমাত্র আমার কিংবা আমার পরিবারের জন্যই গর্বের বিষয় ছিল না, ছিল আমাদের পুরো
গ্রামবাসীর জন্য গর্বের ও আনন্দের।
পরিচিত সবার কাছ থেকে বিদায়
নিয়ে দুপুরের খাবার পর ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। রেডিও ভেরিতাস এশিয়া বা আর ভি এ-র স্থানীয় দুইটি
কেন্দ্র রয়েছে। একটি ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে, যার নাম বাণীদীপ্তি এবং অন্যটি কোলকাতায়
যেটির নাম চিত্রবাণী। বাণীদীপ্তির এই কেন্দ্র
থেকেই আমার ইন্টারভিউ হয়েছিল। ইন্টারভিউতে সিলেক্ট হওয়ার পর এখান থেকেই আমি রেডিও সাংবাদিকতা,
রেডিও অনুষ্ঠান প্রযোজনা, পরিচালনা এবং কণ্ঠ অনুশীলনের উপর ৬ মাসের ট্রেনিং নিয়েছি।
বাণীদীপ্তির অফিস থেকে বিদায়
নিয়ে এবং রেডিও শ্রোতাদের পাঠানো এক বস্তা চিঠি নিয়ে রাজাবাজার বাসায় ফিরি। বাসায় ফিরে
স্নান করে খেয়ে ঠিক রাত আটটায় এয়ারপোর্ট-এর উদ্দেশে রওনা হলাম। প্লেনের সময় রাত ১২
টা। মনে কেমন যেন অজানা এক ভয় আর উত্তেজনা কাজ করছিল। একা একা ফিলিপাইন যাব! পারবো
তো! মাঝে আবার মালয়েশিয়া ছয় ঘণ্টা ট্রানজিট।
সব কিছু কিভাবে করব নানা চিন্তা ছিল মাথায়। আবার ভাবলাম, আমি তো বি এ পাস। আমার চেয়ে
কত কম শিক্ষিত, লেখাপড়া না জানা কত মেয়েই তো মধ্যপ্রাচ্যসহ কত দেশে যাচ্ছে, চাকরি করছে।
ওরা পারলে আমিও পারব।
প্রথমেই বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনে
পড়লাম ঝামেলায়। আমি একা মেয়ে মানুষ কেন ফিলিপাইন যাব? আমার সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার
থাকা সত্ত্বেও নানান প্রশ্নে এয়ারপোর্টের অফিসাররা
আমাকে নাজেহাল করতে লাগলেন। প্রায় আধা ঘণ্টা এ প্রশ্ন সে প্রশ্ন করে শেষে যাবার অনুমতি
মিলল।
প্লেন ছেড়ে গেল মালয়েশিয়ার
উদ্দেশে। আর তখনই শুরু হল বজ্রপাতসহ বৃষ্টি। এমনিতেই প্লেনের প্রচণ্ড শব্দ তার মধ্যে
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বজ্রপাত হচ্ছে। আমি তো ভয়ে অস্থির। আমার পাশের সিটে বসেছিলেন একজন সুদর্শন যুবক।
আমি যে ভয় পাচ্ছি সম্ভবত সেটা বুঝতে পেরে তিনি আমার সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। আমি
কই যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, পরিবারে কে কে আছে, কতদিন থাকব, এরপর তিনিও জানালেন যে তিনি
মালয়েশিয়া যাচ্ছেন বিজনেস মিটিং করতে। প্লেন যখন একদম উপর উঠে গেল ঝাকুনি কমল, বৃষ্টি
আর দেখা যাচ্ছিল না, তখন যুবকটি নিজেই জানালেন যে, আমার ভয় দূর করতেই তিনি কথা বলে
আমাকে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করেছেন।
মালয়েশিয়া নেমে ৬ ঘণ্টা কাটালাম।
বিরাট এয়ারপোর্ট, সেখানে গিয়েই প্রথম মনে হল যেন বিদেশে এসেছি। অনেকটা সময় এয়ারপোর্ট
ঘুরেঘুরে দেখলাম। এরপর মালয়েশিয়া থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা যাত্রা শেষে ফিলিপাইনের রাজধানী
ম্যানিলা এয়ারপোর্ট গিয়ে পৌছালাম। আবার ভয় শুরু, এখানকার ইমিগ্রেশনে আবার কোন ঝামেলা
হবে না তো?
যা ভেবেছি পুরোই তার উল্টো।
ইমিগ্রেশনের মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে মস্ত একটা হাসি দিয়ে পাসপোর্ট নিল। মেয়েটির হাসি
দেখেই আমার সব ভয়-আশঙ্কা দূর হয়ে গেল। পাসপোর্ট-এ সিল দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আবার একটা
হাসি দিয়ে মেয়েটি বলল, “welcome to our country”.
এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই দেখি
আমার অফিসের কো-ওডিনেটর মানে আমার বস ফাদার ড্যানিয়েল গমেজ আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
এর আগে মাত্র একবার বসের সাথে দেখা হয়েছিল আমার। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম চমৎকার একজন
মানুষ তিনি।
অফিসের গাড়িতে উঠতেই তিনি জিজ্ঞেস
করলেন আমার মোবাইল আছে কিনা। আমি না বলতেই
তিনি ড্রাইভারকে শপিং মলে যেতে বললেন। প্রায় আধা ঘণ্টা চলার পর আমরা বিরাট এক শপিং
মলের সামনে নামলাম। যার নাম এস এম শপিং মল। ফাদার আমাকে ১০০ ডলার দিয়ে নোকিয়ার একটা
মোবাইল কিনে দিলেন। এরপর আমাকে নিয়ে একটা থাই রেস্টুরেন্ট গেলেন লাঞ্চ করতে।
ফিলিপাইনে আমি |
এক সময় ম্যানিলার কেজন সিটির
ফেয়ারভিউতে অবস্থিত আমার স্বপ্নের রেডিও ভেরিতাস
এশিয়ার প্রধান কার্যালয়ে গাড়ি থামল। প্রধান গেইট দিয়ে কার্যালয়ে প্রবেশ করেই জায়গাটা
আমার দারুন পছন্দ হয়ে গেল। বিশাল এলাকা নিয়ে কার্যালয়। চারপাশটা সবুজ আর সবুজ। দেখলেই
বোঝা যায় প্রত্যেকটি ঘাস-পাতায় রয়েছে যত্নের ছোঁয়া। এছাড়াও রয়েছে বিশালদেহি সব আম গাছ
আর এক ধরনের ফলের গাছ রয়েছে ফিলিপাইনের ভাষায় ফলটিকে বলা হয় সান্তাল ফল। সবুজের ঠিক
মাঝখানে আমাদের কার্যালয় আর দুই পাশে ভেরিতাসের
বিদেশি কর্মীদের আবাসন। এর মাঝেই রয়েছে খেলার মাঠ, ব্যাডমিন্টন কোট। ঠিক যেন একটা পার্ক।
আমাকে দেয়া হল সিঙ্গেল এপার্টমেন্ট।
একটা বেডরুম, ড্রয়িং-ডাইনিং-কিচেন একসাথে, একটা বাথরুম। সিঙ্গেলদের জন্য এই ব্যবস্থা।
আর বিবাহিতদের জন্য ফ্যামিলি এপার্টমেন্ট।
রেডিও ভেরিতাসের বাংলা বিভাগে
আমরা তিনজন কর্মী ছিলাম। একজন কোলকাতা থেকে আর দুইজন বাংলাদেশ থেকে। আমার কাজ ছিল তিনদিন
সকালে ও রাতের পুরো আধা ঘণ্টার অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করা, নারী ও শিশুদের নিয়ে মহিলাঙ্গন
অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট লেখা, কণ্ঠ দেয়া, প্রতিদিনের বিশ্ব সংবাদ লেখা ও সপ্তাহে দুইদিন
সকাল ও রাতে ৪ বার সংবাদ পাঠ করা এবং শ্রোতাদের লেখা চিঠিপত্রের যাবতীয় বিষয় তদারকি
করা। যেমন- বাংলাদেশ ও ভারতে কতজন শ্রোতা রয়েছে, কতগুলো শ্রোতা ক্লাব রয়েছে, শ্রোতা
ক্লাবগুলোকে রেজিস্ট্রেশন দেয়া ইত্যাদি। শ্রোতাদের পাঠানো চিঠিপত্র নিয়ে সপ্তাহে দুইদিন
আলাপন অনুষ্ঠান আমাকে পরিচালনা করতে হত। আর এই অনুষ্ঠানটি করতেই আমার সব চেয়ে বেশি
ভাল লাগত। কারণ যাদের সাথে সামনাসামনি কখনও কথা বা দেখা হয়নি তাদের আবেগমিশ্রিত চিঠিপত্র
নিয়ে আলোচনা করতে করতেই একটা সময় আত্মিকভাবে তাদের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। শুধুমাত্র
নাম পড়েই জানতাম অমুক শ্রোতা কোন এলাকার এবং তার পুরো ঠিকানা।
রেডিও ভেরিতাস এশিয়া থেকে তখন
১৭ টি ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচারিত হত। আমাদের ঠিক পরের অফিসটিই ছিল শ্রীলঙ্কার অফিস সিনহালা
বিভাগ। এক সময় সেই অফিসের এক প্রযোজকের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। বন্ধুত্ব থেকে
প্রেম এবং তারপর বিয়ে। ১৫ বছর চলছে আমাদের সংসার জীবন। আমাদের ১১ বছরের একটি মেয়ে আছে।
ফিলিপাইনের এশিয়ান সোশ্যাল ইন্সটিটিউট থেকে স্কলারশিপ নিয়ে আমি সোশ্যাল সার্ভিসেস এন্ড
ডেভেলপমেন্ট-এর উপর মাস্টার্স পাস করি। ২০১১ সাল থেকে শ্রীলঙ্কায় স্থায়ীভাবে বাস করছি।
তাই বলছিলাম রেডিও ভেরিতাস
এশিয়া ছিল আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।
চলবে.....................
এ ধরনের আর লেখা পড়তে ক্লিক করুন
No comments