Header Ads

আপনি কি খ্রিষ্টান?

 

খ্রিষ্টান 



বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমার ছোট দাদা ঢাকার কোন এক বড় হাসপাতালে গিয়েছিলেন স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য। ইসিজি রুম থেকে বেড়িয়ে আসার সময় হঠাৎ তার চোখে পড়লো দরজার কাছে সোনালী রঙ্গের কি যেন চকচক করছে। দাদা সেটি হাতে নিয়ে দেখলেন স্বর্ণের চেইন। তিনি সোজা রিস্পেসনিষ্টের কাছে গিয়ে চেইনটি দিয়ে বলেন, 'চেইনটি দরজার কাছে পড়ে ছিল। দেখুন এর মালিককে পাওয়া যায় কিনা।' বলেই দাদা হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। হঠাৎ রিস্পেসনিষ্ট বললেন, 'আপনি কি খ্রিষ্টান?' দাদা পেছন ফিরে বললেন, 'কেন বলুন তো?' রিস্পেসনিষ্ট মেয়েটি মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, 'না মানে এত দামী একটি জিনিস, আপনি পেয়ে ফিরিয়ে দিলেন তো তাই মনে হলো আপনি হয়তো খ্রিষ্টান।' আমার দাদা গর্বের হাসি দিয়ে বলেছিলেন,  'হ্যাঁ আমি একজন খ্রিষ্টান।'

আমাদের খ্রিষ্টান সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা তাদের সততার জন্য বহুবার মানুষের সামনে নিজেদেরকে খ্রিষ্টান হিসেবে প্রমান করছেন। রাস্তা-ঘাটে, যান-বাহনে, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠোনে, কর্মক্ষেত্রে, কথায়-বার্তায়, আচার-ব্যবহারে তারা খ্রিষ্টান শব্দটিকে অলংকৃত করছেন, প্রশংসিত করছেন।

আসলে খ্রিষ্টান কারা? যারা খ্রিষ্টের অনুগামী তারাই খ্রিষ্টান। খ্রিষ্টের অনুগামীরা চুরি করে না, মিথ্যা বলে না, কারো সাথে প্রতারণা করে না, অন্যের জিনিসে লোভ করে না, হিংসা করে না, হত্যা করে না। খ্রিষ্টের অনুগামীরা শান্তি বজায় রেখে চলে, অপরাধীকে ক্ষমা করে, পরের উপকার করে এবং প্রতিবেশীকে ভালবাসে। আর এই গুণগুলোই হচ্ছে প্রকৃত খ্রিষ্টানদের অলংকার।

কিন্তু বর্তমানে আমাদের খ্রিষ্টান সমাজগুলোর দিকে তাকালে কি আমরা হলফ করে বলতে পারবো যে আমরা প্রকৃত খ্রিষ্টান? আমাদের সমাজ প্রকৃত খ্রিষ্টান সমাজ? আজকাল আমরা বড়বেশী স্বার্থপর হয়ে উঠেছি। নিজের স্বার্থের জন্য অন্যের ক্ষতি হলো না কি অন্যে কোন বিপদে পড়লো তা আমরা কখনোই চিন্তা করি না। আমাদের খ্রিষ্টান সমাজে এমন কিছু মানুষ রয়েছেন যারা তাদের কাজে-কর্মে , কথা-বার্তায় খ্রিষ্টান শব্দটিকে প্রতিনিয়ত কলংকৃত করছেন। যা খুবই দুঃখজনক এবং লজ্জাজনক। এরা সখ্যায় কম তবে তাদের প্রভাব অনেক বেশী। এই মানুষগুলো সত্যবলাকে, চুরি না করাকে, অপরাধীকে ক্ষমা করাকে, শান্তি বজায় রেখে চলাকে দুর্বলতা মনে করে। আর তারা যেহেতেু সখ্যায় কম, তাই তাদের অপশক্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তারা অখ্রিষ্টান বন্ধুদের সহযোগীতা নেয়। ঠিক সহযোগীতা নয়, টাকা দিয়ে কিংবা বা মদ দিয়ে এসব তথাকথিত বন্ধুদের কিনে আনে। এরপর সমাজে যারা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যারা সমাজের উন্নয়ন চায়, যাদের জন্য এসব নোংরা বিকৃত মানুষগুলো তাদের অপকর্ম সিদ্ধ করতে পারে না কিংবা তাদের প্রতিপক্ষ কেউ যদি থাকে তাদের ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে, বাগানের ফুল-ফল চুরি করে, মাছের পুকুরে বিষ দেয়, বিয়ের যোগ্য ছেলেমেয়েদের বিয়ে ভেঙ্গে দেয়, অন্যের নামে কৃrসা রটায় এভাবে সমগ্র পরিবেশকে অশান্ত করে তোলে। তারা যেহেতু অন্ধকারের মানুষ তাই প্রতিপক্ষের বাড়ীতে ঐসব অখ্রিষ্টান বন্ধুদের দিয়ে রাতের অন্ধকারে হামলা চালায়, ঘরের চালে ঠিল ছুড়ে, বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়, বড় অঙ্কের চাঁদা দাবী করে এবং ফোনে মৃত্যুর হুমনি-ধামকি দেয়। আর যে বাড়ীতে হামলা করা হয় রাতের অন্ধকারে যখন বাড়ীর ছোট ছোট শিশুরা ভয়ে চিৎকার করে, বাড়ীর বয়োজেষ্ঠ্য মানুষটি অসুস্থ্য হয়ে পড়ে তখন এই সব খ্রিষ্টান নামধারী অমানুষগুলো পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠে। এই কি আমাদের খ্রিষ্টানদের উদাহরণ? একশোটা ভালো ডিমের মধ্যে একটা খারাপ ডিম থাকলে কিংবা একশোটা ভালো আলুর সাথে একটা পচা আলু থাকলে যেমন দুর্গন্ধ বের হয়, ঠিক তেমনি সমাজের অনেক ভালো মানুষের মধ্যে এই গুটি কয়েক নোংরা মানুষ পুরো খ্রিষ্টান সমাজের ভাবমূর্তি এবং পরিবেশ নষ্ট করে ফেলছে, অশান্ত করে তুলছে।

পোপ ফ্রান্সিস বছর বিশ্ব শান্তি দিবসে তার বাণীতে বলেছেন, একই ঈশ্বরের সৃষ্ট মানুষ হিসেবে আমরা আমাদের সকল ভাইবোনদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমরা যেন কখনোই আমাদের প্রতিবেশীর প্রতি উদাসীন হয়ে না পড়ি। আমরা যেন দুঃখীর পাশে দাড়াই, অন্যের যন্ত্রনার সহভাগি হই, অন্যের সমস্যার প্রতি সহানুভুতি হই, অভাবীর অভাব দূর করতে সচেষ্ট হই। আমরা যেন অন্যের বিপদে-আপদে, দুঃখে-কষ্টে আমাদের হৃদয়, চোখ, কান বন্ধ করে না রাখি। আমাদের এই ধরনের আচরণ ঈশ্বরের সঙ্গে, প্রতিবেশী ভাইবোনদের সঙ্গে এবং পরিবেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করে এবং আমাদের চারপাশের সমগ্র পরিবেশকে অশান্ত করে তোলে।

আমরা যারা নিজ স্বার্থের জন্য সমগ্র খ্রিষ্টান সমাজের দুর্নামের কারণ হচ্ছি, খ্রিষ্টান শব্দটিকে কলংকৃত করছি আমরা যেন এসময়টিতে নিজেদের নিয়ে একবার ভাবি। এমনিতেই সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান সম্প্রদায় দেশের বিভিন্নস্থানে বিভিন্নভাবে অখ্রিষ্টানদের দ্বারা নির্যাতিত এবং অবহেলিত হচ্ছে। তবে আমরা কেন আমাদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবো? আমরা নিজেরা যখন সুসংগঠিত থাকবো, একত্রে মিলেমিশে একটা আদর্শ শক্তিশালী খ্রিষ্টান সমাজ গড়ে তুলতে পারবো তখন বাইরের কোন অপশক্তি আমাদের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস পাবে না।  

এবার আরেকটি ঘটনা বলি। অনেক বছর আগের কথা। আমরা বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে একসাথে খেলছিলাম। আমার বছরের এক মামাতবোন হয়তো আগের রাতে তার বাবা-মায়ের মধ্যে আর্থিক সংকটের কোন কথা শুনতে পেয়েছিলো তাই মন খারাপ করে তার আরেক বন্ধুকে বললো, 'জানিস আমরা না অনেক গরীব।' উত্তরে তার বন্ধুটি বললো, 'তোরা না খ্রিষ্টান? তাহলে তোরা গরীব হলি কিভাবে?'

আমি জানি না, শিশু বয়সে বন্ধুটি কি ভেবে বলেছিল যে খ্রিষ্টানরা কখনো গরীব হতে পারে না। তবে খ্রিষ্টানরা আধ্যাত্মিকভাবে কখনোই গরীব নয়। কেননা আমাদের আছে স্বয়ং ঈশ্বরের দেওয়া দশ আজ্ঞা। আমরা চুরি করবো না, নরহত্যা করবো না, মিথ্যা সাক্ষ্য দিব না, আমরা অপরাধীকে ক্ষমা করবো, আমরা পরস্পরকে ভালবাসবো। এই গূণগুলোই তো একজন প্রকৃত খ্রিষ্টানের বড় সম্পদ, অলংকার। যে সম্পদ কেউ কোনদিন চুরি করতে পারবে না। যা সঞ্চিত থাকবে স্বর্গরাজ্যের জন্য।

আমাদের অবস্থান কোথায়? আমরা কি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই আজ্ঞাগুলো পালন করছি? আমরা আমাদের কথাবার্বাতায়, কাজেকর্কমে, আচারব্যবহারে খ্রিষ্টান শব্দটিকে অলংকৃত করছি নাকি কলংকৃত করছি। আজ যদি কেউ আমাদের জিজ্ঞাসা করে, 'আপনি কি খ্রিষ্টান?' আমাদের উত্তর কি হবে?
 
আরও পড়তে ক্লিক করুন-
 

No comments

Theme images by Deejpilot. Powered by Blogger.