যেভাবে আমি প্রবাসী হলাম- ২
প্রবাসী আমি |
রেডিও ভেরিতাসে আমার দ্বিতীয় দিন
পরের দিন ছিল বাংলা নববর্ষ।
আগেরদিন জার্নি করে আসার কারণে সকালে ঘুম থেকে উঠে অফিসে যেতে যেতে ৬ টা বেজে গেল।
অফিসে গিয়ে দেখি আমার কো-অর্ডিনেটর ফাদার সুনীল ইতিমধ্যে প্রতিদিনের সংবাদ লিখে শেষ
করে ফেলেছেন। তিনি জানালেন ভোরের সংবাদের জন্য সকাল পৌনে পাঁচটায় অফিসে আসতে হয়। আমি
ফাদারের কথা শুনে অনেক লজ্জা পেলাম। ফাদার সংবাদগুলো প্রিন্ট করে আমার হাতে দিয়ে বললেন,
একটু প্র্যাকটিস করে নাও। আমি উনার সামনেই জোরে জোরে পড়তে লাগলাম। পড়া শেষ হলে তিনি
আমাকে নিয়ে গেলেন রেকর্ডিং রুমে। সেখানে মাত্র দুইবার ভুল করে আমি সংবাদ পড়ে দিলাম।
যিনি রেকর্ডিং করছিলেন টেকনিশিয়ান তিনি আমার ভয়েস এবং মাত্র দুইবার ভুল করার জন্য প্রশংসা
করলেন।
এরপর ফাদারের এপার্টমেন্টে
গিয়ে সকালের নাস্তা করলাম। ফাদার জানালেন নববর্ষ উপলক্ষে আজ শুধুমাত্র বাংলা বিভাগে
ছুটি। বিকেলে ম্যানিলায় অবস্থিত খ্রিষ্টান বাঙ্গালিরা আসবেন এবং বাংলা নববর্ষ পালন
করা হবে। তবে রেডিও ভেরিতাসে অন্যান্য বিভাগ ও অফিস খোলা থাকায় সাড়ে আটায় তিনি আমাকে
ভেরিতাসের বাকি ২১টি বিভাগে ও ম্যানেজমেন্ট অফিসে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর
ফাদার নিজের গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে গেলেন কাঁচাবাজারে।
অফিস থেকে প্রায় দের/দুই কিলোমিটার
দূরে বিরাট এক কাঁচাবাজার যেটির নাম মাঙ্গাহান। মাছ-মাংস, সবজি, চালডাল সবকিছু সেখানে
পাওয়া যায়। বাজার সেরে ভেরিতাসে ফিরে দেখি এরই মধ্যে বাঙ্গালী তিনজন সিস্টার চলে এসেছেন
যারা ম্যানিলার ইউনিভার্সিটি অব সান্তা টমাস- এ পড়াশুনা করেন। দেশে থাকতে আমি সেই তিনজন
সিস্টারকেই চিনতাম। তাদের পেয়ে খুবই ভাল লাগছিল। সিস্টারগণ দুপুরের রান্না শুরু করে
দিলেন আর আমি তাদের সাথে কাটাকুটিতে সাহায্য করলাম। এরপর সিস্টারদের নিয়ে নিজের বাসায় গিয়ে স্নান করে
আবার ফাদারের বাসায় গেলাম দুপুরের খাবার খেতে।
দুপুরের খাবারের পর শুরু হল
রাতের জন্য রান্না। প্রায় ৫০ জনের জন্য রান্নার আয়োজন হল। বিকেল ৪ টা থেকেই অতিথিরা
আসতে শুরু করলেন। অতিথিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ফিলিপিনো ছিলেন। একজন হলেন জনি আঙ্কেল।
এই জনি আঙ্কেল যে কোন বাঙ্গালীকে সাহায্য করে থাকেন বিশেষ করে বাঙ্গালী শিক্ষার্থীদের।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার মধ্যে
সবাই চলে এলেন। অনেকদিন পর সবাই একসাথে হতে পেরে কথার ঝুলি নিয়ে বসে পড়লেন। ফাদার আমাকে
সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি দেশ থেকে
যাওয়ার সময় অনেকের চিঠি নিয়ে এসেছিলাম, যাদের অনেককে আমি চিনতাম না। চিঠিগুলো দিতেই
সাবাই যার যারটা নিয়ে নিলেন। এরপর শুরু হল নববর্ষের অনুষ্ঠান। ফাদারের ঘরের উঠোনে সবুজ
ঘাসের লনের উপরে অনুষ্ঠান। প্রথমে সবাই মিলে ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটা গাইলাম। ফাদারের
নিজের হারমনিয়াম-তবলা ছিল। এরপর অনেকেই একক, যৌথ, সমবেত গান পরিবেশন করলেন। সবশেষে
খাবারের পালা। খাবার পর সবাই বিদায় নিলে আমি আমার ঘরে ফিরে এলাম। আগেরদিন জার্নি করে
এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বিধায় বাড়ির কথা, দেশের কথা খুব একটা মনে পড়ে নি। তবে সেদিন নববর্ষ
পালন শেষে সবাই চলে গেলে কেন জানি খুব একা একা লাগছিল।
পরেরদিন অফিসে গেলে ফাদার আমার
কাজ বুঝিয়ে দিলেন। ভেরিতাসের বাংলা বিভাগে আমরা তিনজন কর্মী ছিলাম। একজন কোলকাতা থেকে
আর দুইজন বাংলাদেশ থেকে। আমি যেদিন ফিলিপাইনে যাই সেইদিনই আমার আরেক সহকর্মী ১ মাসের
ছুটিতে দেশে যান। তাই আমি কাজে যখন যোগ দেই তখন আমরা অফিসে দুইজন কাজ করতাম।
আগের লেখায় ভেরিতাসের বাংলা
বিভাগে আমার কাজ সম্পর্কে অনেক কিছুই লিখেছি। লিখেছি কোন কাজটা করতে আমার সবচেয়ে বেশি
ভাল লাগতো। আজ জানাচ্ছি কোন কাজটা করতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হতো। আগেই বলেছি আমার কাজের
মধ্যে ছিল দুইবেলা সংবাদ লেখা। ভেরিতাসে একটা নিউজ রুম ছিল যেখানে একটা বিশেষ কম্পিউটারে ২৪ ঘণ্টা
ইংরেজিতে নিউজ আপডেট হতে থাকতো। সেখানে BBC, UCAN সহ অনেকগুলো সংস্থা থেকে নিউজ ভেরিতাসে
পাঠানো হতো। আমাদেরকে সেই হাজার হাজার নিউজ থেকে বেছে চলমান বস্তুনিষ্ঠ সময় উপযোগী
নিউজ সংগ্রহ করতে হত। এরপর সেগুলো অনুবাদ করে ছোট সংবাদ আকারে লিখতে হত। প্রথম প্রথম
সংবাদ অনুবাদ করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। আর হ্যাঁ, ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলতে অনেকটা
সময় লেগেছে।
চলবে……………
আরও পড়তে ক্লিক করুন
No comments