করোনায় রাশেদের সংগ্রাম
রাশেদ |
১।
রাশেদ
এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েছে আরও ঘণ্টা খানেক আগে। ব্যাগ হাতে এয়ারপোর্টের বারান্দায় উদাস
দৃষ্টিতে ঠায় দাঁড়িয়ে, কি যে দেখছে সে, কে জানে! তার যেন কোন তাড়া নেই। দুইজন ট্যাক্সিওয়ালা
রাশেদকে ডেকে চলে গেল। রাশেদের কান পর্যন্ত সেই ডাক পৌঁছালোনা। এয়ারপোর্ট একদম ফাঁকা।
গেটে দায়িত্বরত পুলিশ এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কোথায় যাবেন?’
রাশেদ
হকচকিয়ে বলল, ‘মুন্সিগঞ্জ।‘
‘কিভাবে
যাবেন?’
‘একটা
ট্যাক্সি দরকার।‘
পুলিশ
অনেকটা রাগান্বিত হয়ে বললেন, ‘দুইটা ট্যাক্সি আপনাকে ডেকে গেল। গেলেন না যে?’
রাশেদ
কোন উত্তর দিল না। পুলিশ বললেন, ‘এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। আর মাস্ক দুইটা পরেন।‘
রাশেদ কোন উত্তর না দিয়ে শার্টএর পকেট থেকে আরও একটা মাস্ক বের করে পরে নিল। তখনই একটা
ট্যাক্সি সামনে এসে দাঁড়াল। রাশেদ মুন্সিগঞ্জ বলতেই ট্যাক্সিওয়ালা জানালো ভাড়া গুনতে
হবে দুইগুন। রাশেদ তার ভাগ্য জেনে গেছে। ট্যাক্সিওয়ালাদের সাথে দর কষাকষি করে ভাগ্যের
চাকাকে ঘুরানো যাবে না। রাশেদ ট্যাক্সিতে উঠে বসলো। ঢাকা শহর পুরো ফাঁকা। এয়ারপোর্ট
থেকে গুলিস্থান যেতে যেখানে লেগে যেত তিন থেকে চার ঘণ্টা সেখানে আজ লাগলো এক ঘণ্টারও
কম। রাস্তাঘাটে কোন হকার নেই, যানজট নেই, নেই কোন কোলাহল। এ যেন সম্পূর্ণ অচেনা এক
ঢাকা শহর। ঢাকা শহর ঢাকা পরেছে করোনার জালে।
বাবুবাজার
ব্রিজ পেরিয়ে আরও বেশ কিছুদূর এগোলেই চওড়া পিচঢালা রাস্তার দুপাশে সারিসারি শস্যের
ক্ষেত। গ্রামীণ মাঠঘাট চোখে পরতেই রাশেদের দুচোখ গড়িয়ে জল পরতে লাগলো। মাত্র ছয়মাস
আগে এই একই রাস্তা দিয়েই রাশেদ এয়ারপোর্ট গিয়েছিল দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে। রাস্তা-ঘাটে
ট্রাফিক জ্যাম, ধুলো- বালি, ময়লা, কোলাহল তারপরও রাশেদের সেই কি উত্তেজনা প্রথম বিদেশ
যাওয়ার আনন্দে। সেদিন না পাওয়াকে পাওয়ার স্বপ্নে খুশিতে তার চোখ জ্বলজ্বল করছিল। তখন
রাশেদের সংগে বাবা-মা, বোনও ছিল। স্বপ্ন শুধু একা রাশেদের চোখেই ছিল না, পরিবারের সবাই
স্বপ্ন দখতে দেখতে এয়ারপোর্ট গিয়েছিল। সবচেয়ে বেশি যে স্বপ দেখেছিল সে শিউলি। যাবার
তিনদিন আগে থেকে তার সে কি কান্না। রাশেদ শিউলিকে সান্তনা দিয়ে বারবার বলেছিল,
‘মাত্র
তো দুটো বছর। এই দুই বছরে সব ঋণ শোধ করে বিয়ের জন্য টাকা জমিয়ে তারপর দেশে ফিরবো। দেখতে
দেখতে দুই বছর চলে যাবে।‘
এয়ারপোর্ট
রওনা হবার সময় শিউলি রাশেদের বুকে মাথা গুজে কেঁদেছিল। রাশেদের বাবা-মা, বোন সবার সামনে
শিউলি কিভাবে যে এই কাজটি করলো! যতদিন সে দুবাই ছিল শিউলির জন্য মন খারাপ হলেই এই একটি
কথা ভেবে রাশেদের হাসি পেতো। শিউলির কি সাহস!
রাশেদ
বেকার ছিল বলে শিউলির বাবা রাশেদের সংগে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না। শিউলিকে পাবার
জন্য রাশেদ তড়িঘড়ি করে বাড়িঘর বন্ধক রেখে দুবাই গিয়েছিল গত জানুয়ারিতে।
দুবাই
গিয়ে প্রথম দেড় মাস কোন বেতন পায়নি রাশেদ। জানুয়ারির ১৩ তারিখে যাওয়ায় ভাঙ্গা মাসের
বেতন হল না। ফেব্রুয়ারি মাসেও রাশেদের কাজের ধরন দেখে খুব একটা খুশি হলেন না কিচেন
ম্যানেজার। তাই বেতন কাটা। মার্চ থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট কুক হিসেবে রাশেদের বেতন মিলল
বাংলাদেশি ২৩ হাজার টাকা। অথচ দালাল বলেছিল বেতন দেয়া হবে ৪০ হাজার টাকা। পান খাওয়া লাল টকটকে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলেছিল,
‘টাকা যত তারাতারি দেবেন বিদেশ যাত্রাও তত তারাতারি হবে। একবার দুবাই গেলে শুধু টাকাই
টাকা।‘ এদিকে রাশেদের চাকরি না হলে শিউলিকে অন্য জায়গায় বিয়ে দেবেন বলে শিউলির বাবা
উঠেপরে লাগলেন। শেষে টাকার যোগার করতে রাশেদের বসত বাড়িটাকে বন্ধক রাখতে হল। জায়গাও
খুব বেশি নয়, মাত্র দশ শতাংশ জায়গা। পুরো জায়গার দলিল মহসিন মোল্লার হাতে দিয়ে পাঁচ
লাখ টাকার পুরোটাই তুলে দিয়েছিল দালালের হাতে। ভেবেছিল দুবাই গিয়েই তো বন্ধক বাড়ি ছাড়িয়েই
আনবে। দুবাই গিয়ে মাত্র দুইমাস টাকা পাঠাতে পেরেছিল রাশেদ। রাশেদের পাঠানো টাকা পেয়ে
পরিবারের সবাই স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিল মাত্র। বন্ধক বাড়ি ছাড়ানো হবে, ছোট বোন রাবেয়ার
বিয়ে দিবে, তারপর রাশেদের বিয়ে।
সুখ
হয়তো সবার কপালে সয় না, তা না হলে হঠাৎ করে কেন-ই-বা সারা পৃথিবীজুড়ে করোনা শুরু হবে
আর রাশেদ চাকরি হারাবে! করোনার শুরুতে রাশেদের
হোটেলে দুইমাস সব কর্মচারীদের বসিয়ে বসিয়ে খাইয়েছেন মালিক। হোটেলে কাস্টমার নেই, গেস্ট
নেই, রান্নাবান্না নেই, হোটেল চলছেনা। মালিকের পক্ষে এত কর্মচারীকে বসিয়ে খাওয়ানো তো
আর সম্ভব না। তাই কর্মী ছাটাই। বয়স্ক আর একেবারে নতুন কর্মচারীরা ছাঁটাইয়ের তালিকায়
পড়ল। সেই তালিকার ২২ নম্বরে রাশেদের নাম ছিল। বলা হল করোনা শেষ হলে ছাঁটাইকৃত কর্মীদের
আবার ফিরিয়ে আনা হবে। তাই ছাঁটাইকৃতরা যেন কিচেন ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস-এ নিয়মিত যোগাযোগ
রাখেন। তবে সবাই বলাবলি করছিল যে, এই করোনা কোনদিন শেষ হবে না আর তাদের ভাগ্যের চাকাও
কোনদিন ঘুরবে না।
এদিকে
লকডাউনের কারনে রাশেদের বাবাও দুইমাস হল বাড়িতে বসা। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট, দোকান পাট,
ব্যাবসা বাণিজ্য সব বন্ধ। যা-ও শর্ত সাপেক্ষে চলছে সেখানেও কর্মী ছাটাই। দুই চার ঘণ্টা
কাজের জন্য কেই বা এত কর্মচারী রাখবে।
গত
ছয়মাসে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনাগুলো রাশেদের মাথায় এলোমেলোভাবে ঘুরতে লাগল। এরই মধ্যে
রাশেদ গ্রামের রাস্তায় চলে এসেছে। রাশেদের বাবা বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাবাকে
দেখে রাশেদ ট্যাক্সি থেকে নেমে এলো। রাশেদ বাবার পা ছুঁইয়ে সালাম করে হাউমাউ করে কাঁদতে
লাগলো। বাবা রাশেদকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করে বললেন, ‘কাঁদছিস কেন?’ বলে
নিজেই চোখের জল মুছতে লাগলেন। পিতাপুত্র ট্যাক্সিতে উঠে বাড়ির দিকে চলতে লাগলেন, কারও
মুখে কোন কথা নেই। বাড়ির কাছে আসতে বাবাই ট্যাক্সি থামাতে বললেন। নিজেই ভাড়া মিটিয়ে
দিলেন। মা বোন উঠানেই অপেক্ষা করছিল। রাশেদ মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে শুরু করলো।
২।
রাশেদের
ফিরে আসার খবরটা শিউলি ঠিকই পেয়েছিল। কিন্তু তার বাবা তাকে রাশেদের সংগে দেখা করতে
যেতে দেন নি। বাবার এক কথা, কোনও বেকার ছেলের সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দেবেন না। রাশেদ বিদেশ
থেকে ফিরে এসেছে, সে এখন বেকার। তাই মেয়েকে বিয়ে দেবেন বলে যে কথা হয়েছিল সে কথার এখন
আর কোন মূল্য নেই। শোনা যাচ্ছে এরই মধ্যে নাকি তিনি অন্য জায়গায় পাত্রের সন্ধানও করছেন।
শিউলির বাবা রমিজ উদ্দিন অবস্থা সম্পন্ন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার তিনি। বাড়িঘর
জায়গা-জমি বিস্তর। শুরু থেকেই হা-ভাত রাশেদের সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক তিনি কিছুতেই মেনে
নিতে চাননি। মেয়ের একগুয়েমির কারণে শর্ত সাপেক্ষে তিনি রাজি হয়েছিলেন। এখন রাশেদ শুধু
বেকারই নয়, মাথায় রয়েছে বাড়ি বন্ধকের বোঝা। এই ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেয়ার কোন প্রশ্নই
আসে না।
শিউলিও
তার বাবাকে হারে হারে চিনে। তাই কোন আশার আলো দেখতে না পেয়ে গত চারদিন ধরে সে কেঁদেই
যাচ্ছে। সন্ধ্যায় রাবেয়া শিউলিদের বাড়িতে এল রাশেদের বাড়ি ফেরার কথা জানাতে। শিউলি
কান্না থামিয়ে বলল, ‘ট্যাক্সি যখন এসেছে আমি জানালা দিয়ে দেখেছি।‘একটু থেমে শিউলি জিজ্ঞেস
করল, ‘আচ্ছা রাবেয়া রাশেদ কি রোগা হয়ে গেছে?’
রাবেয়া
শুধু বলল, ‘হুম’
‘আমার
কথা কিছু বলেছে?’
‘কিছু
বলেনি। তবে বাবা বলছিল ভাইয়াকে নিয়ে কাল সকালে তোদের বাড়ি আসবে চাচার সাথে কথা বলতে।’
‘এসে
কোন লাভ নেই’ বলেই শিউলি আবার কাঁদতে শুরু করলো।
রাবেয়া
চলে যাওয়া মাত্র শিউলি রাশেদকে ফোন করল। সারাদিনের ক্লান্তির পর রাশেদ বিছানায় গিয়েই
ঘুমিয়ে পড়েছিল। হ্যালো বলতেই শিউলির অভিমানী কণ্ঠ, ‘সেই বিকেলে ফিরেছ একটা কল করার
কথা মনে পরল না?’ রাশেদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কল করে কি বলতাম তোমাকে!’
‘আমার
কথা তোমার আসলে মনেই ছিল না, তাই না?
‘খুব
মনে ছিল। তবে এভাবে ফিরে এলাম’
‘এভাবে
মানে?’
সবাই
বিদেশ থেকে ফিরে আসে কত আনন্দ নিয়ে। আর আমি ফিরে এলাম পরিবারের সবার মাথায় একটা ঋণের
বোঝা চাপিয়ে দিয়ে’
‘তুমি
তো আর ইচ্ছে করে কর নি’
‘তোমার
বাবা কি সেটা বুঝবে’
‘বাবা
বুঝবে না বলে তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করবে না?’ একটু চুপ থেকে শিউলি বলল, ‘রাশেদ তুমি
কি আমাকে সত্যি ভালবাস?’
‘বাসি,
আমি তোমাকে সত্যি খুব ভালবাসি শিউলি’
‘তবে
চল আমরা কোথাও পালিয়ে যাই? বাবা কিছুতেই এখন আর তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন না। যদি
সত্যি তুমি আমাকে ভালোবাসো তবে আমাকে নিয়ে তোমার পালিয়ে যেতে হবে। এছাড়া আমি আর কোন
উপায় দেখছি না।‘ এক নিমিষে শিউলি কথাগুলো বলে ফেলল
সেই
ছোটবেলা থেকেই রাশেদ ধিরস্থির, শান্ত প্রকৃতির ছেলে। কোন কিছুতেই সে তাড়াহুড়ো করে না।
বাবা-মা, বোন সবার সঙ্গে তার পারিবারিক বন্ধনটা খুব শক্ত। নিজের একার স্বার্থের কথা
সে কখনও চিন্তাই করতে পারে না। তাই শিউলির এই পালিয়ে যাওয়ার প্রশ্নের উত্তর কি হবে
রাশেদের তা জানা নেই। সে শিউলিকে সত্যি খুব ভালবাসে কিন্তু পালিয়ে যাওয়া এখন আর তার
পক্ষে সম্ভব নয়। এখন রাশেদের শুধু শিউলির কথা ভাবলেই চলবে না, বাবা-মা, বোন সবাইকে
সে পথে বসিয়েছে। তার মাথার উপর যে ছাদ আর পায়ের নিচে মাটি এসব যে তার নিজের নয়। এগুলো
সব ফিরিয়ে আনতে হবে। বিদেশ যাওয়ার আগে সে বাবার আদুরে ছেলে ছিল। বি এ পাশ করে এখানে
ওখানে চাকরির দরখাস্ত দিয়ে দুই বছর পার করছে। বাবার আয়ে বেশ চলে যাচ্ছিল। সংসারের চিন্তা
কোনদিন রাশেদকে করতে হয়নি। এখন সব চিন্তা যেন তাকেই করতে হবে। তবে কি করতে হবে কিছুই
তার মাথায় ঢুকছিল না। রাশেদের বুকটা চিনচিন করে উঠলো।
ঠিক
তখনই রাশেদের বাবা বাইরে থেকে ডাকলেন, ‘রাশেদ একটু কথা ছিল আসব?’
রাশেদ
শিউলিকে ফোন রাখতে বলে বাবাকে ঘরে ডাকল।
৩।
রাশেদের
বাবা ছেলের পাশে গিয়ে বসলেন। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘এখন কি করা যায় ভেবেছিস
কিছু? কিছু টাকা পয়সা কি দিয়েছে কোম্পানি?’
‘এক
মাসের বেতন দিয়েছে। ‘
‘মাত্র
এক মাসের?’
‘দুই
মাস বসিয়ে খাওয়াল, দেশে ফেরার জন্য প্লেনের টিকিট কেটে দিল। ‘
‘আমারদের
এখন চলবে কি করে? আমার চাকরিটা ও তো নেই। খবরে যা দেখছি শুনছি তাতে তো মনে হয় না এই
মহামারী সহজে বিদায় নিবে। হাতে যা টাকা-পয়সা ছিল তা দিয়ে পনের দিনের বাজার করে রেখেছিলাম।
তাও প্রায় শেষ।’
রাশেদ
আবেগ আপ্লুত হয়ে বাবাকে জরিয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। বাবা নিজেকে সামলে নিয়ে
বললেন, ‘এত ভেঙ্গে পরছিস কেন? আমি তো আছি। ‘
‘আমি
তো আছি’ কথাটা জয়নাল মিয়া বললেন সত্যি তবে তিনি যে কি করবেন সেটি তিনি নিজেও জানেন
না। রাশেদ বাবাকে ছেড়ে চোখ মুছে ব্যাগ থেকে এক মাসের বেতনের টাকা বাবার হাতে তুলে দিল।
এই প্রথম জয়নাল মিয়া ছেলের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিলেন। নিজের কাছেই তার কেমন যেন
লজ্জা করতে লাগল। তিনি কোন কথা বললেন না। এই টাকা শেষ হলে তারপর কিভাবে চলবে সেটি ভাবতে
ভাবতে জয়নাল মিয়া রাশেদের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
৪।
দুপুরে
পুইশাক ভাজি আর ছোট মাছ রান্না হয়েছে। মা বললেন, ‘তোর বাবাকে বলেছিলাম ইলিশ মাছ পেলে
নিয়ে আসতে। ইলিশ নাকি এবার পাওয়াই যাচ্ছে না।‘ বাবা বললেন, ‘লকডাউনে সব বন্ধ। বাজার
তেমন করে কথাও মিলছে না। মাছওয়ালারা আড়তে যেতে পারছে না, দুই একজন খালবিল থেকে যা পাচ্ছে
তাই বিক্রি করছে। আর দামও হাকাচ্ছে খুব।‘
‘ছেলেটা
কত দিন পর ফিরল, একটু যে ভালমন্দ রান্না করবো।‘
রাশেদ
বলল, ‘মা এই ছোটমাছ খেতেই খুব ভাল হয়েছে।‘
রাবেয়া
হি হি করে হেসে বলল, ‘ভুতের মুখে দেখছি রামনাম’
মা
বললেন, ‘খেতে বসে কি বাজে কথা বলছিস এসব?’
‘মা
ভাইয়া জীবনে কোনদিন ছোটমাছ খেয়েছে? যেদিন ছোটমাছ রান্না করতে সেদিন ভাইয়ার মুখ শুকিয়ে
আমচুর হয়ে যেত। আর আজ বলছে ছোটমাছ খুব ভাল লাগছে।‘
‘আরে
আমি যে হোটেলে কাজ করলাম সেখানে তো সব বড়বড় মাছ রান্না হত। ওসব খেয়ে এখন আর বড় মাছ
খেতে ভাল লাগে না। এবার বুঝেছিস?’ বলেই বাম হাত দিয়ে বোনের কান মলে দিল।
‘ভাইয়া
ব্যাথা লাগছে, ছাড়’ বলে রাবেয়া চেঁচিয়ে উঠল।
মা
আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হ্যাঁ-রে দুই মাস বসেছিলি বলছিলি, তখন কি করতি? তখনও কি
ভাল খাবার দিত?’
‘কি
আর করব। সারাদিন দেশ-বিদেশের করোনার খবর দেখতাম আর আল্লাহকে ডাকতাম।‘
বাবা
বললেন, ‘ওকে আর একটু ভাত দাও শরিফা ‘
‘না
মা আর দিও না। আমার খাওয়া শেষ।‘ বলেই হাত ধুয়ে বসে রইল রাশেদ। একটু পর বাবাকে উদ্দেশ্য
করে বলল, ‘শিউলিদের বাড়ি যাবে বলেছিলে?’
‘যাব
তো বলেছিলাম, তবে কোন কাজ হবে বলে মনে হয় না’
রাবেয়া
বলল, ‘রমিজ চাচা নাকি শিউলির জন্য ছেলে দেখছেন’
রাশেদের
মা বললেন, ‘বললেই হল! আমাদের উনি কথা দিয়েছেন।‘
হাত
ধুতে ধুতে জয়নাল মিয়া বললেন, ‘সে তো রাশেদের চাকরি হয়েছিল বলে’
‘রাশেদ
তো আর ইচ্ছে করে চাকরি ছাড়েনি। সারা দুনিয়ায় মহামারি চলছে। উনার কি কোন বিবেক-বিবেচনা
নেই?’
‘রমিজ
উদ্দিনকে এই কথা কে বুঝাবে? লোকটা আগাগোড়াই একগুয়ে’
‘শোন
তুমি আজ বিকেলে রাশেদকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে দেখ উনি কি বলেন। যা শুনছি সেতো মানুষের
মুখে মুখে। তুমি নিজের কানে শুনে এসো’
রাশেদের
মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। সবকিছু যেন রাশেদের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। চাকরিটা হারাল, এখন শিউলিকেও
কি হারাতে হবে? রাশেদ কিছু না বলে টেবিল ছেড়ে উঠে গেল।
৫।
শিউলির
বাবা রমিজ উদ্দিন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। করোনাকে তার অনেক ভয়। দিনে তিনবার
নিয়ম করে গরম পানি দিয়ে গরগর করে গলা পরিস্কার করেন। সব সময় সাথে স্যানিটাইজ রাখেন।
মাস্কও পরেন দুইটা করে। খুব প্রয়োজন না পরলে তিনি কোথাও বের হন না। সারাদিন টিভি-তে
করোনার খবর দেখেন আর বলেন, ‘আঁখিরাত আইসা গেছে। সবাইকেই যার যার পাপের জন্য তওবা করা
দরকার।‘ ইউনিয়ন পরিষদের নানান কাজে আগে লোকজন বাড়িতে আসতো, তাকেও যেতে হতো এখানে সেখানে।
এখন তার বাড়িতে লোকজন আসা একেবারেই নিষেধ।
একান্ত প্রয়োজন না পড়লে তিনিও বাড়ি থেকে বের হন না।
বিকেলে
নিয়মমত গরম জল দিয়ে গলা পরিস্কার করছিলেন রমিজ মেম্বার। জয়নাল মিয়াকে ছেলেসহ দেখে তিনি
খুব একটা খুশি হলেন না। ইশারায় বারান্দায় বসতে বলে তিনি আরও পাঁচ মিনিট ধরে বিশ্রী
শব্দ করে গড়গড় করতে লাগলেন। রাশেদের মনে হল তাদের আগমনকে এড়াতেই রমিজ মেম্বার ইচ্ছে
করে সময় ক্ষেপণ করছেন। তবে তার চোখদুটি আনমনেই এদিক সেদিক শিউলিকে খুঁজে বেড়াতে লাগলো।
গড়গড় শেষ করে হাত-মুখ মুছে রমিজ মেম্বার পাঞ্জাবির পকেট থেকে স্যানিটাইজ বের করে দুই
হাতে, গলায় ও দাঁড়িতে মাখলেন। চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ‘করোনার সময় এ বাড়ি সে বাড়ি
যাওয়া ঠিক না। সরকার থেকে নিষেধ আছে। খবরে তো রাতদিন তাই বলতেছে। আমি সরকারি মানুষ
নিজের বাড়িতে যদি এই নিয়ম পালন না করি তো মাইনসেরে কি কমু।‘
কথাটা
যে তাদেরকে খোঁচা দিয়ে বলা হচ্ছে সেটা পিতাপুত্রের বুঝার বাকি ছিল না। তিনি আরও যোগ
করলেন, ‘আমাদের মফস্বলেও করোনা আইসা পরছে, শুনছো তোমরা? অজপাড়াগ্রামে তো দিনপনের আগেই
ছড়াইছে। কাল রাতে শুনলাম বেপারী বাড়িতে দুইজনের নাকি হইছে। আরে মানুষ কথা শুনে না,
মাস্ক পরে না, সামাজিক দূরত্ব মানে না। প্রত্যেকদিন গ্রাম থেকে জনে জনে মানুষ আসে সরকারি
ত্রাণ আসছে কি-না জানতে। আরে ত্রাণ আসলে তো আমি নিজেই খরব দিব তাই না? কে কখন করোনা
আইনা আমার বাড়িতে ছড়াইবো কে জানে?’
রমিজ
উদ্দিন একটু থামলে জয়নাল মিয়া শুরু করলেন, ‘রাশেদ গতকাল ফিরছে’
‘এই
খবর আমি পাইছি’
‘হঠাৎ
ওর হোটেল বন্ধ হয়ে গেল। ‘
‘সেই
খবরও পাইছি’
‘আপনি
কথা দিয়েছিলেন রাশেদের সাথে শিউলির বিয়ে দেবেন। ‘
রমিজ
মেম্বার কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘তোমরা কি রেডিও টেলিভিশনের খবর দেখ না। পুরা দুনিয়ার
কি অবস্থা। মানুষ বাঁচে কি-না মরে। আর সরকার এই সময় সামাজিক সব ধরনের অনুষ্ঠান বন্ধ
ঘোষণা করছে, শুন নাই?’
জয়নাল
মিয়া অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘না মানে বিয়ে তো এখন নিতে বলছি না। ‘
‘তাইলে
এই আলোচনা এখন কেন?’
ঠিক
তখনই শিউলির মা বারান্দায় এলেন। জয়নাল মিয়া শিউলির মাকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘শিউলি মা কোথায়?’
‘ভেতরে’
বলেই শিউলির মা স্বামীর দিকে তাকালেন।
রমিজ
মেম্বার স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘শিউলিরে ডাক। বল জয়নাল চাচা আসছেন। আর শুন মাস্ক
পরে আসতে বলবা।‘ বলেই তিনি রাশেদকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন কি করবা? বাড়িঘর তো বন্ধক দিয়া
গেছিলা। ছাড়ান হইছে?’
‘না
চাচা’
রমিজ
মেম্বার তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, ‘তাইলে এখন তোমরা অন্যের বাড়িতে থাক। বাপেও চাকরি
ছাইড়া বাড়িতে বসা। চলবো কেমনে? তার মধ্যে আবার বিয়ার চিন্তা-ভাবনা করতেছো?’
রাশেদের
ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। এসব কথার অর্থ যে তার সংগে শিউলিকে বিয়ে না দেয়ার বার্তা
তা সে ঠিকই বুঝতে পারছিল। লজ্জায় অপমানে তার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।
জয়নাল
মিয়া পরিস্থিতি সামাল দিতে বললেন, ‘রাশেদ একটা ব্যাবসা করবে ভাবছে’
‘ব্যাবসা?
এই অবস্থায়? দুনিয়ার বড় বড় তাবেদার ব্যাবসায়িগো ব্যাবসা যখন লাটে উঠছে, তখন রাশেদ গ্রামে
ব্যাবসা করব? কি ব্যাবসা? তা দুবাই থেকে বড়সড় পুজি নিয়ে আসছ মনে হয় রাশেদ?’
এমন
সময় শিউলি এসে জয়নাল মিয়াকে সালাম করল। সাথে নিজের বাবাকেও। শিউলি আড়চোখে রাশেদকে দেখতে
চেষ্টা করতে লাগলো যেন সরাসরি রাশেদকে দেখা অন্যায়।
জয়নাল
মিয়া শিউলিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছ মা?’
‘জি
চাচা ভাল’
শিউলির
ইচ্ছে ছিল রাশেদকে নিজের ঘরে বসিয়ে দুচোখ ভোরে দেখে, ইচ্ছেমত গল্প করে। এই ছয়মাসে তার
কত গল্প জমা হয়ে আছে। কিন্তু তার বাবা তাকে ঘরে যেতে আদেশ দিলে সে ভেতরে চলে গেল। রাশেদ
শিউলির চলে যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। একঝলক শিউলিকে দেখে তার যেন পরাণ ভরল না।
রমিজ
উদ্দিন চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন, ‘সরকারি কর্মচারী, কত যে কাজ। আমার কি আর বসে বসে
গল্প করার সময় আছে? ‘
এর
পর আর সেখানে বসে থাকা যায় না। জয়নাল মিয়া ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চল বাড়ি যাই।‘
৬।
রাশেদের
মাথায় ঢুকছে না, বাবা কেন রমিজ চাচাকে ব্যাবসা শুরু করার কথা বলে এলেন। তাদের তো এমন
কোন কথা হয় নি। বাড়ি ফিরে রাশেদ জানতে চাইল, ‘বাবা চাচাকে ব্যাবসা করব বলে এলে যে?’
‘কিছু
তো করতেই হবে। এ-যে আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই। নইলে যে না খেয়ে মরতে হবে। পারবি না খেয়ে
মরতে?’ জয়নাল মিয়ার গলা ধরে এল। রাশেদ হকচকিয়ে গেল। যে বাবা তাকে এতটা সাহস যুগিয়েছেন
হঠাৎ সেই বাবা এতটাই ভেঙ্গে পরেছেন! বাবার কষ্ট, দুশ্চিন্তাগুলো যেন রাশেদের কাছে স্পষ্ট
হয়ে উঠল। রাশেদের নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতে লাগল। কিন্তু রাশেদ কি করবে? সে যে তেমন
কোন কাজও জানে না। এই মহামারীর মধ্যে কে-ই বা তাকে কাজ দিবে?
রাশেদ
সারারাত চিন্তা-ভাবনা করে সকালে বাবার ঘরে গিয়ে দেখল বাবা তখনও ঘুম থেকে উঠেননি। জয়নাল
মিয়া সারারাত এপাশ ওপাশ করে ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়েছেন। রাশেদ বাবাকে বিরক্ত করল না।
সকাল সকাল রাবেয়া উচ্চস্বরে পড়া মুখস্ত করছে, মা সকালের খাবারের আয়োজন করছেন। রাশেদ
রান্নাঘরে গিয়ে মাকে বলল, ‘আজ বাবা এখনও উঠে নি যে?’
‘তোর
বাবার কাল সারারাত ঘুম হয় নি।‘
রাশেদ
অনুতপ্তের সুরে বলল, ‘আমার জন্যই আজ এই অবস্থা ‘
‘তোর
জন্য হবে কেন? করোনা কি তুই এনেছিস নাকি? এই আপদ করোনার জন্যই তো তোদের চাকরি গেল।‘
একটু থেমে আবার বললেন, ‘তোর কি খিধে পেয়েছে? খেতে দিব?’
‘বাবা
উঠুক এক সাথে খাব ‘
খেতে
বসে রাশেদ বাবাকে বলল, ‘বাবা বাজার-হাট তো ঠিকমতো মিলছে না। আমরা যদি মানুষের বাড়ি
বাড়ি গিয়ে বাজার পৌঁছে দিতে পারি। কেমন হবে বল তো?’
‘বাজার
পৌঁছে দিবি মানে?’
‘মানে
হোম ডেলিভারী। যারা বাজারে যেতে পারছে না, করোনার ভয়ে বাইরে যাচ্ছে না। তাদের তো বাজার
সদাই দরকার, তাই না? ধরো আমি যদি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় বাজার-সদাই
পৌঁছে দেই?’
‘তুই
বাজার পাবি কোথায়? দোকান-পাট, বাজার সবই তো প্রায় বন্ধ’
‘হাঁ
বাবা এই সুযোগটাই তো ব্যাবহার করতে চাচ্ছি’
‘তা
কি করবি ভাবছিস?’
‘বাবা
দেখ, প্রথমত বাজার মিলছে না, দ্বিতীয়ত পাবলিক যানবাহন চলছে না বলে দরিদ্র কৃষকরাও তাদের
পণ্যগুলো বাজারে নিয়ে যেতে পারছে না। আমি যদি সেসব পণ্য কিনে এনে কিছু লাভে যাদের প্রয়োজন
তাদের বাড়ি বাড়ি বিক্রি করি?’
মা
বললেন, ‘তুই জিনিসপত্র মাথায় নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করবি, সে কি কথা? ‘
বাবা
বললেন, ‘ওকে বলতে দাও না শরিফা। ‘
‘নানা
তুই ওসব করতে পারবি না ‘
বাবা
অনেকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কিছু না করলে আর কিছুদিন পর না খেয়ে থাকতে হবে। তুমি তো
বাজার ঘরে পাও আর রান্না কর। এদিকে বাড়িটা যে বন্ধক দেয়া আছে সেদিকে খেয়াল আছে তোমার?
দুনিয়ার কোন খবর রাখ?’
শরিফা
চুপ হয়ে গেলেন। জয়নাল মিয়া ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কি যেন বলছিলি?’
রাশেদ
যেন বেশ উৎসাহ পেল। বলল, ‘যারা নিজেদের ক্ষেতে শাকসবজি চাষ করে আমরা তাদের কাছ থেকে
সেগুলো কিবে আনবো। সেগুলো ভাল করে ধুয়ে পরিস্কার করে যাদের প্রয়োজন তাদের বাড়িতে পৌঁছে
দিব।‘
রাবেয়া
বলল, ‘কার প্রয়োজন তুই তা জানবি কি করে ভাইয়া?’
‘শোন
গ্রামের অনেকের ফোন নম্বরই তো আমাদের আছে তাদের কাছে জিজ্ঞেস করব। আমাদের পণ্য ভাল
হলে কিছুদিন পর একজনের কাছ থেকে অন্যজন জেনে যাবে।’
বাবা
বললেন, ‘রাশেদ আমাদের বাড়ির সামনে যে রাস্তাটা আছে সেখানে ছোট টেবিল পেতে বসলে আমার
মনে হয় বিক্রি হতে পারে। ‘
মা
বললেন, ‘মানুষের বাড়িতে শাকসবজি কিভাবে পৌঁছে দিবি? মাথায় করে?’
বাবা
বললেন, ‘কেন মাথায় নিলে সমস্যাটা কি? শোন কোন কাজই ছোট নয়। মাথায় নিলে জাত যায় না।
খেটে খাওয়ার মধ্যে এক ধরনের তৃপ্তি আছে।‘
রাশেদ
আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, ‘বাবা আমার আইডিয়াটা কেমন?’
বাবা
ধরা গলায় বললেন, ‘আজ তোকে নিয়ে আমার গর্ব হচ্ছে। শুরু কর। আমরা সবাই তোর সাথে আছি।‘
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কি শরিফা ছেলের সাথে থাকবে না?’
রাবেয়া
বলল, ‘ভাইয়া আমি তোর সাথে আছি।‘
শরিফা
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আমার দোয়া সব সময় তোদের সাথে আছে।‘
শিউলির
জন্য মনটা খারাপ থাকলেও সামনে ভবিষ্যতের জন্য নতুন কিছু একটা করতে যাচ্ছে এবং সেই কাজে
পরিবারের সবার সম্মতি আছে ভেবে রাশেদের মধ্যে এক ধরনের ভাললাগা কাজ করতে লাগলো।
৭।
সকালের
খাবার খেয়েই রাশেদ আর বাবা পায়ে হেঁটে চলে গেলেন দূরের কয়েকটি গ্রামে। বেশ কয়েকজন কৃষকের
সাথে কথা বলে তাদের উৎপাদিত শাক-সবজি কেনার ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে আলাপ আলোচনা
হয়ে গেল। কৃষকদের কাছ থেকে এত ভাল সাড়া পাবে তা রাশেদ কিংবা জয়নাল মিয়া আশাই করেন নি।
তবে একটা সমস্যা দেখা দিল। পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূর থেকে পরিবাহন ছাড়া সেসব পণ্য আনা
সম্ভব নয়।
তবে
সমস্যাটা খুব বেশি স্থায়ী হল না। কেননা মানুষ যখন মন থেকে কোন ভাল উদ্যোগ গ্রহণ করে
এবং সেটা সার্বজনীন কল্যাণের জন্য হয় তখন সেই কাজটা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা দেখভালের দায়িত্ব
নেন। পাশের বাড়ির খলিল চাচার ভ্যানটা পাওয়া গেল। খলিল চাচা ভ্যানে করে কাঠ বহন করতেন।
করোনার কারনে খলিল চাচার কাজ বন্ধ তাই ভ্যানটি পরিত্যাক্ত অবস্থায় ছিল। রাশেদ খলিল
চাচার ভ্যানটিকে দিনে পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে ভাড়া নিয়ে পরের দিন সকালে চলে গেল দূরের
গ্রামে শাক-সবজি সংগ্রহ করতে।
শুরু
হল রাশেদের নতুন এক জীবন সংগ্রাম। রাশেদ খুব ভোরে ভ্যানে করে নিয়ে আসে ক্ষেতের টাটকা
শাকসবজি। মা আর রাবেয়া সেগুলো ধুয়ে পরিস্কার করে দেয়, বাবা শাকগুলোকে আটি বাঁধেন। রাশেদ
পরিচিতদের ফোন করে অর্ডার নেয়। এরপর অর্ডারকৃত পণ্য ভ্যানে সাজিয়ে ছুটে চলে ডেলিভারী
দিতে। বাড়তি কিছু পণ্য রাশেদ নিয়ে যায় যাদের অর্ডার আছে তাদের আশেপাশের বাড়িগুলোতে।
সেগুলোও বিক্রি হয়ে যায় সব। জয়নাল মিয়াও ছোট একটা টেবিলে পসরা সাজিয়ে বসেন রাস্তার
পাশে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রাশেদের এই কাঁচাবাজার ডেলিভারীর কথা ছড়িয়ে পরতে শুরু
করে। আশেপাশের গ্রামগুলো থেকেও অনেক অনেক অর্ডার আসতে শুরু করে। রাশেদ আরও দুরের কৃষকদের
কাছ থেকে আরও বেশি বেশি পণ্য আনতে শুরু করে। দেখা গেল অর্ডারকৃত পণ্য ডেলিভারী দেয়া
রাশেদের একার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এবার রাশেদ খলিল চাচাকে সাথে নিল। লাভের টাকায়
রাশেদ একটা ভ্যান কিনে ফেলল। রাশেদ এবং খলিল চাচা দুজনে দুটি ভ্যান নিয়ে ছুটে চলে বিভিন্ন
গ্রামে পণ্য কিনতে আর ডেলিভারী দিতে। দিনদিন
রাশেদের ব্যাবসার বেশ উন্নতি হতে থাকল। এদিকে লকডাউনের মধ্যে খলিল চাচারও একটা কর্মসংস্থান
হয়ে গেল।
রাশেদকে
আর ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজেরা স্বচ্ছলভাবে খেতে পরতে পারছে। দিনশেষে হাতে কিছু টাকা
থাকছে। সেটা জমিয়ে বাড়িবন্ধকের কিস্তি দিচ্ছে। এভাবেই কাটে গেল প্রায় ছয় মাস।
৮।
লকডাউন
আস্তে আস্তে শিথিল করে দেয়া হল। শর্তসাপেক্ষে বিয়ে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের
অনুমতি মিলছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকদিন শিউলি লুকিয়ে লুকিয়ে রাশেদের সঙ্গে দেখা করে গেছে।
রমিজ মেম্বার বাড়ি না থাকলে শিউলি এই সুযোগটা নেয়। দুজনে একান্তে কথা বলে আর রাবেয়া
প্রহরীর দায়িত্বে থাকে।
একদিন
হঠাৎ জানা গেল শিউলির বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে। পাত্র ঢাকার স্থানীয়। নামী এক ব্যাঙ্কে
চাকরি করেন। রমিজ মেম্বার সব জায়গায় গর্ব করে বলে বেড়াতে লাগলেন, ‘এমন পাত্র হাজারে
একটা মিলে, পুরাণ ঢাকায় নিজেদের আলিশান বাড়ি। শিউলি মা আমার কপাল নিয়ে জন্ম নিয়েছিল
বলতে হবে।‘ এসব কথা রাশেদের কানেও যায়। রাশেদ আর শিউলি ভেবেছিল রাশেদের যেহেতু একটা
কাজের ব্যাবস্থা হয়েছে তাই রমিজ মেম্বার বিয়েতে আর অমত করবেন না। সে আশাতেই রাশেদ মনপ্রান
দিয়ে ব্যাবসাটা করে যাচ্ছিল।
সেদিন
সন্ধ্যায় শিউলি কাউকে কিছু না বলে রাশেদের বাড়ি এসে হাজির। আর কোনদিন সে বাড়ি ফিরে
যাবে না বলে গোঁ ধরে বসে রইল। রাশেদ কিংবা বাবা কেউই বাড়ি নেই। রাশেদের মা কি করবেন
বুঝে উঠতে পারছেন না। তবে বিষয়টা জানাজানি হলে যে একটা কেলেঙ্কারি হবে সেটি তিনি আন্দাজ
করতে পারছেন। বারবার তিনি শিউলিকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। এদিকে রাবেয়া
বাবা আর রাশেদকে ফোন করে বাড়ি ফেরার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে। রাশেদ যখন বাড়ি ফিরল তখন সন্ধ্যা
বয়ে গেছে। রাশেদকে দেখেই শিউলি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি আর বাড়ি ফিরে যাব না।‘
রাশেদ
শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘তোমার বাবার অমতে তোমাকে বিয়ে করে এই গ্রামে কি থাকা যাবে বল?’
‘চল
আমরা অন্য কোথাও চলে যাই’
‘শিউলি
তুমি তো জান আমাদের অবস্থা, বাড়ি বন্ধকের পুরো টাকা এখনও শোধ হয় নি। ব্যাবসাটা মাত্র
দাঁড়াতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় আমি সবাইকে ফেলে কি করে শুধু নিজের কথা ভাববো? আমার যে অনেক দায়িত্ব।‘
‘আর
আমার প্রতি তোমার কোন দায়িত্ব নেই?’
‘আমি
তো বসে নেই। চেষ্টা তো করছি। তোমার বাবা আমার সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য দুই বছর অপেক্ষা
করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। শিউলি তুমি যেভাবে পার তোমার বাবাকে বল আমাকে আর কিছু দিন
সময় দিতে। আমি ঠিকই সব ঋণ শোধ করে বাড়ি ছাড়িয়ে আনব।‘
‘তোমার
জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারব কিন্তু বাবাকে কিছুতেই আমি রাজী করাতে পারব না।
মা আর আমি বাবাকে অনেক বুঝাতে চেষ্টা করেছি। কোন লাভ নেই। আমার অমতেই তিনি বিয়ে ঠিক
করে ফেলেছেন।‘
এদের
কথার কোন অগ্রগতি হয়না আর সমস্যারও সমাধান হয় না। শিউলি কাঁদতে থাকে শব্দ করে আর রাশেদের
দুই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে নিঃশব্দে।
তখনই
রমিজ মেম্বার সেখানে এসে হাজির হলেন। কোন কথা না বলে মেয়ের গালে ঠাসঠাস করে দুইটা চড়
বসিয়ে দিলেন। মেয়ের হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির রাস্তা ধরলেন। যা ঘটে গেল তা যেন পাঁচকান
না হয় সে ব্যাপারে রাশেদের পরিবারকে শাসিয়ে গেলেন।
৯।
পরেরদিন
সকালে জয়নাল মিয়া শিউলির বাবার সাথে দেখা করতে গেলেন। রমিজ মেম্বার বাড়িতে অবস্থান
করা সত্ত্বেও জয়নাল মিয়ার সাথে দেখা করলেন না। এক বুক হতাশা নিয়ে জয়নাল মিয়া ফিরে এলেন।
ছেলেটার জন্য তার খুব কষ্ট হতে লাগল। পরিবারের আর্থিক সংকট দূর করার জন্য সারাদিন অক্লান্ত
পরিশ্রম করে ছেলেটা অথচ তিনি ছেলের পছন্দের মেয়েকে ঘরে আনতে পারছেন না।
দিন
সাতেক পরেই খুব ধুমধামে শিউলির বিয়ে হয়ে গেল। রাশেদ প্রচণ্ড আঘাত পেলেও কাউকে বুঝতে
দিল না। বিয়ের আগের রাতে রাশেদ বালিশে মুখগুজে সারারাত কেঁদেছে আর নিজেকে মিথ্যে সান্তনা
দিয়েছে। তবে বিয়ের দিন খুব ভোরে রাশেদ যথারীতি কাজে গেল এবং কাজ থেকে ফিরল। বাড়ির সবাই
মন খারাপ করে রইল কিন্তু রাশেদ সেদিকে খেয়ালও করল না। রাশেদ কষ্ট পেলেও ভেঙ্গে পরল
না। সে আরও উদ্যমের সাথে তার ব্যাবসাটাকে সামনে নিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল। শিউলির
বিয়ের পরদিন রাশেদ মিস্ত্রি ডেকে বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে বাবার সবজির টেবিলটা সরিয়ে
চালা দিয়ে বেশ বড়সড় একটা স্থায়ী ছাওনি বানিয়ে ফেলল। ছাওনির উপর একটা নাম দেয়া বোর্ডও
টাঙ্গান হল। ‘বাবা-মায়ের দোয়া স্টোর’ ।
এভাবে
কেটে গেল আরও দেড় বছর। গত দুই বছরে রাশেদের ব্যাবসা আরও প্রসারিত হয়েছে। এখন শুধু শাক
সবজির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, চালডাল, আলু, পেঁয়াজ, আদা-রসুন নিত্যপণ্য আরও অনেক কিছু
যুক্ত হয়েছে। এরই মধ্যে রাশেদ ভ্যান কিনেছে পাঁচটি, সেগুলো চালানোর জন্য পাঁচজন কর্মীও
রাখা হয়েছে। বাবার দোকানেও দুইজন কর্মী। বাবা আর রাশেদ এখন শুধু অর্ডার নেয়া আর হিসাব
রাখার কাজ করেন। বাড়ি বন্ধকের টাকা প্রায় শোধ
করা হয়েছে। রাশেদের সাফল্য দেখে বাবা-মা ছেলেকে বিয়ে দেয়ার ইচ্ছে পোষণ করেন। কিন্তু
রাশেদ নাছোড়বান্ধা, বিয়ে এখন সে করবে না। এদিকে রাশেদ রাজি না হওয়ায় মা অভিমান করে রইলেন। শেষে রাজি না হয়ে রাশেদের আর কোন
উপায় রইল না।
অনেক
জায়গায় দেখাদেখির পর পাশের গ্রামের ববিতাকে মায়ের পছন্দ হল। মেয়ে পছন্দের ব্যাপারে
রাশেদের কোন মতামত নেই। বাবা-মায়ের পছন্দই তার পছন্দ। মা সব ঠিক করে রাশেদকে একদিন
মেয়ে দেখতে পাঠালেন। রাশেদ মায়ের কথামত মেয়ে দেখতে গেল। দুজনকে আলাদা কথা বলতে দিলে
রাশেদ শুধু বলল, ‘আমার বাবা-মা আর বোনকে নিজের বাবা-মা, বোনের মত ভালবাসতে পারবেন?’
ববিতা
মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইঙ্গিত দিল। রাশেদের আর কোন কথা নেই। বাবা-মা-বোনই সব স্থির করে
ফেললেন। আগামী ১২ই জুলাই (২০২২) রাশেদ আর ববিতার বিয়ে। মাত্র বিশ দিন বাকি। মা আর রাবেয়া
বিয়ের কেনাকাটা নিয়ে মহাব্যাস্ত। দুইদিন ঢাকা গেল কেনাকাটা করতে। মায়ের জোরাজুরিতে
রাশেদকেও কাজকর্ম ফেলে যেতে হল তাদের সাথে।
আর স্থানীয় বাজারে তো প্রায় প্রতিদিনই কেনাকাটা হচ্ছে। মা আর রাবেয়ার উৎসাহ ছোটাছুটি
দেখে রাশেদ আর তার বাবা হাসেন।
প্রথম
দিকে করোনা যে তাণ্ডব চালিয়েছিল সেই তাণ্ডব আর নেই। স্কুল-কলেজ, ব্যাবসা বাণিজ্য, যানবাহন,
ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদি সবকিছুই এখন স্বাভাবিক গতিতে চলছে। তবে প্রতিদিনই কোথাও
না কোথাও দু-একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। তবে সেগুলো কেউ আর গুনায় ধরে না।
একদিন
রাতে খেতে বসে রাশেদের বাবা জানালেন, শিউলির স্বামীর করোনা হয়েছে এবং শ্বাসকষ্ট নিয়ে
তিনি রাজধানীর খুব বড় এক হাসপাতালে ভর্তি।
মা
বললেন, ‘বড়লোকের অসুখ করলে তো বড় হাসপাতালেই ভর্তি হবে।‘
রাশেদ
মাথা নিচু করে খেতে লাগল। মা আর রাবেয়া কিছুক্ষন চুপ করে থেকে পুনরায় রাশেদের বিয়ের
আলাপ শুরু করলেন।
১০।
আজ
রাশেদের বিয়ে। রাশেদ খুব ভোরে উঠে গোসল করে পাঞ্জাবী-পাজামা পরে প্রস্তুত। বাবাও প্রস্তুত।
মা এটা-সেটা নিয়ে ব্যাস্ত তবে রাবেয়া এখনও সাজগোজ করেই চলছে। মোট একশো জন বরযাত্রী।
খলিল চাচাসহ বরযাত্রীদের অনেকেই এখনো এসে পৌঁছায় নি। সবাই এলে একসাথে রওনা হবে বলে
অপেক্ষা চলছে।
রাশেদ
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে লাগলো। তার বুকটা ধকধক করছে। এই মুহূর্তে শিউলির
কথা তার খুব মনে পড়ছে। তখনই রাশেদ চোখ বন্ধ করে সিদ্ধান্ত নিল সে পুরানো সব স্মৃতি
ভুলে গিয়ে শুধু ববিতাকেই ভালবাসবে। দুজন মিলে খুব সুন্দর একটা পরিবার গঠন করবে। শিউলি
তার স্বামী নিয়ে সুখে ঘর করুক। সেও ববিতাকে ভালবেসে সুখি করবে।
তখনই
বাইরে খলিল চাচার কণ্ঠ শোনা গেল। সাথে সাথে বাইরে কি একটা শোরগোল পরে গেল যেন সবাই
একসাথে কথা বলছে। কারও কোন কথাই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। বিষয়টা কি জানার জন্য রাশেদ
বাইরে বেরিয়ে এলো।
এত
শোরগোলের মধ্যে জয়নাল মিয়া ছেলের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, ‘আজ ভোরে শিউলির স্বামী
মারা গেছেন।‘
আরও গল্প পরতে ক্লিক করুন
No comments