বৌভাতের রাত
বৌভাতের রাত |
রাত তখন দুটো। বৌভাতের ঝামেলা
শেষ করে তুহিন সবে মাত্র নতুন বৌ নিয়ে বিছানায় গিয়ে বাতি বন্ধ করেছে, ঠিক তখনই দরজায়
কড়া নাড়ার শব্দ হল। তুহিনের বউ কনা বিস্ময়ের সাথে তুহিনের দিকে তাকাল। তুহিনের চোখেমুখে
রাগের বহিঃপ্রকাশ। কনা জিজ্ঞেস করল, ‘এত রাতে কে?’
তুহিন নিঃশ্বাস ছেড়ে উত্তর
দিল, ‘মনে হয় মা।‘
মা! ‘এত রাতে?’
এদিকে দরজার কড়া নড়েই চলছে।
তুহিন লঙ্গি ঠিক করে বেঁধে বাতি জ্বালাল। কনাও বিছানায় উঠে বসে গায়ের কাপড় ঠিক করতে লাগল।
‘তুহিন দরজাটা খোল!‘
তুহিন রাগ করে এক ঝাঁটকায় দরজা
খুলে বলল, ‘কি হয়েছে?’
মা বিছানার দিকে উঁকি দিয়ে
বলল, ‘বৌমা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?’
মা ঘরের ভেতরে ঢুকতে চাইছে
বুঝতে পেরে তুহিন দরজার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই কপাটে দুই হাত রেখে দাঁড়াল। মা জোরে
জোরে ডাকতে লাগল, ‘বৌমা ঘুমিয়ে পড়েছ?’
‘হ্যাঁ মা ও ঘুমিয়ে পড়েছে।
তুমি এত রাতে?’
মা-য়ের হাতে একটা খাতা আর কলম।
তিনি তুহিনকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে বললেন, ‘সর দেখি, ভেতরে গিয়ে বলি। দেয়ালেরও কান আছে‘
বলেই তিনি ঘরের ভেতরে ঢুকে পরলেন।
‘হ্যাঁ, বিয়ে করলি একদিনও হল
না মায়ের সাথে মিথ্যে কথা বললি! কই বৌমা তো ঘুমায়নি জেগেই আছ’ বলেই তিনি কনার বাপের
বাড়ি থেকে আনা কাঠের আলমারিটি ঘষে ঘষে দেখতে লাগলেন।
‘এটা কি কাঠের? ‘
কেউ কোন জবাব দিল না। মা কনাকে
উদ্দেশ্য করে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি কাঠ দিয়ে এটা বানাইছে?’
কনা স্বামীর দিকে তাকিয়ে নিচু
স্বরে বলল, ‘আমি জানি না মা।‘
‘খুব একটা মজবুদ মনে হচ্ছে
না। সামনের ডিজাইনতাও পুরানা আমলের।‘
এরপর তিনি ড্রেসিং টেবিলের
ড্রয়ারগুল খুলে খুলে দেখতে লাগলেন। বললেন, ‘আয়নাটা বেশি বড় বড় লাগছে।,
আয়নায় নিজের চেহারাটা ঘুড়িয়ে
ফিরিয়ে দেখে বললেন, ‘কাঁচটাও একটু ঘোলা ঘোলা লাগছে।‘
তুহিনের রাগ এবার চরম মাত্রায়,
সে কোন রকম রাগ চেপে বলল, ‘মা কাল সকালে এসে তুমি এসব দেখো। সারাদিন ঝামেলার মধ্যে
কেটেছে, খুব ক্লান্ত লাগছে। ‘
‘বিয়ের সময় সবাই ক্লান্ত থাকে।
বিয়ের ঝামেলায় আমাদেরও কি ঘুম হয়েছে?‘ বলতে বলতে তিনি ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা স্টুলে
বসে পড়লেন।
‘শোন যার জন্য আসা। ‘
তুহিন একদম চুপ। মা বললেন,
‘তোর বন্ধুরা আর আত্মীয়-স্বজনের অনেকে তো তোকে খামে করে টাকা দিয়েছে। একবার নিয়ে আয়
তো?’
‘এখন? এই রাত দুটোয়?’
‘বাড়িতে অনেক বাইরের মেহমান
আছে। কে কেমন বলা তো যায় না।‘
‘মা কাল সকালে দিবনে।‘
মা তুহিনের কথার কোন উত্তর
না দিয়ে বলতে থাকেন, ‘বিয়ের জন্য যা বাজেট ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ হয়ে গেছে। অনেক কিছুর বিল
এখনও দেয়া হয় নি।‘
কনা হা করে তুহিনের দিকে তাকিয়ে
রইল। তুহিন বুঝল মা বিয়ের উপহার পাওয়া খামগুলো না নিয়ে যাবেন না। তুহিন আলনায় ঝুলিয়ে
রাখা কোর্ট আর প্যান্টের পকেট থেকে বেশ কতগুলো খাম বের করে মায়ের হাতে দিল।
মা বললেন, ‘কোর্টের ভেতরে যে
শার্টটা পরেছিলি ওখানে একটু দেখ।‘
তুহিন শার্ট-এর পকেট নেড়েচেরে
বলল, ‘আর নেই।‘
‘ভাল করে দেখ।‘
‘নেই বললাম তো!‘
মা এবার হাতে রাখা খাতা আর
কলমের মাথা খুলে কি জানি লেখার জন্য প্রস্তুতি নিলেন।
তুহিন আর কনা একে অপরের দিকে
অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইল।
মা একটা খাম হাতে নিয়ে পড়তে
লাগলেন, জনাব রিফাত মোল্লা। খাম খুলে টাকা বের করে দেখলেন এক হাজার টাকা। তিনি সামনে
থাকা খাতায় চোখ বুলিয়ে কি জানি খুঁজতে লাগলেন। বললেন, ‘পাওয়া গেছে রিফাত মোল্লা। গতবছর
তার মেয়ের বিয়েতে দিয়েছিলাম ১৫’শ।‘
মা তুহিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘দেখেছিস! গতছর আমরা তার মেয়ের বিয়েতে ৪ জন খেয়ে ১৫;শ টাকা দিয়েছিলাম আর উনি ৫ জন নিয়ে
খেয়ে গেলেন মাত্র ১ হজার টাকা দিয়ে? মানুষের আক্কলজ্ঞান বলে কিছু নাই।‘
এরপর তিনি খাতায় লিখলেন রিফাত
মোল্লা দিয়েছেন ১ হাজার টাকা। পরের খাম হাতে নিয়ে পড়লেন, আকবর আলী। আকবর আলীর ছেলের
বিয়েতে আমরা দিয়েছিলাম ১ হাজার টাকা। দেখি উনার আক্কেলজ্ঞান কেমন বলেই টাকা বের করলেন।
অবাক হয়ে বললেন দুই হাজার টাকা!
তুহিন লোকটা খুবই জ্ঞানী। গতবছর
১ হাজার টাকায় যা পাইছি এই বছর কি আর তা পাওয়া যাবে? এসব মানুষকেই বলে জ্ঞানওয়ালা মানুষ।
কত বিবেচনা।
এই কথার মাঝখানেই মায়ের চোখে-মুখে
ছায়া নেমে আসে। একা একাই বলতে থাকেন, দেখছস কেমন চালাক মানুষ? জ্ঞানওয়ালা না ছাই! আমি
তো ভুলেই গেছিলাম আগামি মাসে আকবর আলীর মেয়ের বিয়ে। দুই হাজার টাকা দিল যেমন আমরাও
তার মেয়ের বিয়েতে দুই হাজার টাকা দেই। কি চালাক। এই টাকা তারেই ফেরত দিতে হবে।
দূর দূর……………।।
এভাবেই মা একটা একটা করে খাম
খুলে বিস্তারিত লিখতে থাকেন। কনা ঘুম জড়ানো চোখে ঝুমতে থাকে আর তুহিন মায়ের দিকে কটমট
করে তাকিয়েই থাকে। আর মা নিষ্ঠার সাথে হিসেব
করতে থাকেন যেন কোন ভুল না হয়।
আরও গল্প পড়তে ক্লিক করুন
No comments