শ্রমদান, মানুষের সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে
শ্রমদান |
আমরা
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় পাহাড়ের চূড়ায় বড়বড় স্থাপনা দেখতে পাই। এসব স্থাপনা দেখলে
সবার আগে যে প্রশ্নটি মনে আসে তা হচ্ছে, হায়রে! এত্ত উপরে কিভাবে ইট-বালি-সিমেন্ট উঠানো
হল? প্রশ্নটা কমন। বড়বড় উন্নত দেশে কাঁচামাল উপরে তোলার ডিজিটাল যন্ত্রপাতি নিশ্চয়ই
আছে।
তবে
আজ আমি আমার দেখা প্রাচীন এক পদ্ধতির গল্প শোনাবো। একবিংশ শতাব্দিতে এসে প্রযুক্তির
ব্যাপক উন্নয়নের এই যুগে মানুষ এখনও কেন এবং কিভাবে প্রাচীন পদ্ধতি অনুসরণ করে তার
বিস্তারিত থাকছে আমার আজকের অভিজ্ঞতার আসরে।
প্রাকৃতিক
সৌন্দর্যের লীলাভূমি শ্রীলঙ্কা ছোটবড় পাহাড়ে পরিবেষ্টিত। শ্রীলঙ্কায় এমন কোন পাহাড়
পাওয়া যাবে না যার চূড়ায় একটা বৌদ্ধ মন্দির কিংবা লর্ড বুদ্ধার প্রতিমূর্তি নেই। হাজার
হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর কারুকার্য সম্বলিত বিশাল আকারের মনোরম স্থাপনাগুলো যে কারো নজর
কাড়ে।
কিন্তু
জেনে অবাক হবেন এসব প্রতিমূর্তি স্থাপন করতে এবং মন্দির নির্মাণ করতে দেশটির সাধারণ
নাগরিকগণ শুধুমাত্র আর্থিক সহযোগিতাই করে না, দিয়ে থাকে শারীরিক শ্রম।
বিষয়টা
একটু খুলেই বলি। বিশাল এসব স্থাপত্য নির্মাণ করতে প্রশিক্ষিত নির্মাণ কারিগর তো থাকবেই।
তবে ভূপৃষ্ঠ থেকে পর্বত চূড়ায় মালামাল পৌঁছে দেয়ার কাজগুলো করে আপনার আমার মত লাখ লাখ
সাধারন মানুষ বিনা পারিশ্রমিকে। এখানে গরীব-ধনী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, জাত-পাতের কোন বালাই
নেই। সবাই হাতে হাতে কাঁচামাল পৌঁছে দিচ্ছে উপরে। এতো মানুষ একসাথে সারিবদ্ধ হয়ে কাজ করে যে উচ্চতা সেখানে গৌণ বিষয়। এ সব কাজের জন্য কাউকে ডাকতে হায় না।
মানুষ নিজের গরজে সদিচ্ছায় সামিল হয়। যখন স্থাপনাটি দৃশ্যম হয় দুর-দুরান্ত থেকে এসব মানুষই গর্বের সাথে বলেন ওই স্থাপনা নির্মাণের সাথে আমি জড়িত ছিলাম। কেউ একদিন, কেউ দুইদিন,
কেউ তিনদিন কেউ বা যতদিন কাজ চলে ততদিনই শ্রম দিয়ে থাকে।
এই
যে বিনা পারিশ্রমিকে মানুষ কাজ করে একে শ্রীলঙ্কার ভাষায় বলে শ্রমদান। এই শ্রমদান সাধারনত
ধর্মীয় এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে হয়ে থাকে।
এবার
বলি কারা দেন শ্রমদান অর্থাৎ কারা করেন বিনা পারিশ্রমিকে কাজ। আমাদের সমাজে কিছুকিছু
মানুষ আছে যারা ধর্মীয় বা যে কোন সমাজ সেবামূলক কাজে সর্বাগ্রে এগিয়ে থাকেন। এদের কথা
আলাদা তবে বেশির ভাগ মানুষ এসব কাজে সামিল হয় নিজেদের অপূর্ণ মনস্কামনা ও প্রতিশ্রুতি
পূরণ করতে।
শ্রমদান |
ধরুন
কোন দম্পতির সন্তান হচ্ছে না, সেক্ষেত্রে একটি সন্তান লাভের আশায় স্বামী-স্ত্রী দুজনে
নিকটবর্তী কোন ধর্মীয় বা সামাজিক নির্মাণকাজে শ্রমদান করেন। আবার কেউ চাকরির আশায়,
কেউ পরীক্ষায় পাসের আশায়, কেউ বা কঠিন কোন রোগমুক্তির আশায়। এখানকার মানুষের বিশ্বাস,
কোন দুষ্প্রাপ্য বস্তু লাভের আশায় ধর্মীয় ও সামাজিক কাজে সেচ্ছায় শ্রমদান করলে তাদের মনোবাসনা পূর্ণ হবে। আবার কারো মনস্কামনা পূর্ণ হলেও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতাস্বরুপ তারা শ্রমদান
করেন। কেউ কেউ আছেন বাসনা পূরণ হয়েছে বলে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সারাজীবনই শ্রমদান করে
থাকেন। দেশের যে কোন প্রান্তে যতদুরই হক না কেন প্রতিটি বৃহৎ ও মহৎ কাজে তারা সামিল
হন, নিজেদের যুক্ত করেন।
শ্রমদানের
এই প্রাচীন চর্চাটি বর্তমান যুগে হয়ে উঠতে পারে এক অনবদ্য অনুকরণীয় উদাহরণ। শ্রমদানের
এই ধারণা বা চর্চা যে কোন মহৎ কাজকে শুধু সাশ্রয়ীই করে না মানুষের সামাজিক বন্ধনকে
আরও সুদৃঢ় করে। একে অপরকে জানতে, বুঝতে সহায়তা করে। মানুষে মানুষের দূরত্ব কমিয়ে সবাইকে
একতাবদ্ধ করে।
এ ধরনের লেখা আরও পড়তে ক্লিক করুন উদুয়াপ পয়া
No comments