বড়দিনের উপহার
বড়দিনের উপহার |
পাশের গ্রামের ছেলে লেনাড©। ছুটিতে বাড়ী এলে সুজান্নার বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে আসে আবার ছুটি শেষ হলে ঢাকায় যাওয়ার আগেও দেখা করে যায়। কি আদব-কায়দা ছেলেটির! পিটার আর মনিকা মনে মনে ঠিকই বুঝতে পারে লেনাড© শুধুশুধু তাদের বাড়ীতে আসে না, আসে এক পলক সুজান্নাকে দেখতে। লেনাডে©র সাথে সুজান্নার সম্পক© নিয়ে পিটার আর মনিকার তেমন কোন আপত্তি নেই। ছেলেমেয়ে দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক। এই বয়সে একে অপরকে পছন্দ করবে, ভালবাসবে এটাই স্বাভাবিক।
লেনাড© ছেলে হিসেবে খুবই ভাল, নম্র-ভদ্র, মিশুক, দেখতে-শুনতে কোন দিক থেকেই কমতি নেই। আশেপাশের সাত গ্রামের মানুষ লেনাড©কে নিয়ে গব© করে। সে দেশের সেনা বাহিনীতে কাজ করে, দেশের জন্য কাজ করে, গব© করার মতোই ছেলে।
পিটার আর মনিকার একমাত্র মেয়ে সুজান্না। রুপে-গুণে লেখাপড়ায় এক কথায় অসাধারণ। মনিকা প্রথম সুজান্না আর লেনাডে©র সম্পকে©র বিষয়টি আuচ করতে পারেন। স্বামীকে জানালে তিনিও আপত্তি করেন নি। তবে লেনাড© আর সুজান্নার প্রেম যে মনে মনে এতদূর গড়িয়েছে তা কে জানতো! মা-বাবার চোখের আড়ালে যে সুজান্না প্রায়ই লেনাডে©র বাহুতে মাথা রেখে সুখের নীড় গড়ার স্বপ্ন দেখে, মনে মনে কত নদী-পাহাড়, বন-মরুভূমি পাড়ি দিয়ে আসে সবার অলক্ষ্যে তা সরারই অজানাই ছিল।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে লেনাড© ছুটিতে বাড়ী এলে সুজান্নাকে জানালো, সে আফ্রিকার মালিতে শান্তি রক্ষী বাহিনীতে যোগ দিতে যাচ্ছে। সুজান্নার বুকটা কেuপে উঠলো, Òমানে সেখানে তো শুনেছি যুদ্ধ হয়!Ó
Òহ্যাu সেখানেই আমাকে যেতে হবে।Ó
Òনা তুমি যাবে না।Ó
Òভয় পেয়ো না সুজান্না । মাত্র তো এক বছরের জন্য।Ó
Òএক বছর আমি তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো?Ó
Òদেখতে দেখতে চলে যাবে।Ó
সুজান্না লেনাডে©র বুকে মাথা রেখে অঝোরে কাuদতে থাকে। মে মাসে লেনাড© বাংলাদেশের আরো নয়জন সেনা সদস্যের সাথে আফ্রিকার মালিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে যোগ দিল। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে হামলা-সংঘষ© লেগেই থাকে। এরই মধ্যে লেনাডে©র হৃদয় জুরে থাকে সুজান্নাকে নিয়ে বোনা হাজারো স্বপ্ন। প্রত্যেকদিন সময় না পেলেও দুই একদিন পরপরই সুজান্নাকে ফোন করে লেনাড©। সুজান্নাও লেনাডে©র ফিরে আসার দিন গুনতে থাকে।
না, সুজান্নাকে ছেড়ে লেনাড© বেশীদিন থাকতে পারলো না। আগষ্ট মাসে পঞ্চাশ দিনের ছুটি নিয়ে দেশে আসে লেনাড©। লেনাড©কে ফিরে পেয়ে সুজান্নার তপ্ত মনের মরুভুমিতে যেন বসন্তের ছোuয়া লেগে ফুল ফুটে, বাuশি বাজে, পাখি গান গায়। যে কয়েকদিন লেনাড© বাড়িতে ছিল প্রায় প্রতিদিনই দুÕজন সবার চোখ ফাuকি দিয়ে ভালবাসার গল্প রচনা করে চলে।
সেদিন ছিল সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ। পরের দিন লেনাডে©র আফ্রিকার মালিতে ফিরে যাওয়র দিন। সুজান্নার বাবা-মা কেউই বাড়িতে ছিলেন না। লেনাড© এলো সুজান্নার কাছ থেকে বিদায় নিতে। কিন্তু সুজান্না নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। কান্নায় আছড়ে পড়লো লেনাডে© বুকে।
Òসুজান্না তুমি এভাবে কাuদলে যে আমি দুর্বল হয়ে পড়বো। মাত্র তো আর কয়েকটা দিন। আগামী মে মাসে আমি ফিরে এসে তোমাকে বউ করে ঘরে তুলবো। এখন তোমাকে বিয়ে করতে আমার কোন অসুবিধা নেই। আমার বয়স চব্বিশ পেরিয়ে গেছে আর চাকরির মেয়াদও ছয় বছর হয়ে গেছে।Ó
Òকিন্তু এত যুদ্ধসংকটময় একটি দেশে তুমি জীবনের ঝুuকি নিয়ে থাক আমার যে খুব ভয় হয়।Ó
Òভয় পেও না। তোমার সত্যিকারের ভালবাসা আমাকে তোমার কাছে আবার ফিরিয়ে আনবে।Ó
দুজনেরই মন খারাপ। এই মন খারাপের মধ্যেই সুজান্না আর লেনাড© একে অপরের আরো কাছে চলে আসে। ভেসে যায় ভালোবাসার স্রোতে।
চোখের জলে ভেসে লেনাড© বিদায় নেয় সুজান্নর কাছ থেকে। সুজান্না অপেক্ষায় থাকে মে মাসে লেনাড© ফিরে এসে তাকে বউ করে ঘরে তুলবে। সে হবে লেনাডে©র আপনজন চিরদিনের জন্য।
সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখ থেকে লেনাডে©র ফোন বন্ধ। ২৪ তারিখ অপেক্ষা করে ২৫ তারিখে সুজান্না লেনাড©কে ফোন করে। না কোন উত্তর নেই। ফোন বন্ধ। অস্থির হয়ে পরে সুজান্না। হঠাৎ টিভিতে খবর দেখতে পায়-
গত ২৪শে সেপ্টেম্বর পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে রাস্তার পাশে পুতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে চারজন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো চার জন। নিহত চারজনের মধ্যে একজন লেনাড© রোজারিও।
দিশেহারা হয়ে পড়ে সুজান্না। দুচোখে অন্ধকার দেখতে থাকে সে। হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায়। পিটার আর মনিকা মেয়ের অবস্থা দেখে বিচলিত হন। লেনাড© তাদেরও পছন্দের কিন্তু সুজান্নার অবস্থা দেখে দুজনের মধ্যকার সম্পক© যে অনেকটা গভীর সেটা বুঝতে আর বাকী থাকে না।
মেয়েকে তারা সান্তনা দিতে থাকেন। কিন্তু কোন সান্তনাই যে মানে না সুজান্নার। সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না লেনাডে©র চলে যাওয়া। উচ্ছ্বল-চঞ্চল-প্রাণবন্ত মেয়েটি কেমন যেন উদাসীন হয়ে পড়ে। সারাক্ষণ দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে। না আছে খাওয়া, না আছে নাওয়া। চোখের জলকে সঙ্গী করেই চলতে থাকে সুজান্নার দিনকাল।
দেখতে দেখতে বড়দিন চলে এলো। সারা গ্রাম জুরে বড়দিনের আমেজ। বড়দিনের কোন আনন্দ নেই শুধুমাত্র সুজান্নাদের বাড়িতে। গত তিনমাসেও লেনাডে©র মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি সুজান্না।
এমনি একদিন হঠাৎ সুজান্না বমি করতে শুরু করলো। বাবা-মা ভাবলেন লেনাডে©র শোকে নাওয়া-খাওয়া বাদ দেওয়াতে হয়তো সুজান্না অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মা সুজান্নাকে নিয়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার জানালেন সুজান্না মা হতে চলেছে। সুজান্নার গভে© তিন মাসের সন্তান।
সুজান্নার মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এটা কি করে সম্ভব! সুজান্না মাকে সব খুলে বললো। সুজান্নার মা বাড়ী ফিরে পিটারের সঙ্গে আলোচনা করে সুজান্নার গভপাত© করানোর সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু সুজান্না রাজি নয়।
মা বললেন, Òতুই বুঝতে পারছিসনা না মা। লেনাড© আর বেuচে নেই। ও আর ফিরে আসবে না। সমাজে এই সন্তানের কি পরিচয় দেবো আমরা? কি করে মানুষকে আমরা মুখ দেখাবো? জানাজানি হবার আগেই তোর গভে©র সন্তানকে নষ্ট করে ফেলতে হবে।Ó
Òনা মা আমি পারবো না। আমি জানি অবিবাহিত অবস্থায় শারীরিক সম্পক© স্থাপন করে আমি বড় পাপ করেছি। কিন্তু গভ©পাত করে আমি আমার পাপ আর বাড়াতে পারবো না।Ó
Òএসব নীতি কথা বললে এখন চলবে না। কি পরিচয় দিবি এই সন্তানের?Ó
Òআমি আমার সন্তানকে আমার পরিচয়ে বড় করবোÓ
Òপিটার তুমি তোমার মেয়েকে বোঝাও। এখনও সময় আছে।Ó
সুজান্নার বাবা বললেন, Òমা-রে লোকে যখন জানতে চাইবে এই সন্তানের বাবা কে? তখন কি উত্তর দিবি?Ó
Òকেন বাবা আমার সন্তানের বাবা তো লেনাড©Ó
Òসে যে বেuচে নেই। আর লেনাডে©র সাথে তো তোর বিয়ে হয় নি। তাই এই সন্তান সবার চোখে অবৈধ।Ó
Òবাবা এই সন্তান আমার আর লেনাডে©র ভালবাসার ফসল।Ó
এ সময় সুজান্নার মা সুজান্নাকে কষে একটা চড় মারলেন।
Òমারো মা আমাকে যতখুশি মারো কিন্তু আমার গভে©র সন্তানকে মেরে ফেলতে বলো না। আমাকে আর পাপ করতে বলো না বাবা।Ó
সুজান্নার মা বললেন, Òপিটার মানুষজন জানার আগেই এই সন্তানকে নষ্ট করতে হবে। তুমি সুজান্নাকে বোঝাও।Ó
সুজান্না কাuদতে কাuদতে বললো, Òমানুষ জানলেই বুঝি আমি খারাপ হবো আর না জানলে আমি ভাল হয়ে যাব?Ó
Òমুখে মুখে কথা বলিস না সুজান্না। সমাজ তোকে কলঙ্কিনি বলবে। আমাদের এক ঘরে করবে। তোর জন্য আমাদের গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না।Ó
সুজান্নার বাবা বললেন, Òঠিক আছে তোমরা শান্ত হও। শান্ত মনে একটু ভেবে দেখি কি করা যায়Ó
সুজান্না তার পাপের জন্য অনুতপ্ত। সে আর পাপ করবে না বলে সংকল্প নিলো। সে সারাদিন গভের© সন্তানকে বাuচিয়ে রাখতে চোখের জল ফেলে নবজাতক যীশর কাছে শুধু প্রাথনা© করে যেতে লাগলো, Òযীশু তুমিই তো বলেছো- প্রত্যেকটি শিশুর মধ্যেই তুমি বিরাজ করো। আমার গভে©র সন্তানের মাঝেও তুমি বিরাজ করছো। আমি যদি গভ©পাত করি সেটা তো যীশুকেই হত্যা করার সামিল। তুমি আমাকে শক্তি দাও যেন আমার দ্বারা আরো কোন পাপকাজ না ঘটে।Ó
কাuদতে কাuদতে সুজান্নার চোখের পানিও যেন শুকিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু সুজান্না প্রাথ©না করতে থামে না। এভাবে দুই দিন চলে গেল। সুজান্নার মা মেয়েকে গভ©পাতের জন্য কোন ভাবেই রাজি করাতে পারলেন না। সুজান্নার বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন রাতের আধাuরে তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যাবেন। যেখানে তাদের কেউ চিনবে না, জানবে না।
ডিসেম্বরের ২৪ তারিখে চারিদিকে বড়দিনের উল্লাস। ধনী-গরীব প্রত্যেক বাড়ীতে পিঠা তৈরি হচ্ছে, ছেলেমেয়েরা কীত©ন করছে, যুবকযুবতীরা গীজা©র গানের প্রস্তুতি নিচ্ছে, অনেকে আবার রঙ্গিন কাগজে ঘরবাড়ী সাজাচ্ছে। চারদিকে আলোয় আলোকময়। শুধুমাত্র সুজান্নাদের বাড়ি অন্ধকার। সুজানারা প্রস্তুতি নিচ্ছে রাতে গ্রামের সবাই যখন গীজা©য় যাবে তখন অন্ধকারে তারা গ্রাম ছেড়ে পালাবে। সুজান্নার বাবা-মা শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর সুজান্না সেই বিকেল থেকে শিশুযীশুর প্রতিকৃতির সামনে হাuটু গেঢ়ে জপমালা প্রাথ©না করেই চলছে।
রাত এগারটার দিকে হঠাৎ কেউ যেন সুজান্নাদের দরজায় টোকা দিল। সুজান্নার বাবা-মায়ের ভেতরটা কেuপে উঠলো। কেউ কি জেনে গেল তাদের গোপন পরিকল্পনা? এখন কি হবে? ঘরে যে ব্যাগ কাপড় সবই গোছানো। সুজানার মা ভয়ে ভয়ে দরজাটা খুলে একটু ফাuক করে বাইরে তাকিয়ে অবাক, একি! এ যে লেনাড©!
সুজান্নার মা ভুত দেখার মতো ভিমড়ি খেলেন। তিনি চিৎকার করে ডাকলেন, Òসুজান্না লেনাড© ফিরে এসেছে।Ó সুজান্নার বুকের ভেতরটা আৎকে উঠলো। সে দৌড়ে দরজার কাছে এসে দেখে লেনাড© বাইরে দাuড়িয়ে আছে ক্র্যাচে ভর দিয়ে। সুজানার দুÕচোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগলো। সে লেনাড©কে জাপটে ধরে বললো, Òআমি জানতাম তুমি ফিরে আসবে। আমার প্রাথ©না যীশু শুনেছেন। কারণ আমি আমার পাপের জন্য ক্ষমা চেয়েছি এবং আর পাপ করবো না বলে সংকল্প করেছি। প্রভু যীশু আমার সততার পুরস্কার দিয়েছেন।Ó
সুজান্না লেনাড©কে ধরে ঘরে নিয়ে এলো। সুজান্নার বাবা জিগ্যেস করলেন, Òবাবা আমরা তো খবর পেয়েছিলাম তুমি বেuচে নেই।Ó
Òহ্যাu বাবা অলৌকিক কাজই বলতে পারেন। যুদ্ধে আমাদের দশজনের চারজন মারা গেছে। আমিও ছিলাম ওদের সাথে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে আমি বেuচে যাই। মৃত ভেবে প্রথমে আমাকে মগে© ফেলে রাখা হয়েছিল। দুইদিন পর আমার একটু একটু জ্ঞান ফিরে আসে। আমাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে আমি অনেকদিন প্রায় সংজ্ঞাহীন ছিলাম। পুরো জ্ঞান ফিরে এলে আমি বুঝতে পারি আমার একটি পা নেই। (বলেই লেনাড© চোখ মুছতে থাকে) আজই আমি দেশে ফিরে এসেছি। আসলে আমি তো মরেই গিয়েছিলাম, সুজান্নার বিশ্বাস আর ভালোবাসাই আমাকে বাuচিয়ে তুলেছে।Ó
সুজান্নার বাবা বললেন, Òকেuদনা বাবা তুমি যে বেuচে ফিরে এসেছো এটাই অনেক বড় পাওয়া। আজ আমাদের আনন্দের দিন। আমাদের সবার জন্য তুমিই যে বড়দিনের সবচেয়ে বড় উপহার।Ó
আরও পড়ুন ফেরা
No comments