অনুভুতি
অনুভুতি |
স্বামীর চাকরির সুবাদে বিয়ের পর আমাকে বেশ কয়েক বছর দেশের বাইরে থাকতে
হয়েছিল।
দেশে ফিরে আসার পর সংসারের সব দায়িত্ব শাশুড়ির হাতে। আমি যেহেতু সদ্য
বিদেশ
ফেরত তাই কেবল খাই-দাই, ঘুরে বেড়াই, ফোনে বন্ধু-বান্ধুবীদের সাথে কথা বলে
সময়
কাটাই। বাড়ীতে আমরা মানুষ মাত্র চারজন। আমি, আমার স্বামী আর শ্বশুর-শাশুড়ি। আমার শাশুড়ি বয়স্ক হলেও তিনি নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করেন। বিশেষ
করে
রান্না করতে ভালবাসেন। অন্যের রান্না খুব একটা পছন্দ করেন না। কোন
কিছুতেই
আমাকে বিরক্ত করেন না। তবে আমার শাশুড়িকে আমার সেকেলের মনে হয়।
কারণ তিনি রান্না ঘরের পুরোনো থালা-বাটি ফেলতে চান না। হ্যান্ডেল ভাঙ্গা চায়ের
প্রিয়
কাপটাও যত্ন করে রেখে দেন।
আমার
আবার সংসার, তালা-চাবি, দায়িত্ব নিয়ে কোন লোভ বা মাথাব্যাথা নেই। শাশুড়ির
রান্না
আমার পছন্দ না হলেও একই রান্না ঘরে গিয়ে গুতোগুতি করার চেয়ে তিনি যা
রান্না
করেন তাই খেয়ে আমি দিব্যি টিভি সিরিয়াল আর হিন্দি মুভি দেখে সময় পার করে
দেই।
আমার স্বামী নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছে। সারাদিন অফিস নিয়েই ব্যস্ত।
আমার একমাত্র ভাসুর
স্ত্রী
আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে আলাদা থাকেন।
একদিন
আমার ভাসুর এসে বললেন, Òবৌমা এভাবে তো চলবে না। সংসারটা তো তোমার।
মা
আর কত দিন। সংসারের দায়িত্ব তো তোমাকে নিতে হবে।Ó
আমি বললাম, Òআমাকে কি করতে হবে?Ó
Òমায়ের কাছ থেকে রান্নাবারাটা একটু শিখ। কোথায় কি আছে দেখেশুনে রাখ।Ó
আমি বলালাম, Òদাদা রান্না ঘরে তো প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় জিনিস বেশী। আমার এত পুরোনো আর ভাঙ্গাচোরা জিনিস ভাল লাগে না।Ó
Òঠিক আছে তোমার কি কি দরকার তুমি একটা লিষ্ট করে দাও। আমি তোমাকে সবকিছু
এনে
দেব।Ó
Òতার আগে রান্নাঘরের পুরোনো সব জিনিস ফেলে পুরো রান্নাঘর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন
করে
দিতে হবে।Ó
Òঠিক আছে আমি কালই একজন কাজের মহিলা ঠিক করে নিয়ে আসবো। সে তোমার
রান্নাঘর
পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিবে। তুমি তখন তোমার মনের মতো করে সাজিয়ে
নিও
ঠিক আছে?Ó
অনেকটা অনিচ্ছা সত্বেও আমি রাজি হলাম। তবে আমার স্বামী খুব খুশি হলেন। কারণ
তার
উড়লচন্ডি বউটা এবার হয় তো সত্যিকারের গৃহীনি হবে ভেবে।
পরের
দিন ভাসুর রান্নাঘর পরিস্কার করার জন্য একজন মহিলা নিয়ে এলেন। আমি প্রথমে রান্নাঘরের সব কিছু বাইরে বের করে পুরো ফ্লোর পরিস্কার করার কথা
বলালম।
মহিলাটির সাথে আমার ভাসুরও বড়বড় জিনিসগুলো হাতে হাতে বের করলেন।
ফ্রিজ,
ওভেন, গ্যাসকুকার, কাবাড সব বের করা হলো। পুরো রান্নাঘর ফাuকা। মহিলাটি
পুরো
রান্নাঘরের ফ্লোর ধুয়েমুছে চকচকে করে ফেললো। এবার জিনিস বাছাই হবে।
শুধুমাত্র
আমার ছাইকৃত জিনিসগুলোই রান্নাঘরে পুনরায় প্রবেশের অনুমতি পাবে।
এদিকে আমার শাশুড়ি সকাল থেকে মন খাপার করে নিজের ঘরে শুয়ে আছেন। তার নিজের
হাতে
গড়া ৪৭ বছরের সংসার আজ চলে যাচ্ছে অন্য কারো হাতে। তিনি আর এই
রান্নাঘরের কেউ নন। তাই তার মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু
জিনিস বাছাইয়ের সময় তিনি দরজার পাশে দাuড়িয়ে রইলেন। আমি প্রথমে ফ্রিজ, ওভেন রান্না ঘরে নিতে বললাম। কাবাড বানি©শ করাতে হবে। তাই বানি©শ না করিয়ে
সেটা
আর রান্নাঘরে নিতে দিলাম না। তবে কাবাডের ভেতরের জিনিসগুলো বাছাই করতে
লাগলাম।
কাuচের অনেক জিনিস। এমনও জিসিন আছে যেগুলোর প্যাকেটই এখনো খোলা
হয়
নি। প্যাকেটগুলোতে মরিচা পরে গেছে। এবার কাবাড থেকে বেরুলো একটা জংধরা টিন।
টিনের
কোন রং নেই, মরচে পড়ে পুরোটাই বাদামী হয়ে গেছে। আমার ভাসুর সেটাকে বাম
হাতের
দুই আঙ্গুল দিয়ে তুলে নীচে ফেলে দিলেন।
হঠাৎ দরজার পাশ থেকে আমার শাশুড়ি বললেন, Òওটা ফেলিস না বাবাÓ
আমার ভাসুর পা দিয়ে টিনটাকে গুতো মেরে বললেন, Òকোনটা? এই টা?Ó
Òঐ যে নীল রঙ্গের টিনটিÓ
ভাসুর পা দিয়ে আবারও গুতো দিয়ে বললেন, Òনীল দেখ কোথায়? এটাতো জং ধরে বাদামী হয়ে গেছে। কিসের টিন এটা?Ó
Òওটাকে পা দিয়ে মারাস নেÓ ওটা অনেক গুরুত্বপূণ একটা জিনিসÓ বলেই তিনি অতি
কষ্টে
প্রায় দৌuড়াতে দৌuড়াতে এসে টিনটি হাত নিলেন।
ভাসুর বললেন, Òমা টাকা-পয়সা, ধন-রত্ন রেখেছো নাকি ওতে?Ó
Òনানা টাকা-পয়সা কিছু নেই এখানে। এটা ফেলিস না। এটা আমি রেখে দিব।Ó
আমি বললাম, Òদেখলেন তো দাদা! কিভাবে আমি রান্নাঘর পরিস্কার রাখবো?Ó
ভাসুর বললেন, Òমা ওটা দিয়ে কি হবে ফেলে দাও। ভেতরে যা আছে অন্য একটা কিছুর
মধ্যে
রেখে টিনটা ফেলে দাও।Ó
আমার শাশুড়ির চোখ জলে ভিজে উঠলো তিনি কান্না জড়িত কন্ঠে আমার ভাসুরকে
বললেন,
Òএটা সেই টিন শিশুকালে যে টিনের দুধ তুই প্রথম খেয়েছিলি।Ó
আমি, আমার ভাসুর, শ্বশুর আর কাজের মহিলাটি সবাই একসঙ্গে হো হো করে হেসে
উঠলাম।
আমার ভাসুরের বয়স তখন ৪৬ বছর অথা©ৎ ৪৬ বছর আগের সেই টিনটি
তিনি
পরম যত্নে আগলে রেখেছেন। একটি দুধের টিন, পুরানো, জং ধরা।
এমন
একটা
জিনিস
যত্ন করে রেখে দিয়েছেন এর চেয়ে আর হাসির ঘটনা কি হতে পারে!
হাসি এখানেই শেষ হলো না। আমার যেহেতু নতুন সংসার শুরু হয়েছে তাই আমার মা-বাবা, আমার বান্ধবীরা যারাই বাড়িতে এলো সবাইকে ৪৬ বছর আগেকার সেই টিনের ঘটনাটা
আরো
একটু রশিয়ে-কষিয়ে বলে সেই কি হাসাহাসি। এটি প্রায়ই আমাদের পারিবারিক
আড্ডায়
হাসির খোড়াক হয়ে উঠলো।
এখন আমার সংসার জীবনেরও প্রায় ২৫ বছর ছুuই ছুuই করছে। শ্বশুর-শাশুড়ি আর
বেuচে নেই। দুই মেয়ে জেমিমা আর অপ্সরা। বড়মেয়ে বিয়ের সম্বন্ধ আসতে শুরু করেছে।
ছোট
মেয়ে অপ্সরা জেমিমার চেয়ে আট বছরের ছোট। অপ্সরা প্রায়ই বলে, Òমা একটা
আলমারীতে
দিদির আর আমার কাপড়-চোপড় জায়গা হয় নাÓ
Òকয়েকটা দিন একটু কষ্ট করে রাখ মা। কিছুদিন পর দিদির বিয়ে হয়ে গেলেই তো পুরো
আলমারীটা
তোর হয়ে যাবে।Ó
Òমা তোমার আলমারীতে কতগুলো শাড়ি আছে যেগুলো তুমি পরো না। সেগুলো অন্য
কোথাও
রেখে আমাকে একটা তাক দাও।Ó
Òঠিক আছে। তোর ছুটির দিনে তুই আমার পুরানো শাড়িগুলো আলাদা করিস।Ó
সেদিন আমি আর অপ্সরার বাবা গিয়েছিলাম ডাক্তারের কাছে। ফিরে এসে দেখি আমার
দুই
মেয়ে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। ঘরে উuকি দিয়ে দেখি ওরা আমার আলমারীর সব
কাপড়-চোপর বের করে বিছানায় ফ্লোরে মেলা মিলিয়ে রেখেছে। ওদের বাবা বললেন,
Òকি রে তোরা এত খুশি যে কি হয়েছে?Ó
অপ্সরা বললো, Òবাবা দেখ মায়ের আলমারী থেকে কি পাওয়া গেছে!Ó
Òকি পেলি তোরা?Ó
অপ্সরার এক হাতে একটা ফাইল আরেক হাতে একটা প্লাষ্টিকের ব্যাগ। ও ওর
বাবার
সামনে ফাইলটা মেলে ধরে বললো, Òবাবা এটা দিদির ফাইলÓ
Òকিসের ফাইল?Ó
Òমায়ের প্রেগনেন্সি রিপোট© ফাইল। এখানে কি আছে জান? প্রেগনেন্সি টেষ্টের
ষ্টিক, আল্ট্রাসনোগ্রামের রিপোট©, ডাক্তার দেখানো প্রত্যেকটি প্রেসক্রিপশনÓ বলেই আমার দুই মেয়ে হা হা হা করে হাসতে লাগলো।
জেমিমা বললো, Òঐ ব্যাগে কি আছে বল?Ó
Òআমার আর দিদির ছোট বেলার দুই জোড়া জুতো, দুটো ফ্রক, দুটো টুপি, মোজা আর
কিছু
চুড়ি।Ó
দুই বোনই প্রাণ উজার করে হাসছে।
ওদের
হাসি দেখে আমি আর ওদের বাবাও হাসতে লাগলাম। আমার ছোট মেয়ে বললো, Òমা এসব আমি এখন ফেলে দিব। এই তাকেই আমি আমার কাপড় রাখবো। যতসব
অপ্রেয়োজনীয় জিনিস তুমি রেখে দিয়েছে আলমারীর ভেতর। কি হবে এসব দিয়ে?Ó
হঠাৎ আমার বুকটা কেuপে উঠলো। এগুলো অপ্রযোজনীয়! আমার কাছে এগুলোর মূল্য
যে
অনেক! ওদের গায়ের প্রথম জামা-জুতো-টুপি, ছোট্ট ছোট্ট হাতের সেই ছোট ছোট
চুড়িগুলো
আমাকে কত স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। আমি কত দিন কত রাত একা একা এই
স্মৃতিগুলোতে হাত বুলাই আর চলে যাই আমার সেই প্রথম মা হওয়ার দিনগুলোতে। ফিরে
পাই
সেই অনুভূতি। আমি কত পরম যত্নে-আদরে এগুলো তুলে রেখেছি আর ওরা বলছে
ওদের
কাছে এগুলোর কোন মূল্য নেই।
Òআমার জিনিসগুলো আলাদা এক জায়গায় রেখে তুই তোর কাপড় রাখÓ বলেই আমি ও ঘর থেকে বেড়িয়ে এলাম।
দিনদুই পর, বিকেলে আামি শুয়েছিলাম। ড্রয়িং রুমে আমার মেয়েরা হাসছে। আজ আমার
বড়
মেয়ের বান্ধবীর আসার কথা। ভাবলাম যাই ওদের জন্য চা নাস্তা প্রস্তুত করি।
আমি
ঘর থেকে বেড়িয়ে দেখি আমার ছোট মেয়ে অপ্সরা অভিনয় করে করে কি যেন
দেখাচ্ছে।
ভাল করে খেয়াল করে দেখি সেদিন আলমারিতে আমার প্রেগন্যান্সি ফাইল
আর
ওদের ছোট বেলার জিনিসগুলো পাওয়ার কথাটাই আমার মেয়ে কেমন ইনিয়ে বিনিয়ে
বলছে
যেন ভারী মজার এক ঘটনা।
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি আর ঘর থেকে বের হলাম না। শুয়ে রইলাম। একটু
পর
অপ্সরার বাবা অফিস দেকে এসে দেখে আমি শুয়ে আছি
Òঅবেলায় শুয়ে আছো যে! শরীর খারাপ করেছে?Ó
ÒনাÓ
Òতাহলে তুমি তো এই অবেলায় শুয়ে থাক নাÓ
Òজানো তোমার ছোট মেয়ে আজ সেই ফাইল আর ওদের ছোটবেলার জিনিসগুলোর কথা
তবাইরের
মানুষদের সামনে বলে হাসাহাসি করছিল। বলছিল, কেন আমি এখনো ওগুলো
ফেলে
দেই না?Ó
Òবাদ দাও ওরা ছোট মানুষ।
ওরা
এসবের কি বুঝবে?Ó
Òকিন্তু ওগুলো যে আমার কাছে অনেক মূল্যবান। আমি ওসব কখনো ফেলতে পারবো
না।Ó
Òএখন ওরা বুঝবে না। যখন ওরা মা হবে তখন ওরা ঠিকই বুঝতে পারবে। মনে আছে
তোমার,
রান্নাঘরে আমার মায়ের রাখা সেই নীল টিনের কথা?Ó
আমার স্বামীর কথা শুনে আমার চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝড়তে লাগলো।
No comments