আজব নারিকেল
সময়টি ছিল ১৯৯৩ সাল। কেয়া মাসি প্রতিদিনের মত সেদিনও সকাল বেলা উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। হঠাৎ মাসির চোখ পড়ল গতমাসে টবে রোপণ করা নারিকেলটাতে। নারিকেল দেখে কেয়া মাসির চোখ তো চরকগাছ। সদ্য লাগানো নারিকেলটিতে গত সপ্তাহেই দুইটি পাতা বের হয়েছিল। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে পাতার সাথে দুইটা বোলের কাদি বের হয়েছে। কেয়া মাসি অবাক, বিস্মিত ও হতভম্ব যা হবার সবই হলেন।
মাসি ঝাড়ু দেয়া শেষ করে সকালের নাস্তার টেবিলে স্বামী রাকিব সাহেব আর ছেলে সুমনকে কথাটা বললেন। রাকিব সাহেব খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না। কিন্তু সুমন কোন রকমে খাওয়া শেষ করেই দেখতে ছুটল ঘরের পেছনে টবে লাগানো নারিকেলটি। ১৪ বছরের সুমন নারিকেলের ঘাড়ে নারিকেলের বোল দেখে বিমোহিত। ব্যাপারটি তার কাছে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য ঘটনা বলে মনে হল।
বাড়ির আশেপাশে সুমনের তেমন কোন বন্ধু নেই। তার সব বন্ধুই স্কুলের। সেদিন স্কুল ছুটি থাকায় অষ্টম আশ্চর্য ঘটনার কথা কাকে বলা যায় ভাবতে লাগল। সুমন গেইট দিয়ে বাইরে গিয়ে দেখে ছুটি দিদি তাদের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কাউকে না পেয়ে সুমন ছুটি দিদিকেই কানে কানে কথাটা বলল।
ছুটি দিদি হচ্ছে সুমনের বাবার জ্যাঠাত ভাইয়ের মেয়ে। সাত ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট বলে সবাই ছুটি নামে ডাকে। লেখাপড়ায় ডাব্বা, সারাদিন বাবার দোকানের সামনে বসে বসে এটাসেটা খেতেই থাকে। তার আরও একটা বড় গুণ হচ্ছে কোন কথা শোনা মাত্র এর সত্যতা যাচাই না করেই একেওকে বলে বেড়ানো। বাড়ির লোকজনসহ পাড়াপ্রতিবেশিরা তাই ওকে বিবিসি নামেও ডাকে।
তখন সময় সকাল সাড়ে আটটা কি ৯টা। কথাটা শোনামাত্র ছুটি দিদি সুমনের সাথে ঘটনাস্থলে এসে নিজের চোখে তা পর্যবেক্ষণ করল। ছুটি দিদিও অভিভূত। ছুটি দিদি চলে গেলে সুমন পড়তে বসলো। এর পাঁচ মিনিট পর থেকেই গ্রামের একজন/দুইজন করে সদ্য বোনা নারিকেল গাছে নারিকেলের বোল দেখতে আসতে শুরু করল। সকাল ১০ টা নাগাত গেইটের সামনে পুরো গ্রামের মানুষের ঢল। সুমনের বাবা-মা তো অবাক! এরা খবর পেল কোথা থেকে? মানুষও নাছরবান্ধা। আজব নারিকেল গাছ তাদের দেখা চাই-ই-চাই। দুপুরের পর আসতে শুরু করল আশেপাশের গ্রামের মানুষ। সুমনদের বাড়ির চারিদিকে লোকসমাগমে মুখর হয়ে উঠল। সুমনের বাবা উপায় না দেখে নারিকেলসহ টবটি ঘরের সামনে এনে রাখলেন। এদিকে আইস্ক্রিম, চানাচুর, ঝালমুড়ি, বাদাম বিক্রেতারা মেলা মিলিয়ে ফেলল। সুমনদের বাড়ি ঘিরে এক উৎসব শুরু হয়ে গেল।
সন্ধ্যার দিকে এক জাতীয় দৈনিক পত্রিকার দুইজন সাংবাদিক এসে হাজির। নারিকেল গাছের বিভিন্ন পোজে ছবি তুললেন তারা। এবার নারিকেল গাছের মালিকের ইন্টারভিউ নেয়া হবে। সুমনের বাবা তো এসব কাণ্ডকারখানা দেখে রেগে আগুন। তিনি ইন্টারভিউ দেবেন না বলে জানালেন। তবে সুমনের মা অনেক বলেকয়ে রাজি করালেন স্বামীকে। সুমনের বাবার ইন্টারভিউর পালা শেষ। এবার সাংবাদিক জানতে চান প্রথমে যে ঘটনাটি দেখেছেন তার অনুভুতি। এরপর দর্শনার্থীদের অনুভুতি নেয়া হবে। এদিকে ছুটিদিদি সেজেগুজে অপেক্ষা করছে ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য।
সময় যতই গড়াচ্ছে মানুষের সমাগম তত বেড়েই চলছে। রাত দশটা বেজে গেল, পরেরদিন সুমনের স্কুল, রাকিব সাহেবের অফিস। গেইট বন্ধ করে ঘুমান দরকার। কিন্তু ভিড় কমছেই না, গেইট বন্ধ করা যাচ্ছে না, তারা ঘুমাতেও পারছেন না। রাত ১১ টার দিকে রাকিব সাহেব জোড় করে ভিড় ঢেলে গেইট বন্ধ করে দিলেন।
পরের দিন ভোর পাঁচটা থেকে আবার মানুষের ঢল। বাদাম, চানাচুর, ঝালমুড়ি, চটপটিওয়ালারা যথা সময়ে এসে হাজির। স্ত্রীর নিরাপত্তার কথা ভেবে রাকিব সাহেব আর অফিসে গেলেন না তবে ছেলেকে স্কুলে পাঠালেন। ভিড় সামাল দিতে গ্রামের কিছু অতিউৎসাহি ছেলে লাঠি হাতে সেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করছে। জোর করে সবাইকে লাইনে দাঁড় করানো হচ্ছে। মহিলা-পুরুষ দুইটি লাইন করা হয়েছে। গেইটের কাছে দুইজন সেচ্ছাসেবক। একজন একপাশ দিয়ে কয়েকজন করে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে, অন্যজন দেখা শেষ হলে আরেক পাশ দিয়ে বাইরে বের করে দিচ্ছে। অতি শৃঙ্খলার কারনে লাইন দুইটি তিন কিলোমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়েছে।
দুপুরের দিকে ভিড়টা একটু কমে এল। কিন্তু সুমনের স্কুল ছুটি হলে পুরো স্কুলের ছেলেরা একসাথে এলে আরও হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। এসময় পরিস্থিতি সেচ্ছাসেবকদের নাগালের বাইরে চলে গেল।
দৈনিক পত্রিকার খবর পড়ে রাকিব সাহেবের দুই বোন ফোন করে জানালেন একজন খুলনা থেকে আর একজন কুমিল্লা থেকে সপরিবারে আগামিকাল ঢাকা আসবেন আজব নারিকেল দেখতে। সেদিন ফোনটারও বিশ্রাম নেই। পত্রিকায় নিউজ দেখেই রাকিব সাহেবের অফিসের কলিগরা ফোন করেই চলছেন। অনেকে ফোন করে জানতে চাইছেন বাড়ির লোকেশন।
এই দুদিন যা ঘটেছে মুটামুটি কেয়া মাসি ও তার পরিবার মানিয়ে নিয়েছে কিন্তু একটা সামান্য নারিকেল গাছকে কেন্দ্র করে অতিথিদের আগমন, রান্নাবাড়া, তাদের আপ্যায়ন এসব তো বাড়াবাড়ির পর্যায়ে। সুমনের বন্ধুরাও এলে আর বাড়ি ফেরার নাম করে না। তাদের জন্যও খাবারের ব্যাবস্থা করতে হয়।
বাড়ির সবার মেজাজ যখন চরমে এর মধ্যেই রাত দশটায় ফোন এল দেশের একমাত্র টেলিভিশন বিটিভি থেকে। তারা আজব নারিকেল নিয়ে একটা বিশেষ প্রতিবেদন করতে চায়। রাকিব সাহেব নারিকেলের সংবাদটি ভুয়া বলে বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন, মাসের প্রায় শেষ এই সময় যদি দুই বোন তাদের পরিবার নিয়ে এসে উঠে তবে তাদের সমাদর করতে তাকে হিমসিম খেতে হবে।
পরেরদিন সন্ধায় বোনেরা এসে হাজির। তাদের ছেলেমেয়েরা আজব নারিকেল গাছ না দেখে ঝালমুড়ি, চানাচুর, বাদাম খাবে বলে কান্নাকাটি হল্লাহল্লি করতে লাগল। তবে পরের দিন সকাল থেকে বোনের ছেলেমেয়েরা নারিকেল গাছ ঘিরে চেয়ার পেতে বসে রইল। ভাবখানা এমন যে তাদের মামার বাড়ির গাছ তারাই এর উত্তরাধিকারী।
বোনেরা চারদিন থেকে যার যার বাড়ি চলে গেল। মানুষের ঢলও কমতে শুরু করল। বিজনেস নেই বলে এখন আর বাদাম, চানাচুর, ঝালমুড়িওয়ালারা আসে না। এখন মাঝে মাঝে দুই/ একজন আসে আজব নারিকেলটি দেখতে।
রাকিব সাহেব গাছটিকে নিয়ে আগের জায়গায় অর্থাৎ ঘরের পেছনে রাখলেন। দিন পনের পরে নারিকেল গাছটি আস্তে আস্তে শুকিয়ে যেতে শুরু করল। একটা সময় গাছটি মরেই গেল।
কেয়ামাসি, রাকিব সাহেব আর সুমন আজব নারিকেল গাছটিকে কেন্দ্র করে যতটাই বিরক্ত হয়েছিলেন। গাছটা মরে গেলে তারা ততটাই দুঃখ পেলেন। আর জনসমাগমও মিস করতে লাগলেন।
No comments