পলাশের রাজা সাজা
![]() |
পলাশের রাজা সাজা |
টিভি-পত্রিকার সাংবাদিকদের ভিড়ে উঠোনে গ্রামের
সাধারণ মানুষের ঢোকাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। তার পরেও হেডমাষ্টার
অনেক কষ্টে ভিড় ঠেলে জরাজীর্ণ ঘরটির সামনে এসে দাঁড়ালেন। বিকট শব্দে চেয়ারম্যানের
হোন্ডার বহর এসে থামলো। সামনের
হোন্ডার চারজন মানুষ ধাক্কাধাক্কি করে চেয়ারম্যানকে বারান্দার
উপর উঠিয়ে দিলেন। চেয়ারম্যান ঈদের পঞ্চাবি পড়ে একেবারে সেজেগুজে
এসেছেন। তিনিও টিভি-পত্রিকায় বক্তৃতা
রাখবেন কারণ তার এলাকার স্কুলের
ছাত্র সারা দেশের মধ্যে
বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে। এর কিছুটা কৃতিত্ব
তো তাকে নিতেই হবে।
যাই
হোক, বলছিলাম পলাশের কথা। পলাশ এ
বছর খালপাড় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়েছে। শুধু বৃত্তি বললে
ভুল হবে, সারা বাংলাদেশের
মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। প্রত্যন্ত এলাকার এক অজ্ঞাত স্কুল
থেকে একরম ফলাফল আসবে সেটা যেমন
কেউ কখনো আশা করেনি
তেমনি এই এলাকায় টিভি-পত্রিকার সাংবাদিকদের আগমন ও তাদের
দাপটও গ্রামের সহজ-সরল নিরিহ
মানুষদের বিরাট উৎসুকের কারণ হয়ে দাঁড়াল।
পলাশের
কৃতিত্বের খবর রাত আটটায়
টিভিতে প্রচারিত হলে পুরো গ্রাম
যেন ভেঙ্গে পড়লো চেয়ারম্যানের বাড়িতে। পত্রিকায় খবর পড়ে দরিদ্র
মেধাবী পলাশকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেন শহরের এক
বিত্তশীল সহৃদয় ব্যক্তি। তিনি পলাশকে ঢাকা
শহরের এক নামীদামী আবাসিক স্কুলে রেখে পড়াশুনা করানোর
দায়িত্ব নিলেন।
শুরু
হলো এগার বছর বয়সী
পলাশের নতুন জীবন সংগ্রাম।
গ্রামের খোলা পরিবেশে হেসেখেলে বেড়ে
উঠা পলাশ ইটকাঠের শহরে
এসে নিজেকে মানিয়ে নিতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ
শুরু করলো। উদ্বোমী আর মেধা-বুদ্ধিতে
চৌকষ হলেও পলাশের চেহারা
আর পোশাক-পরিচ্ছদে গ্রাম্য এক মলিনতার ছাপ
যেন থেকেই গেল। আর সে
কারণেই শহরের সহপাঠীদের সাথে চলতে গিয়ে
পলাশের যেন বার বার
তাল কেটে যেতে লাগলো।
বাংলা
ক্লাশে পলাশের সাহিত্যবোধ দেখে শিক্ষক পলাশকে
ভালবেসে ফেলেন। অংকের ক্লাশে পলাশের চৌকষ মেধা শিক্ষকের
নজর কাড়ে। ইংরেজী ক্লাসে পলাশের গ্রাম্য উচ্চারণ সহপাঠীদের হাস্যরসের খোড়াক যোগালেও গ্রামার সম্বদ্ধে পলাশের জ্ঞান শিক্ষককে অবাক করে। গ্রামের
মাঠে-ঘাটে দৌড়ঝাঁপ করে, গাছের মগডালে
চড়ে, পুকুরে সাঁতার কেটে বেড়ে উঠা পলাশকে
তাই শারীরিক শিক্ষা ক্লাসের শিক্ষকও সবার থেকে আলাদা করতে পারেন সহজেই।
তাই নতুন স্কুলে এসে
অচিরেই পলাশ সব শিক্ষকদের স্নেহের
পাত্র হয়ে উঠলো।
গ্রামের
এক হা-ভাতের ছেলে
হবে শিক্ষকদের প্রিয়পাত্র বিষয়টি মেনে নিয়ে পারলো
না শহরের কিছু ধনীর দুলাল।
এই দুলালদের মধ্যে সবচেয়ে মারমুখো স্বভাবের ছিল রাজীব। পলাশ যেমন
দেখতে ছোটখাট আর রোগাপাতলা, রাজীব
হচ্ছে পুরোই উল্টো। দেখতে যেন ছোটখাট একটা হাতি। রাজীবের
বাবা শহরের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তাই রাজীবের নেতৃত্ব কয়েকজন ছাত্র মিলে পলাশের বিরোধী
দল হয়ে উঠলো। কিভাবে
পলাশকে সবার সামনে ছোট
করা যায়, পলাশের লেখাপড়ায়
বাঁধা সৃষ্টি করা যায় এমন
সব ফন্দি আটতো বিরোধী দল।
পদে
পদে বাঁধা আর অপমানিত হয়েও কোন রকম
প্রাইভেট ছাড়াই বছরের প্রথম পরীক্ষায় পলাশ ক্লাসে প্রথম স্থান লাভ করলো। আর
উচ্চবিত্ত হিংসুক ছাত্ররা কয়েকটি করে প্রাইভেট পড়েও পলাশের ধারেকাছে
নম্বর পেল না। তাই
পলাশের প্রতি তাদের রাগের মাত্রা বাড়তেই লাগলো।
একদিন
ক্লাশে ঘোষণা দেওয়া হলো শহরের স্কুলগুলোর
মধ্যে নাটক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে।
শহরের নামীদামী বাইশটি স্কুলের ষষ্ঠশ্রেণীর ছাত্রদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। ক্লাসের পর
সব ছাত্ররা গেল নাটক প্র্যাক্টিসে।
শিক্ষক
ছাত্রদের নাটকের পাণ্ডুলিপি পড়ে বুঝিয়ে দিলেন-
একজনকে
রাজা হতে হবে। আরো
থাকবে রাণী, রাজপ্রহরী, কিছু সাধারণ প্রজা
ইত্যাদি ইত্যাদি। শিক্ষক প্রথমে রাজার চরিত্রে অভিনয় করে দেখালেন। পলাশ
গ্রামের ছেলে, বাবার সাথে কতবার গিয়েছে
যাত্রাপালা দেখতে। রাজা কিভাবে কথা
বলেন, কিভাবে কোমড়ে বাঁধা খাপ থেকে তলোয়াড় বের
করে শুন্যে ঘুরিয়ে আবার তা খাপে
ভরে রাখেন সব পলাশের জানা।
শিক্ষক
বললেন, ‘এই রাজার চরিত্রটি
অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কে করতে পারবে
এই চরিত্র?’
ক্লাসের
সব ছেলেরাই হাত তুললো।
শিক্ষক
বললেন, ‘ঠিক আছে তোমরা
একজন একজন করে সামনে
এসে অভিনয় করো। যারটা বেশী ভাল হবে
তাকেই রাজার চরিত্রে অভিনয় করতে দেওয়া হবে।‘
সব ছাত্ররা একে একে সামনে
এসে রাজার সংলাপ বলতে লাগলো। কিন্তু
করোটাই ঠিক রাজার মতো হচ্ছে না।
এবার
এলো পলাশ। দরাজ গলায় পুরো
ক্লাসরুম কাঁপিয়ে পলাশ রাজার সংলাপ বলে গেল। যেন সত্যিকারের
রাজদরবারে সত্যিকারের রাজা পলাশ। শিক্ষক
অভিভূত হয়ে গেলেন পলাশের অভিনয়
প্রতিভা দেখে।
শিক্ষক
বললেন, ‘আর কাউকে অভিনয়
করে দেখাতে হবে না। পলাশই
করবে রাজার চরিত্র।‘
এদিকে
রাজীব রাজা হওয়ার জন্য
শিক্ষককে বার বার অনুরোধ
করতে লাগেলো।
শিক্ষক
বললেন, ‘তুমি তো সংলাপই
বলতে পারছো না। অভিনয় তো
বুঝোই না। রাজার চরিত্র পলাশই
করবে।‘
পরের
দিন রাজীবের বাবা স্কুলে এসে
শিক্ষকের সাথে দেখা করলেন।
বললেন, ‘স্যার নাটকের জন্য কিছু অনুদান
দিবো ভাবছি’
‘সেটা
তো ভাল কথা। আপনি
বরং প্রধান শিক্ষকের সাথে এ বিষয়ে
আলোচনা করুন।‘
‘না
না প্রধান শিক্ষকেরটা তো উনাকে দেবোই।
আপনার জন্যও কিছু এনেছিলাম’
‘আমার
জন্য? আমার জন্য কেন?’
‘না
মানে রাজীবকে যদি রাজার চরিত্রটি
করতে দেন তো আপনাকে
আমি খুশি করে দিব।‘
‘বলেন
কি আপনি? রাজীব রাজার চরিত্র করার মতো অভিনয়
জানে না। এই নাটক
শহরের বাইশটি স্কুলের মধ্যে প্রতিযোগিতায় যাবে। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ
চরিত্র আমি রাজীবকে
দিতে পারি না। আপনি
আমাকে অবান্তর অনুরোধ করবেন না।‘
‘কাল
সারা রাত রাজীব প্র্যাক্টিস
করেছে। সে এখন খুব
ভাল বলতে পারে। আপনি
আজ একবার ওর অভিনয়টা দেখবেন।‘
‘ঠিক
আছে আমি দেখবো। এখন
আমাকে ক্লাসে যেতে হবে।‘
রাজীবের
বাবা খামটি দেখিয়ে বলেন, ‘এটি আপনার জন্য
এনেছিলাম।‘
‘ওটা
আপনার কাছেই থাক।‘ বলেই ক্লাসে চলে
যান শিক্ষক।
রাজীবের বাবা বিষয়টি নিয়ে প্রধান শিক্ষকের সাথে আলোচনা করলেন। প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘আজ আমরা সব শিক্ষকরা মিলে প্র্যাক্টিসে থাকবো। তখন সবার অভিনয় প্রতিভা বিচার করে আমরা ঠিক করবো কে রাজার চরিত্রে অভিনয় করবে। তাই আপনি এ ধরনের অন্যায় আবদার করবেন না।‘
রাজীবের
বাবা মন খারাপ করে
চলে গেলেন। সেদিন সত্যি সব শিক্ষকদের উপস্থিতিতে
আবারও প্রমানিত হলো যে রাজার
চরিত্রে অভিনয় করার জন্য একমাত্র
পলাশই উপযুক্ত। ঠিক হলো পলাশ
হবে রাজা আর রাজীব
হবে দুই বছর খাজনা
দিতে না পারা এক দরিদ্র
কৃষক।
প্রতিদিন
ক্লাসের পর প্র্যক্টিস চলছে।
এদিকে রাজীব তার চরিত্রে মোটেই
খুশি নয়। সে পলাশকে কিছু টাকা দিয়ে
রাজার চরিত্র না করার জন্য
অনুরোধ করলো। কিন্তু পলাশ রাজী হলো না।
রাজীব এতে করে পলাশের
উপর আরো চটে গেল।
রাজীবের বন্ধুরা উপহাস করে বলতে লাগলো,
‘রাজীব, পলাশ হবে রাজা
আর তুই রাজার সামনে
হাঁটু গেঁড়ে হাত জোর করে
কান্নাকাটি করবি। ছিছি ভাবতেই আমাদের
চোখে জল আসছে।‘ এধরনের কথায় রাজীব আরো
রেগে আগুন হয়ে গেল।
এদিকে
নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার বাকী মাত্র তিনদিন।
শিক্ষক বললেন, ‘আগামীকাল সবাইকে যার যার পোশাক
পড়ে অভিনয় করতে হবে।‘
সবাইকে
যার যার পোশাকের তালিকা
দেওয়া হলো। সবচেয়ে বেশী
জিনিস যোগার করতে হবে পলাশকে। রাজার মতো দামী পোশাক,
অলংকার, তলোয়ার, মুকুট এতকিছু পলাশ কিভাবে যোগার করবে!
পলাশ
শিক্ষককে বললো, ‘স্যার আমি এতকিছু কোথা
থেকে যোগার করবো?’
‘এসব
কিছু দোকানে ভাড়া পাওয়া যায়।
আমি ঠিকানা দিচ্ছি বিকেলে গিয়ে মাপ অনুযায়ী
নিয়ে আসবে।‘
পলাশের
কাছে কোন টাকা পয়সা
নেই। তাই ভাড়া হিসেবে
কত টাকা হবে বিস্তর
চিন্তা করতে করতে হোষ্টেলে ফিরে
এলো। পলাশের ঘনিষ্ট বন্ধু রাজু। রাজুকে সব বলতেই রাজু
পলাশের সাথে যেতে রাজী হয়ে
গেল। বিকেলে পলাশ রাজুকে নিয়ে
গেল স্যারের দেওয়া ঠিকানায়। দোকানে যাত্রাপালার সব পোশাকই রয়েছে।
সেই বিবেকের পোশাক, রাজার পোশাক, জুতো, অলংকার সব কিছু। কত
রকমের মুকুট আর তলোয়াড় দেখেই
পলাশের মনটা আনন্দে ভরে গেল। পলাশ
দোকোনের মালিককে ভাড়া কত হতে
পারে জিগ্যেস করলো।
কাপড়ের
মান এবং সৌন্দর্য অনুযায়ী
দাম। পলাশ জিগ্যেস করে
করে জানলো আকর্ষণীয় পোশাকগুলোরই ভাড়া বেশী। তলোয়ার
আর মুকুটেরও একই অবস্থা। যেসব
তলোয়ার আর মুকুট স্বর্ণালি, ঝলমলে, উজ্জ্বল সেগুলোর ভাড়া অনেক বেশী।
সেদিন পলাশ সব কিছুর দাম
জেনে খালি হাতে ফিরে
এলো। পরের দিন প্র্যাক্টিসে
গেলে সবাই যার যার চরিত্র অনুযায়ী
পোশাক পড়ে অভিনয় শুরু
করলো শুধুমাত্র পলাশ ছাড়া। শিক্ষক সবার
সামনে পলাশকে খুব বকাঝকা করলেন।
রাজীব জানতো টাকার অভাবেই পলাশ পোশাক যোগার করতে পারে নি।
তাই সে মনে মনে
অনেক খুশি হলো।
প্র্যাক্টিস
শেষে পলাশের বন্ধু রাজু বললো, ‘পলাশ
আমার কাছে কিছু টাকা
আছে। চল আজ বিকেলে গিয়ে পোশাকগুলো নিয়ে
আসি।‘
‘না
না আমি তোর টাকা
নিতে পারবো না।‘
‘কেন
পারবি না? আমি না
তোর বন্ধু! শোন এখন তো
তোর টাকা খুব দরকার।
যখন পারবি ফেরত দিয়ে দিস।‘
পলাশের চোখ জলে ভিজে যায়। বিকেলে দুই বন্ধু মিলে আবার যায় সেই দোকানে। তবে রাজুর যে টাকা আছে এত করে সাধারণ মানের কিছু রাজপোশাক পাওয়া যাবে। একই সাথে কম ভাড়ায় পলাশ বেছে নিল একটা ভোতা তলোয়ার। কিন্তু মুকুট ভাড়া নেওয়া মতো অবশিষ্ট টাকা তাদের নেই। পলাশ আর রাজু দোকানদারকে তার সমস্যার কথা বুঝিয়ে বললো।
দোকানদার
জানালেন তাদের দোকানে পরিত্যাক্ত একটা মুকুট আছে।
যেটি আকারে ও মাপে অনেক বড়। পেছনের
কিছুটা অংশ ভাঙ্গা। সেটি
তিনি পলাশকে বিনা ভাড়ায় দিতে
পারেন। পালাশ এতেই খুশি হলো।
কিন্তু দোকানদার মুকুটটি নিয়ে এলে সেটি
পলাশের পছন্দ হলো না। কিন্তু
উপায় নেই। কাল নাটক
মঞ্চস্থ হবে। মুকুট না
পেলে মহাঝামেলা হবে। তাই পলাশ
অনিচ্ছা সত্বেও নিবে বলে ঠিক
করলো। কিন্তু মুশকিল হলো মুকুটটি এত বড় যে
মাথায় দেওয়া মাত্রই পলাশের মাথা গলিয়ে গলায়
মালার মতো হয়ে যাচ্ছে। দোকানদার
একটা তারের টুকরো দিয়ে মুকুটটির পেছনদিকে শক্ত করে বেঁধে
দিলেন। এতে করে মুকুটটির পেছনের ভাঙ্গা অংশটি জোরা লেগে গেল
এবং ছোট হয়ে পলাশের
মাথায় ঠিকঠাক বসে গেল। পলাশ
এতেই খুশি। নিয়ে নিল সে
মুকুটটি।
ষষ্ঠশ্রেণীর
ছাত্রদের নিয়ে শিক্ষক যথা
সময়ে হাজির হলেন প্রতিযোগিতায়। পলাশদের
নাটক মঞ্চস্থ হবে বার নম্বরে।
বিভিন্ন স্কুল থেকে ছেলেমেয়েরা এসেছে।
সাজঘরে কেউ পোশাক পড়ছে, কেউ মেকআপ করছে,
কেউ সংলাপ মুখস্থ করছে, চারিদিকে হৈহৈ চলছে। রাজীব ছেঁড়া লুঙ্গি পড়ে আর ময়লা
গামছা কাঁধে নিয়ে কৃষকের সাজে
প্রস্তুত।
এদিকে
পলাশ এতবড় রাজ পোশাক
কিছুতেই সামলাতে পারছে না। এক জায়গায়
পিন লাগায় তো আরেক জায়গায়
ঢিলে হয়ে যায়। এভাবে
করতে করতে নিজেই নিজের
কাছে অসহায় বোধ করে। পলাশের
ঝামেলা দেখে রাজীব লুকিয়ে
পলাশের মুকুটটার ভাঙ্গা অংশের জোরা লাগানো তারটি
খুলে ফেলে দিল। এতে
করে মুকুটটি আবার হা হয়ে
বড় গেল। এদিকে এগার নম্বর নাটক
মঞ্চস্থ হচ্ছে। শিক্ষক এসে তাগাদা দিলেন
এরপর তোমাদের পালা, সবাই প্রস্তুত তো?
একি
রাজাই যে প্রস্তুত নয়!
রাজাকেই তো আগে প্রবেশ
করতে হবে! শিক্ষক এসে
পলাশকে বকাঝকা করে পোশাক ঠিক
করে দিতে লাগলেন। রাজিব
দূরে দাড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। সব ঠিক এবার
মুকুট পরাতে হবে। মুকুট পরাতে
গিয়ে দেখে ইয়া বড় একটা
মুকুট। তাও আবার পেছনের
অংশ ভাঙ্গা। পলাশের মাথায় দিতেই তার মাথা গলিয়ে গলায়
গিয়ে আটকে থাকছে মালার
মতো। কোন প্রকারেই সেটিকে
মাথায় পড়ানো যাচ্ছে না। একজন এসে
তাগাদা দিলেন, ‘স্যার এবার আপনার স্কুলের
পালা’
স্যার
বললেন, ‘আমাদের দুই মিনিট সময়
দাও।‘
না কোন ভাবেই মুকুটটিকে
ছোট করা যাচ্ছে না।
আর পলাশকে রাজা বানানো যাচ্ছে
না।
হঠাৎ
রাজীব এসে বললো, ‘স্যার
এই মুকুট আমার মাথায় ঠিক
হবে।‘
স্যার
বললেন, ‘নে পড়ে নে,
তুই রাজা হ। পলাশ
তোর রাজার পোশাক খুলে দে রাজীবকে।‘
পলাশ
অবাক হয়ে গেল।
‘না
স্যার এখনই আমি মুকুট
ঠিক করে নিচ্ছি।‘
‘কিভাবে
ঠিক করবি। সময় নেই।‘ বলেই
স্যার পলাশের গায়ের কাপড় খুলে রাজীবকে
পরাতে লাগলেন। পলাশের চোখ দিয়ে টপ
টপ করে জল পড়তে
লাগলো। রাজীব লুঙ্গি আর গামছা খুলে দিলো পলাশকে।
পলাশ কাপড় না পড়ে
ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। শিক্ষক রাজীবকে প্রস্তুত করে মঞ্চে তুলে
দিয়ে পলাশকে সাজাতে লাগলেন। কিন্তু পলাশের কান্না যে থামছেই না।
স্যার
বললেন, ‘ভালমতো অভিনয় করিস পলাশ। তোর
উপর যে আমাদের স্কুলের
মান-সম্মান জড়িয়ে আছে।‘
এদিকে
রাজীব একটু হেসে, একটু
তুতলিয়ে, মাথা চুলকিয়ে কোন
রকমে রাজার সংলাপ বললো। রাজা সৈন্যদের আদেশ
দিলেন যে কৃষক খাজনা
দিতে পারে নি তাকে
রাজ দরবারে ধরে নিয়ে আসার। সৈন্যরা
গেল কৃষক অর্থাৎ পলাশকে
ধরে আনতে।
পলাশ
যে কাঁদছে, কাঁদছেই। থামছেই না। যেখানে দাঁড়িয়ে
ছিল সেখানেই আছে। সাজঘর থেকে স্যার জোর
করে পলাশকে ধরে এনে সৈন্যদের
হাতে তুলে দিয়ে বললেন,
‘ওকে জোর করে ধরে
নিয়ে যা।‘
পলাশকে
সত্যি সৈন্যরা জোর করে টেনে
হিঁচড়ে মঞ্চে নিয়ে গেল। মঞ্চে
রাজীবকে রাজপোশাকে রাজাসনে দেখে পলাশের কান্না
আরো দ্বিগুণ হয়ে গেল। সে
জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।
রাজা প্রশ্ন করলেন, ‘কিরে এবার খাজনা
দিস নি কেন?’
পলাশের
বুকটা অভিমানে-দুঃখে ফেটে তখন চৌচির।
হঠাৎ পলাশের মনে পড়লো স্যার
বলেছেন তার উপর স্কুলের মান-সম্মান নির্ভর
করছে। তাই পলাশ রাজীবের সংলাপগুলো
আকাশ বিদারী আর্তনাদের সাথে তাল মিলিয়ে বলে
চললো, ‘মহারাজ আমাকে এই বারের মতো
ক্ষমা করুন। ক্ষেতে যে এবার ফসল
হয় নি। ঘরে আমার
বাবা, মা, ছোট বোন।
এদের মুখে একবেলা অন্ন তুলে দিতে
পারছি না। খাজনা দেব
কি করে মহারাজ? ক্ষমা
করুন আমায় ক্ষমা করুন। আমি যে দরিদ্র।‘
কৃষকের
কান্নায় রাজার মন গললো না।
রাজা হুকুম দিলেন, কৃষকের শিরচ্ছেন করা হোক। পলাশ গগন বিদারী
চিৎকার করতে লাগলো, ‘মহারাজ
দয়া করুন, দয়া করুন।‘
পলাশের
আর্তনাদে আর চোখের জল তখন আর
কেবল পলাশের বুক আর চোখের
মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইলো না বরং
তা ছড়িয়ে পড়লো পুরো দর্শকমহলে।
সবার চোখে জল। খাজনা
দিতে না পারায় কৃষক পলাশের শিরচ্ছেদ
করা হবে। পলাশ চিৎকার করে প্রানভিক্ষা চাইছে এমন করুন একটা দৃশ্য
মঞ্চে ফুটিয়ে তোলা কেবল পলাশের
পক্ষেই সম্ভব। সৈন্যরা পলাশকে মঞ্চ থেকে টেনে
হিঁচড়ে নামিয়ে আনলে
শিক্ষক চোখের জল মুছতে মুছতে
পলাশকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বাঘের
বাচ্চা, তুই যে স্কুলের
মান রেখেছিস।‘
বাইশটি
স্কুলের নাটক মঞ্চস্থ শেষ।
এবার পুরস্কার দেওয়ার পালা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাংস্কৃতিক মন্ত্রী ঘোষণা করলেন, আজকের এই নাটকগুলো থেকে
একজন অভিনয় শিল্পীকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হবে। যার অভিনয়
সবার মন ছুঁয়ে গেছে। সেই দক্ষ শিল্পীটি আর কেউ নয়,
পলাশ। পলাশকে মঞ্চে ডাকা হলো পুরস্কার
নেওয়ার জন্য। পলাশের শিক্ষক অত্যান্ত খুশি। তিনি বললেন ‘পলাশ
যাও তোমার পুরস্কার নিয়ে এসো।‘ পলাশের কান্না তখনো থামেনি। পলাশ
কাঁদতে কাঁদতে মঞ্চে উঠলো পুরস্কার আনতে। সাংস্কৃতিক মন্ত্রী বললেন, ‘তুমি তো খোকা
আজ আমার চোখে জল
এনে দিয়েছ। এত সুন্দর অভিনয়
করো তুমি! নাটক মঞ্চে তুমি
দুঃখী কৃষকের অভিনয় করে কেঁদেছ আর এখন পুরস্কার নিতে
এসে আনন্দে কাঁদছ।‘
পলাশ
চোখের জল মুছতে মুছতে
বললো, ‘না স্যার, আমি
আনন্দে কাঁদছি না।‘
‘তাহলে
এই আনন্দের সময় কাঁদছ কেন?’
‘আমার
আজ রাজার ভূমিকায় অভিনয় করার কথা ছিল
স্যার। কিন্তু আমি টাকার অভাবে রাজার
সঠিক পোষাক যোগার করতে পারি নি
বলে জোর করে আমাকে
কৃষকের চরিত্রে অভিনয় করানো হয়েছে।‘
পলাশের কথা
শুনে আবারও দর্শকদের চোখ
জলে ভিজে গেল। সাংস্কৃতিক
মন্ত্রী বললেন, ‘আজ তুমিই
হলে
সত্যিকারের রাজা।‘
মন্ত্রী
ঘোষণা দিলেন পলাশের অভিনয় দেখে খুশি হয়ে
তিনি রাজার অভিনয় করতে যা যা
দরকার পলাশকে উপহার দিবেন।
এরপর
যে বাইশটি স্কুল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল সেই বাইশটি স্কুলে
পলাশদের নাটক প্রদর্শন করা
হলো। প্রতিটি প্রদর্শনীতে পলাশ রাজার ভুমিকায় অভিনয় করেছিল।
শ্রীলংকান বন্ধু লেখক শ্রী-লাল নানায়াকারা (Sri Lal Nanayakkara) এর লেখা
‘সিরি রাজা সিরি’ গল্পের ছায়া অবলম্বেনে।
আরও গল্প পড়তে ক্লিক করুন
No comments