Header Ads

মামীর বান্ধবীর বাড়ীতে একদিন

 

বন্ধুত্ব 


আমার মামী খুব ছোটবেলায় তার বাবা-মাকে হারিয়ে তুমিলিয়া সিষ্টারদের হোষ্টেলে বড় হয়েছেন। বাবা-মা হারানোর কষ্ট আর হোষ্টেল জীবনের নতুন পরিবেশে ছোট্ট মেয়েটি চোখের পানি নাকের পানি এক করে যখন দিন কাটাতে শুরু করলো তখনই হোষ্টেলে আরো এক ছোট্ট মেয়ের আবির্ভাব ঘটলো। মেয়েটির নাম নির্মলা। কেমন করে যেন মামীর সাথে নির্মলার খুব দ্রুত বন্ধুত্ব হয়ে গেল। দুই বান্ধুবী মিলে এক সাথে মনের সুখদুঃখের কথা বলেকয়ে হোষ্টেল জীবনে বেশ মানিয়ে নিল। বলতে দ্বীধা নেই আমার মামী হোষ্টেলে সিস্টারদের তত্ত্বাবধানে থেকে কাজে কর্মে খুব পটু হয়ে উঠেছিলেন।

দেখতে শুনতে মিষ্টি হওয়ায় নবম শ্রেণী পাশ করলে কোন এক ছুটিতে বাড়ী এলে আমার মামার সাথে মামীর বিয়ে হয়ে গেল। সেই সাথে মামী হারালেন তার সেই হোষ্টেলের প্রাণপ্রিয় বান্ধুবীকে। চোখের আড়াল হলেও মামী তার বান্ধবীকে কখনই ভুলতে পারেন নি। তাইতো গাজীপুর-ভাওয়াল এলাকার কাউকে পেলেই মামী তার বান্ধবীর খোঁজ-খবর করতেন। তবে মামীর বিয়ের ত্রিশ বছরের মধ্যে তেমন কেউই তার বান্ধবীর খোঁজ দিতে পারেন নি।

সৌভাগ্যবশত ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে নবাবগঞ্জে বদলি হয়ে আসা খ্রিষ্টান এক প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে মামী জানতে পারলেন যে মামীর বান্ধবীই হচ্ছেন সেই কর্মকর্তার ছোট বোন। মামী সেই কর্মকর্তার মাধ্যমে চিঠিপত্রের দ্বারা বান্ধবীর সাথে যোগাযোগ শুরু করলেন এবং আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই জুন বক্সনগর গ্রামের গির্জার এক অনুষ্ঠানের আগের দিন বড় ভাইয়ের সাথে মামীর বান্ধবী মামীর বাড়ীতে এসে উপস্থিত হলেন।

আমার মামী তার ছেলেবেলার বান্ধুবীকে পেয়ে কি যে খুশি হলেন তা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। মামী তার সদ্য কেনা এক নতুন সুতির শাড়ী বান্ধবীকে পড়তে দিলেন। বান্ধবী পান খান বলে একমাস খেতে পারবেন সেই পরিমান পান এবং রঞ্জিত মল্লিকের ছবি দেখতে পছন্দ করেন বলে মামী তার বান্ধবীর জন্য আটটি সিনেমা ভাড়া করে আনলেন।

গর্জার পর্বের সময় এমনেতেই অনেক মানুষের সমাগম হয়। রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে মামী বান্ধবীর জন্য তিন রকমের পিঠা বানালেন। আমার মামীর মেয়ের ঘরের এক ফুটফুটে নাতনী ময়না, ওর বয়স তখন পাঁচ বছর। মামীর বান্ধবীর সাথে আমার সেই ভাগনীর খুব ভাব হয়ে গেল। এরপর বান্ধবীর সংখ্যা আর দুজনে সীমাবদ্ধ রইলো না, হয়ে গেল তিনজন আর তিন বান্ধবী সারারাত গল্প করে কাটালো।

পর্ব উপলক্ষ্যে মামী পনের’শ টাকা দিয়ে একটি শাড়ী কিনেছিলেন। পরের দিন সকালে মামী তার বান্ধবীকে সেই নতুন শাড়ীটি শুধু পড়তেই দিলেন না যাওয়ার সময় মামী বান্ধবীকে শাড়ীটি উপহার হিসেবে দিয়ে দিলেন। পর্বের দিন গির্জা থেকে এসে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করার পর বান্ধবীর যাওয়ার পালা। দুই বান্ধবীর সেকি অশ্রুসজল বিদায়ক্ষণ। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। দুই বান্ধবীর সাথে কান্নায় যুক্ত হলো মামীর নানতী। আমরাও গেলাম বিদায় দিতে। মামীর বান্ধবী আমাদের খুব করে তাদের বাড়ীতে যেতে অনুরোধ করলেন। বান্ধবী যাওয়ার পর মামী দুইদিন বেশ মনে খারাপ করে রইলেন।

তখন ফোন এত সহজলভ্য ছিল না তাই পরবর্তী কোন খবরবার্ত আর জানা যায় নি। সময় এবং সুযোগের অভাবে মামীরও বান্ধবীর বাড়ীতে যাওয়া হয় নি। এর প্রায় বছর খানেক পর হঠাৎ একদিন মামী জানতে পারলেন যে তার বান্ধবীর বড়ভাই যার মাধ্যমে মামী বান্ধবীকেখুঁজে পেয়েছিলেন তিনি দুই মাস আগে মারা গেছেন। শনিবার খবর পেয়ে মামী সিদ্ধান্ত নিলেন পরের দিন রবিবার মামী তার বান্ধবীর বাড়ীতে যাবেন।

আমি তখন এসএসসি পরীক্ষা লিখে বিশাল অবসরে আছি। মামীর সহযাত্রী হলাম আমি আর মামীর ছোট নাতনী ময়না। গাজীপুরের ভাওয়াল এলাকায় আমাদের আগে কখনো যাওয়া হয় নি। মামীও থেকেছেন প্রায় ত্রিশ/পঁয়ত্রিশ বছর আগে। রাস্তাঘাটের অনেক পরিবর্তন। আমরা বক্সনগর থেকে বাসে করে গেলাম জিনজিরা। সেখান থেকে সিএনজি নিয়ে গেলাম গুলিস্থান কালিগঞ্জের বাস ধরবো বলে। মামীর বান্ধবীর বাড়ী করান গ্রামে। কিন্তু সেখানে যেতে হলে কোথায় নামতে হবে জানা নেই। তাই কন্ডাক্টারকেই জিগ্যেস করলাম। কন্ডাক্টার বললেন, কালিগঞ্জ নেমে রিক্সা নিয়ে নাগরী যেতে হবে। সেখান থেকে হেঁটে করান গ্রামে যেতে হবে।

আমরা যখন কালিগঞ্জ বাসষ্ট্যান্ডে নামলাম তখন বিকেল চারটা। রিক্সা নিয়ে তুমিলিয়া পার হয়ে নাগরী আসতেই নাগরী বাজারে দেখা হয়ে গেল আমার এক দূরসম্পর্কের পিসির সাথে। পিসি তো নাছোরবান্ধা, জোর করে আমাদেরকে তার বাড়ী নিয়ে যাবেন। এদিকে মামীও তার বান্ধবীর বাড়ীতে যাওয়ার জন্য অস্থির। পিসির একটাই অনুরোধ তার বাড়ীতে না থাকলেও অন্তত এক কাপ চা খেয়ে যেতে হবে। আমরা পিসিকে আমাদের আগমনের বৃত্তান্ত জানিয়ে পরেরদিন পিসির বাড়ী যাব বলে কথা দিলাম। আমার পিসাতো ভাই পঙ্কজ তখন মাঠে খেলছিল। আমরা যে মামীর বান্ধবীর বাড়ী চিনি না তা জেনেপিসি পঙ্কজকে আমাদের সঙ্গে অনেকটা জোর করে পাঠিয়ে দিলেন। আমরা পঙ্কজের সাথে মামীর বান্ধবীর বাড়ীর দিকে হাঁটা দিলাম। কথায় কথায় জানলাম মামীর বান্ধবীর ছেলে রতন পঙ্কজের বন্ধু।

সারাদিনে তেমন কিছুই খাওয়া হয় নি। ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত। সাথে আবার ছোট ময়না বেচারীর হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। রাস্তা যেন ফুরাচ্ছিলই না। যাই হোক, মামীর বান্ধীর বাড়ীর সামনে যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা হয় হয়। তাই মামী বারে বারে পঙ্কজকে চলে যাওয়ার জন্য বললেও পঙ্কজ আমাদের সঙ্গে রয়ে গেল।

মামীর বান্ধবীর বাড়ীর সামনে সুপারী পাতা দিয়ে বেড়া দেওয়া। মাঝখানে বাঁশের গেইট আছে। পঙ্কজ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ওর বন্ধুকে ডাকতে লাগলো, ‘রতন রতন বাড়ী আছিস? ‘

কেডা?’

আমি পঙ্কজ।

কি হইছে?’

দেখ কেডা আইছে।

একটু পড়ে কমলা রঙের গেঞ্জি পড়া সুদর্শন এক যুবক বাইরে এলো। আমাদের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে দেখে পঙ্কজকে প্রশ্ন করলো, ‘এরা কেডা?’

এরা নবাবগঞ্জের আঠারগ্রামের মানুষ। এইডা আমার মামী অয়। এই মামী তর মার বান্ধবী।

ছেলেটি চোখমুখ কুঁচকে বললো, ‘কি?’

মামী বললেন, ‘তোমার মা বাড়ী নেই?’

ছেলেটি আমতা আমতা করে বললো, ‘মায় আছে। মার শরীলডা বেশী বালো না।

তখনই ভেতর থেকে একটি নারী কন্ঠ শোনা গেল, ‘রতন কেডা আইছে

‘তুমি থাহ আমি আইতাছি। আপনেরা খারান আমি দেহিবলেই ছেলেটি বাড়ীর ভেতরে চলে গেল। আমরা তখনও বাড়ীর বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। অনেকক্ষণ পর ছেলেটি আর মা ফিরে এলেন। আমার মামী তার বান্ধীকে দেখে যতটা খুশি হলেন মামীর বান্ধবী তার চেয়েও বেশী বিরক্তি নিয়ে আমাদের দেখতে লাগলেন। তিনি এসেই উদ্ভট এক প্রশ্ন করে বসলেন যার জন্য আমাদের চারজনের কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি বললেন, ‘আপনারা কেডা?’

আমার মামীর মুখের সব খুশি যেন এক নিমিষেই মিলিয়ে গেল। মামী বললেন, ‘আমি মেরী বক্সনগরের মেরী।

কোন মেরী? বক্সনগর আবার কোতায়?’

আমারে চিনস নাই। আমরা দুইজন একসাথে তুমিলিয়া হোষ্টেলে আছিলাম। গত বছর তুই তোর ভাইয়ের সাথে আমাগো বাড়ীতে গেছিলি।

কি কন আপনে? আমি তো আপনেরে কোন দিন দেহিই নাই।

এই কথা শুনে আমি মহিলাকে আরো ভাল করে দেখতে লাগলাম। না ঠিকই তো আছে। ইনি তো সেই মহিলাই। যিনি গত বছর মামীর বাড়ীতে থেকে এসেছেন। এই এক বছরে মহিলার তেমন কোন পরিবর্তন হয় নি। সেই চোখ, সেই নাক, সেই পান খাওয়া মুখ। কিন্তু মহিলা না চেনার ভান করছেন কেন?

মামী বললেন, ‘তোর ভাই মি. জন নাহ?’

হ। হে তো তিন মাস আগে মারা গেছে।

মি. জন আগে নবাবগঞ্জে ছিলেন নাহ?’

ছিল তো

তুই উনার সাথে আমাদের বাড়ীতে জুন মাসের ১২ তারিখে গেছিলি মনে নাই?’

ভাইয়ে কাম করছে ভাইয়ের জায়গায়। আমি উনে যামু কোন দুঃখে?’

তখন ছেলেটি বললো, ‘মায় যখন কইতাছে এলাকায় মায় কোনদিন যায় নাই। আপনে জোর করতাছেন ক্যান। আর মায় গেলে আমরা জানতাম নাহ। মায় কি আমাগো না কইয়া যাইবো।

আমরা সবাই চুপ। ছেলেটি তখন আরো বিজ্ঞের মতো বললো, ‘আপনেরা মনে হয় অন্য কারো লগে মায়রে মিলায়া ফালাইছেন।

আমি মামীর দিকে তাকিয়ে দেখি মামীকে খুব অসহায় লাগছে। এদিকে পঙ্কজের সামনেও মামী হয়তো অপমান বোধ করছিলেন।

মহিলাটি বললেন, ‘এতদূর থেকে আসছেন যহন একটু সরবত খাইয়া যান।‘

আমার তখন রাগে শরীর থরথর করে কাঁপছিল। এদিকে মামী সরবত খাওয়ার জন্য ভেতরে যেতে রাজি হয়ে আমাকে বললেন, ‘চল ভেতরে যাই।‘

আমি বললাম, ‘না মামী আমি ভেতরে যাব না।‘

‘ও মনে হয় ভুলে গেছে একটু মনে করিয়ে দিলেই ওর সব মনে পড়বে।‘

আমাদের বারান্দায় বসিয়ে লেবুর সরবত দেওয়া হলো। একদিকে মহিলাটি মামীর সাথে আপনি আপনি করে মেপে মেপে কথা বলে চলেছেন আর অন্যদিকে মামী প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন বান্ধবীর হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে আনার। কিন্তু কোন কাজই হলো না। মামী অসহায়ভাবে হাল ছেড়ে দিলেন। এই বান্ধবীর স্মৃতিশক্তি আর কোন দিন ফিরে আসবে না তা বুঝতে পেরে। আমি আর ময়না চুপ করে বসে রইলাম। কি করবো এখন আমরা? কোথায় রাত কাটাবো?

হঠাৎ পঙ্কজ বললো, ‘মামী চলেন রাত হয়ে যাচ্ছে। মা আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

মামী আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমি বললাম, ‘মামী চলো উঠি।‘

আমরা মামীর বান্ধবীর বাড়ী থেকে চলে এলাম। মামীর বান্ধবী আর ছেলেটি সুপারী পাতার গেইট পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দিলেন। আমরা আর পেছনে তাকাই নি। আমি শুধু মামীর চোখের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি মামীর দুচোখ ভিজে উঠেছে।

পিসির বাড়ীতে গেলে পিসি কি যে খুশি হলেন তা বলার মতো না। মোড়গ-মুরগী খোয়ারে ঢুকে যাওয়ায় পিসি অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে খোয়াড় থেকে পালা বড় মোড়গটা জবাই করে রান্না করে খাওয়ালেন। সময়টুকুর মধ্যে যতটুকু পারলেন খাতির যত্নের কমতি করলেন না। পরের দিন সকালে নাস্তা করে আমরা বাড়ীর পথে রওনা হলাম।

রাস্তায় মামী আমাদের বলে দিলেন তার বান্ধবীর বাড়ীতে কি হয়েছিল আমি আর ময়না যেন কাউকে কিছু না বলি। সত্যি বাড়ী এসে আমি কাউকে কিছু না বললেও আমাদের ছোট্ট ময়নাটা হরবর করে সবাইকে সব বলে ফেললো। সবার মনে কৌতুহল, সত্যি মামীর বান্ধবী এমন করেছিলেন?

আমার মনে এখন পর্যন্ত প্রশ্ন কেন মহিলাটি আমাদের সাথে বিশেষ করে আমার মামীর সাথে এমন করেছিলেন?

এখানেই আমার লেখাটা শেষ করবো বলে ঠিক করেছিলাম। আমার স্বামী এসে বললেন, ’কি লিখছো?’

ওকে পুরো গল্পটা শুনালাম। পুরোটা শুনে বললো, ‘তোমাকে তো বুদ্ধিমতিই মনে করতাম। তুমি বুঝতে পারনি কেন মহিলা তোমার মামীকে চিনতে পারেন নি?’

আমি বললাম, ‘না এখনো আমার মাথায় ঢুকছে না কেন মহিলাটা এমন করলেন?’

বললো, ‘তোমার মামীকে আপ্যায়ন করার মত আর্থিক সামর্থ্য ঐদিন তোমার মামীর বান্ধবীর ছিল না।

সত্যি বিষয়টা আমার মাথায় কোনদিন আসেনি। হয় তো তাই। মনে মনে মহিলার প্রতি একটা ক্ষোভ ছিল। তবে এই ঘটনা নিয়ে মামীর সাথে আমার পরবর্তীতে কোন দিন কোন কথা হয় নি। তবে আজ মামীকে বলবো, মামী সত্যি হয়তো তোমাকে আপ্যায়ন করার সামর্থ্য তোমার বান্ধবীর সেই দিন ছিল না।

মামীর বান্ধবী জানিনা আপনি এখন কোথায় আছেন কেমন আছেন? প্রার্থনা করি যেখানেই থাকুন ভাল থাকবেন। আপনার প্রতি আমাদের আর কোন ক্ষোভ, রাগ বা অভিমান নেই।


আরও পড়ুন  

পলাশের রাজা সাজা 

অনুভুতি

আজব নারিকেল 

No comments

Theme images by Deejpilot. Powered by Blogger.