যেভাবে আমি রুটি বানাতে এক্সপার্ট হলাম
রুটি |
অষ্টম শ্রেণী থেকে আমি গোল্লা সেন্ট থেক্লারস বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছি। থাকতে হয়েছিল গোল্লা হোস্টেলে। প্রথম দিকে মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট হয়েছিল। চার ভাইয়ের পর আমি একমাত্র বোন। খুব আদরের ছিলাম। বাড়িতে কখনো কোন কাজ করিনি। খাওয়া, ঘুম, খেলা আর লেখাপড়া এইটুকুই ছিল আমার সারাদিনের রুটিন।
হোস্টেলে গিয়ে পড়তে হল মহা ঝামেলায়। জানুয়ারি মাস। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠা, ঠাণ্ডা পানি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে সকালের প্রার্থনায় বসা। এরপর গির্জায় যাওয়া অনেক কষ্টের ব্যাপার ছিল। আরও একটা কাজ ছিল পালা করে সকালে সপ্তাহে একদিন সব মেয়েদের জন্য রুটি বানাতে হত।
আমি
আগে কখনো রুটি বানাইনি। রুটি কিভাবে বানায় সে সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমার সাথে ছিল
আমার আরেক সহপাঠী যে কিনা দুই বছর আগে থেকেই হোস্টেলে ছিল। ভাবলাম যাক, ও যেহেতু পুরানো নিশ্চয়ই ও রুটি বানাতে জানে। আমি কোনমতে রুটি বেলে দিতে পারব।
ভোর
পাঁচটায় রান্নাঘরে গিয়ে দেখি দুই প্যাকেট আটা রাখা আছে। সহপাঠীর সাথে আলাপ করে জানা
গেল সে রুটি বানানোর কোন প্রসেসই জানে না। আগে সে বড়দিদিদের সাথে এসে শুধু বিভিন্ন
দেশের ম্যাপ বানাত।
পড়লাম
মহা ঝামেলায়! কি করা যায়? রান্নাঘরে ছিল বড় একটা জগ। ভাবলাম যেহেতু দুই প্যাকেট আটা
তাই দুই জগ পানি দিলেই হবে। আমার সহপাঠী আগে রুটি বানাতে এসে কি দেখেছিল সেই অভিজ্ঞার
আলোকে দুই জগ পানি কড়াইতে দিয়ে চুলায় বসালাম। এদিকে চুলার আগুন ভালমত জ্বলছে না। ধুঁয়ায়
রান্নাঘর ছেয়ে গেছে। এরই মধ্যে সহপাঠী ঠাণ্ডা পানির মধ্যে দুই প্যাকেট আটা ঢেলে দিল।
খুন্তি দিয়ে ঘুঁটা দিতেই আটা-জল মিশে তরল দুধের মত হয়ে গেল। আটাগোলা পানি দেখে দুজনেরই কান্না-কাটি করার
অবস্থা।
হঠাৎ মনে পড়ল আরেক সহপাঠীর কথা যে কি-না খুব ছোটবেলাতেই বাবা-মাকে হারিয়ে এতিমখানায় বড় হয়েছে। মেয়েটির নাম দীপালি, আমার সাথেই হোস্টেলে নতুন এসেছে। তবে যেহেতু সে এতিমখানায় সব কাজই করত তাই সব কাজেই সে পারদর্শী। আমাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে দীপালিকে ডাকতে গেলাম। দীপালি রান্নাঘরে এসে আমাদের অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে প্রায় লুটিয়ে পড়ে। ওকে অনুরোধ করলাম এই যাত্রায় আমাদের রক্ষা করতে।
দীপালি খুবই চটপটে। সে তৎক্ষণাৎ চলে গেল আমাদের রাঁধুনি মাসির ঘরে। রাঁধুনি মাসি শীতের সকালে লেপমুড়ি দিয়ে আয়েশ করে ঘুমাচ্ছেন। কারন তার দায়িত্ব শুধু
দুপুর এবং রাতের খাবার রান্না করা। সকালের খাবার হোস্টেলের মেয়েদেরই প্রস্তুত করতে
হয়।
যাই হোক, দীপালি ঘুমন্ত রাঁধুনি মাসির আঁচল থেকে গুদামের চাবি এনে গুদাম খুলে আরও দুই প্যাকেট আটা নিয়ে আসল। এরপর আগে গুলানো আটার সাথে মিশিয়ে আটার গোলাকে ঠিক করে ফেলল। তখন দেখা গেল আটার পরিমান হয়ে গেছে দ্বিগুণ। দীপালি অর্ধেক আটার গোলা নিয়ে গোয়াল ঘরে গরুর গামলায় রেখে আসলো। যেহেতু দেরি হয়ে গেছে তাই দীপালি রুটি বানাতে আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা করল। দীপালি একাই রুটি বেলে দিল আর আমরা দুইজন ভাজলাম। আরেক চুলায় চা-ও হয়ে গেল। যথা সময়ে মেয়েরা এসে খাবার নিয়ে গেল। আমাদের উদ্ধারকর্তা দীপালিও চলে গেল।
রুটি বানানোর পালা যেহেতু আমাদের তাই আমাকে আর আমার সহপাঠিকে হাড়ি-পাতিল ধুয়ে, রান্নাঘর
পরিস্কার করে তারপর যেতে হবে। ঠিক তখনই আরেক বিপত্তি শুরু হল। আমাদের ইনচার্জ সিস্টার
এসে হাজির। তিনি গির্জা থেকে ফিরে বাগান দিয়ে হেঁটে গোয়ালঘরের পাশ দিয়ে আসার সময় আটার
দলা দেখতে পেয়েছেন।
সিস্টার আমাদের কাছে জানতে চাইলেন। আমার সহপাঠী চুপ করে থাকলেও আমি সত্যি কথাটাই বললাম। আমাদের শাস্তি দেয়া হল। আধাঘণ্টা কানেধরে হাঁটুগেড়ে থাকতে হবে এবং সেদিন আমাদের সকালের খাবার দেয়া হবে না।
আমরা দুইজন হাটুঁগেড়ে কানেধরে আছি। তবে আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। বাড়ির কথা মনে হচ্ছিল, মায়ের
কথা মনে পড়ছিল। মেয়েরা দল বেঁধে স্কুলে চলে গেল আমাদের সামনে দিয়ে। অনেকে আমাদের দেখে আবার মিটিমিটি হাসছিল। লজ্জায় অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল তখন। আধাঘণ্টা হয়ে গেলে সিস্টার বললেন স্কুলে
যেতে। ক্ষুধার্ত পেটে চোখ মুছতে মুছতে স্কুলে গিয়েছিলাম।
সেদিন
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। রুটি তোর জন্য এতোকিছু তোকে আমি বানিয়েই ছাড়বো। এখন আমি
আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি আমার মতো রুটি বানাতে এক্সপার্ট পৃথিবীতে খুব কমই আছে।
No comments