নুপুর-২
সুর্যনগর গ্রামের মাতব্বরের নাতী প্রদীপ এখন বিশ বছরের যুবক। জমিজমা বিক্রি করে পাড়ি জমিয়েছে আমেরিকায়। স্টুডেন্ট ভিসায় আমেরিকা গেলেও তার উদ্দেশ্য ছিল স্বপ্নের দেশে স্থায়ী হওয়া। তাই বিদেশে গিয়ে লেখাপড়ার দিকে না ঝুকে মাসদুই ফুর্তি করে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ল। দেশ থেকে নিয়ে আসা টাকা শেষ হলে সেখানে তার থাকা খাওয়াই দায় হয়ে পড়লো।
এখানে সেখানে চারপাঁচ ঘণ্টা কাজ করে ঠিকই তবে কাগজ-পত্র না থাকায় পারিশ্রমিকও পায় সামান্য। এদিকে কাগজ-পত্র করতেও টাকা দরকার। প্রদীপ যখন চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করল ঠিক সেই দুঃসময়ে প্রদীপের পরিচয় হলো পলাশ নামে এক বাংলাদেশীর সাথে। বিদেশের মাটিতে কোন দেশী মানুষকে বন্ধুরুপে পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া আর সেটা যদি হয় দুঃসময়ে।
পলাশ একটা রেষ্টুরেন্টের ম্যানেজার। প্রদীপের সাথে পরিচয়ের পর পলাশ প্রদীপের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিল। পলাশ তার রেষ্টুরেন্টে প্রদীপের জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিল এবং নিজের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করল। এছাড়া প্রদীপের যে কোন প্রয়োজনে পলাশ যতটা পাড়তো সহযোগিতা করতো। প্রদীপ সব সময়ই মনে করতো সে পলাশের কাছে ঋণী। প্রদীপ ফোনে তার বাবা মার সাথেও পলাশের পরিচয় করিয়ে দিল। প্রায়ই পলাশ প্রদীপের বাবা মার সাথে ফোনে কথা বলে। প্রদীপকে নিজের ভাইয়ের মতো দেখে রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রদীপের বাবা মা পলাশের প্রতি কৃতজ্ঞ, পলাশের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে উঠে।
পলাশ আমেরিকা আছে আট বছর। আট পর সে বাংলাদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করলো। প্রদীপকে জানায় সে দেশে একটা বাড়ী করতে চায়। প্রদীপের জানাশোনা কোন ভাল জায়গা আছে কি না তাও জিজ্ঞেস করে। প্রদীপ জানায় তার দাদা গ্রামের মাতব্বার ছিলেন। তার অনেক জানাশোনা আছে। পলাশ যদি চায় তো তার দাদা-বাবা মিলে তাদের এলাকায় একটা ভাল জায়গার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। প্রদীপের প্রস্তাবে পলাশ খুবই খুশি হলো। প্রদীপ বাড়ীতে জানালে তার বাবা সত্যিই তাদের গ্রামে বিক্রয়যোগ্য একটা জায়গা দেখে রাখলো।
পলাশ ছুটিতে দেশের বাড়ীতে যাবে শুনে প্রদীপ তার বাবামা ও ছোট ভাইয়ের জন্য অনেক কিছু পাঠালো। পলাশও প্রদীপের পরিবারের জন্য উপহার কিনলো। প্রদীপ খুবই খুশি। তার এই জীবনে সে অনেক বন্ধু পেয়েছে তবে তারা কেউ পলাশের মতো নয়।
পলাশ একাধারে তার বন্ধু ও বড় ভাই। পলাশ তাদের বাড়ী যাবে। তাই সে তার বাবামাকে ফোন করে জানিয়ে দিল তাদের বাড়ীতে গেলে পলাশের যেন কোন অযত্ন না হয়। পলাশ তাদের বাড়ী আসবে শুনে প্রদীপের বাবা-মা মেলা আয়োজন করলেন। বিদেশের মাটিতে পলাশ যেভাবে তাদের ছেলেকে আগলিয়ে রেখেছে সেটা কয়জনেই বা করে!
পলাশ প্রদীপদের বাড়ি এল। ছেলের খবর এবং উপহার পেলে প্রদীপের বাবা মা খুবই খুশি হলেন। পলাশ যে বাড়ী তৈরি করার জন্য জায়গা কিনতে চায় কথাটি প্রদীপের বাবা আগেই জানতেন। তাই তিনি খাওয়া দাওয়ার পর পলাশকে নিয়ে গেলেন জমি দেখাতে। গ্রামের একেবারে মাঝখানে জমি। প্রদীপের কাকার জমি। তিনি অসুস্থ চিকিৎসার খরচের জন্য জমি বিক্রি করছেন। জমি পলাশের পছন্দ হলো। যে দাম চাওয়া হলো সেই দামেই জমি কিনতে পলাশ রাজি হলো। পলাশ প্রদীপের বাবাকে জমি কেনার ব্যপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করার কথা বললেন। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই জমি কেনার সব বন্দোবস্ত হয়ে গেল। পলাশ নগদ টাকা দিয়ে জমি কিনলো।
পলাশ তিনমাসের ছুটিতে বাড়ী এসেছে। এই তিনমাসের মধ্যে জমি কিনে বাড়ী তৈরি করতে চায় সে। যেমন কথা তেমন কাজ। বাড়ি নির্মাণের কাজে পূর্ণ সহযোগিতা করলেন প্রদীপের দাদু আর বাবা। বাড়ী তৈরির কাজে যে কয়দিন পলাশকে থাকতে হলো সে প্রদীপদের বাড়ীতেই থাকলো।
পলাশ প্রদীপের বাড়ীতে নিজেকে পরিচয় দিল এভাবে-
পলাশ মায়ের একমাত্র ছেলে। খুব ছোট বেলায় তার বাবা মারা গেলে সে মায়ের সাথে নানাবাড়ী থাকতো। তার মা খুব কষ্টে তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। পলাশ বি এ পাশ করে চাকরি নিয়ে কুয়েতে যায়। কুয়েতে সে এক ভারতীয় পরিবারে ড্রাইভারের কাজ করতো। পরিবারের কর্তা পলাশের কাজে ও ব্যবহারে খুশি ছিল। সেখানে পাঁচ বছর কাজ করার পর ভারতীয় পরিবারটি পলাশকে নিয়ে আমেরিকায় চলে যায়। সেখানে পরিবারটি একটি রেষ্টুরেন্ট খুলে আর সেই রেষ্টুরেন্টেই পলাশ ম্যানেজার। পলাশের জীবনকাহিনী শুনে প্রদীপের পরিবারের সবাইর পলাশকে স্নেহের চোখে দেখে। তারা পলাশের সততাকে সাধুবাদ জানায়। এমন ছেলেকে গর্ভে ধারণ করেছেন বলে পলাশের মায়ের প্রশংসা করে।
এদিকে পলাশ প্রদীপের দাদুর সাথে পরামর্শ করে নতুন বাড়ী উদ্বোধনের দিন তারিখ নির্ধারণ করলো। ১৬ই জুন। বাড়ীর নাম হবে পলাশের মায়ের নামে। গ্রামের সবাইকে নিমন্ত্রণ করা হলো। পলাশ জানালো নতুন বাড়ী উদ্বোধণ করবেন তার মা নিজের হাতে। ১৬ তারিখ সকাল থেকেই পলাশের বাড়ীতে মহা ধুমধাম। পুরো গ্রামের মানুষদের দুপুরে খাবারের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে।
ডেকোরেটর আনিয়ে বড় প্যান্ডেল করা হয়েছে। চেয়ার টেবিল পাতা হয়েছে। অনেকদিন ধরেই পলাশের বাড়ী নির্মাণ নিয়ে গ্রামের সবার মধ্যে কৌতূহল কাজ করছিল। এতবড় আলিশান বাড়ী যে নির্মাণ করলো সে তো বিশাল বড় লোক। তাই অনেকে খাবার উছিলায় বাড়ীটাও একবার ঘুরে দেখার কৌতুহলে পলাশের বাড়ীতে এসেছেন। সবাই বাড়ী ঘুরে ঘুরে দেখছে। এই গ্রামে এমন সুন্দর বাড়ী আর কারো নেই। বাড়ীর চারপাশে উঁচু দেয়াল থাকায় বাইরে থেকে বোঝেই যায় নি যে বাড়ীর ভেতরটা এত সুন্দর।
বড় লোহার গেইট দিয়ে প্রবেশ করলেই সবুজ ঘাসের লন। নানা রংগের ফুলের বাহার চারিদিকে। ঠিক মাঝখানে একটি ফোয়ারা। সারাক্ষণ পানি ঝরছে।দোতলা পুরো বাড়ীটি দামী টাইলসে মোড়ানো। বসার ঘরে দামী সোফা সেট। আরো আছে পেইন্টেং। সিড়িতে লাল কার্পেট বিছানো। ফুলদানী ঝাড়বাতী সব মিলিয়ে যেন স্বর্গপুরী। পলাশের বাড়ী দেখে গ্রামের সবারই চোখ জুড়ালো এ কথা বলতেই হবে।
মহিলারা গুণগুণ ফুসফুস করতে লাগলেন যে যিনি বাড়ী করেছেন সত্যি তিনি কোটিপতি। যথা সময়ে খাবার পরিবেশন করা হলো। পোলাও কোরমা কয়েক পদের মাংস-মাছ বিশাল আয়োজন। সবাই খেতে বসেছে। খাবার পরিবেশন করা হয়েছে তবে এখনো বাড়ীর মালিক পলাশের মাকে দেখা যায় নি।
সবাই খেতে শুরু করলো। ঠিক সেই সময় পলাশ সবার সামনে এসে সবাইকে নমস্কার জানাল। পলাশের সাথে একজন মহিলা। দামী শাড়ী গহনায় মোড়া খুব সুন্দরী একজন মহিলা। পলাশ পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, 'ইনি আমার মা। এই বিলাশ বাড়ী মালিক।'
গ্রামের মহিলারা কেমন যেন অবাক হয়ে গেল। তারা একে অপরের মুখে চাওয়া চাওয়ি শুরু করলো। পলাশের মায়ের মুখটা যেন তাদের অনেক দিনের পরিচিত। কোথায় যেন তারা দেখেছে এই মহিলোকে।মহিলাটি অত্যান্ত বিনয়ের ভঙ্গিতে সব টেবিলের কাছে গিয়ে সবাইকে নমস্কার জানিয়ে বলতে লাগলেন, 'আপনারা দেখেশুনে খাবেন। কারো কিছু দরকার হলে বলবেন। আজকের এই আয়োজন আপনাদের জন্য।'
খাবার শেষ। সবাই অপেক্ষা করছে পলাশের মা বাড়ির নামের ফলক উন্মচন করবেন। পলাশ মাকে ডাকলো বাড়ী উদ্বোধন করার জন্য ফলক উন্মচন করতে। পলাশের মা এগিয়ে চললেন। হাঁটার সাথে সাথে নূপুরের শব্দ শোনা যেতে লাগলো। ঝুম, ঝুম, ঝুম। পলাশের মা সবার সামনে গিয়ে ফলক উন্নোচন করলেন। আস্তে আস্তে ফলকের উপরে ঢাকা পর্দা সরে গেল। ফলকে বড়বড় করে লেখা 'বিশাখা ভিলা'।
আরও গল্প পড়তে ক্লিক করুন
No comments