ভিখারির খোঁজে
ভিখারি |
১৯৯৫ সালের কথা। আমার নানা শ্বশুর মারা গেলেন। দিনটি ছিল বুধবার। নানা শ্বশুর ছিলেন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং এলাকায় খুবই গণ্যমান্য ব্যক্তি। নানা শ্বশুরের দুই ছেলেমেয়ে। আমার শাশুড়ি বড় আর মামা শ্বশুর ছোট। দুই ভাইবোন পিতার মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়লেন। শুক্রবার নানা শ্বশুরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হল। সেইদিন সন্ধ্যায় কাছের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে আলোচনা বসল মৃতের আত্মার কল্যাণে যে ভোজ দেয়া হবে সেই সম্পর্কে।
বাড়িতে কেউ মারা গেলে মুসলমানেরা যেমন কুলখানির আয়োজন করে, হিন্দুরা শ্রাদ্ধ করে, ঠিক তেমনি শ্রীলঙ্কায় সাতদিনের দিন যে ভোজের আয়োজন করা হয় তাকে বলা হয় দান। এই দান অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে মিটিং শুরু হল। এলাকার প্রায় পাঁচশো মানুষকে খাওয়ান হবে। কি কি রান্না হবে, এলাকার লোকজন ছাড়াও বাইরের গণ্যমান্য আরও কে কে আসবেন, বাড়ির কে কোন দায়িত্ব পালন করবে সেইসব।
এই আলোচনার মাঝখানে আমার মামা শ্বশুর বলে বসলেন তিনি পাঁচজন ভিখারি খাওয়াবেন। মামা শ্বশুরের কথা শুনে সবাই অবাক!
আপনারা কি ভাবছেন? মাত্র পাঁচজন ভিখারি খাওয়ানোর কথা বলায় সবাই অবাক হয়েছে? যদি সেটা ভেবে থাকেন তো ভুল। সবাই অবাক এজন্য যে পাঁচজন ভিখারি তারা কিভাবে যোগার করবে। কারন শ্রীলঙ্কায় ভিখারি পাওয়া খুবই মুশকিল। বিশেষ বিশেষ এলাকায় দুই/একজন মাঝে মাঝে দেখা যায় তবে নিয়মিত না। আর মামা শ্বশুর যে এলাকায় থাকেন সেখানে ভিখারি পাওয়া অসম্ভব।
মামা শ্বশুরের সার্বক্ষণিক বিশ্বস্ত একমাত্র শিস্য ছিলেন আমার স্বামী। মামা-ভাগ্নে ভিখারি খোঁজার কাজে কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন। আশেপাশের ও দূরদূরান্তের আত্মীয় স্বজনদের ফোন করে তথ্য যোগার করতে লাগলেন কোথায় পাওয়া যাবে ভিখারি।
গ্রীষ্মের দাবদাহে আকাশে মেঘ দেখা গেলে মানুষ যেমন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মামা শ্বশুরও স্বস্তিবোধ করলেন। কেননা দুরের এক আত্মীয় জানিয়েছেন, ওয়াত্তালা গির্জার সামনে রবিবার দিন মাঝে মাঝে দুই/একজন ভিখারি দেখা যায়।
রবিবারে নিজেদের গির্জায় না গিয়ে মামা-ভাগ্নে গেলেন বার কিলোমিটার দুরের ওয়াত্তালা গির্জায়। কাঙ্ক্ষিত ভিখারিদের দেখা মিলল। দুইজন ভিখারি গির্জার সামনে ভিক্ষা করছেন। একজন রোগা-পাতলা, কিছুটা দুর্বল প্রকৃতির। কথাও কম বলেন। অন্যজন একেবারে উল্টো। স্বাস্থ্য ভাল, হরবর করে কথা বলেন, একটু নেতা নেতা ভাব আছে। যাই হোক, মামা শ্বশুর তাদের আগমনের হেতু জানালেন।
পাঁচজনের কথা শুনে নেতা ভিখারি নিজেই যেন চিন্তায় পড়লেন। মাথা চুলকে বললেন,
'আমরা এখানে দুইজন। রাগামা ষ্টেশনে আছে একজন। রাগামা ষ্টেশনে আগে আরও একজন আসতো তবে মাস খানেক ধরে আসে না। সে নাকি গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। অসুবিধা নাই, তার পাশের বাড়ির ফোন (ল্যান্ড ফোন) নম্বর আছে। যোগাযোগ করে নিয়ে আসবো। আর বাকি একজন যে করেই হোক যোগার করা যাবে।'
কি আর করা একজন মৃত ব্যাক্তির আত্মার জন্য যে এই মানত।
গ্রামের বাড়ি যে ভিখারি গেছেন তাকে খবর দেয়া, তাকে কলম্বো আনা এবং পরবর্তীতে মামার সাথে যোগাযোগ করার জন্য মামা তিনশো টাকা নেতা ভিখারির হাতে দিয়ে এলেন। চূড়ান্ত হল আগামি বুধবার দুপুর বারটায় এই গির্জার সামনে থেকেই মামা পাঁচজন ভিখারিকে যাতায়াত খরচ দিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবেন।
আমার মামা শ্বশুর যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। কেননা অনেকেই বলেছিল পাঁচজন ভিখারি পাওয়া যাবে না। তাই মামা শ্বশুর নিন্দুকদের দেখিয়ে দিতে চান যে তিনি যা বলেন তা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।
সোমবার বিকেলে ফোন এল, গ্রামের ভিখারি শতভাগ নিশ্চিন্ত আসছেন। রাগামা যে ভিখারি আছে উনিও আসবেন। আর তারা দুইজন। মোট চারজন হয়েছে। আরেকজন অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তিনি তার এক আত্মীয়কে নিয়ে আসবেন যদিও আত্মীয়টি ভিখারি নন।
আত্মীয়টি ভিখারি নন শুনে মামা একটু কাতর হলেন। তবে ভাগ্নে বলল, 'মামা এই নিয়ে মন খারাপের কিছু নেই। যিনি আসবেন তিনি তো ভিখারির দলের সাথেই আসবেন আর কেউ তো জানতে যাবে না যে ঐ পাঁচজনের পরিচয় কি? তুমি চিন্তা কর না তো।' ভাগ্নের কথায় মামা একটু আশ্বস্ত হলেন। এদিকে পাঁচশ লোকের আয়োজন চলছে মামা-ভাগ্নের অনেক কাজ।
ঝামেলা যেন পিছু ছাড়ছে না। মঙ্গলবার সকালে আবার ফোন। রাগামা যে ভিখারি থাকেন তিনি এক্সিডেন্ট করেছেন। এখন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি। অবস্থা কেমন তা নেতা ভিখারি ঠিক জানেন না। কারণ তিনি এই মুহূর্তে দুরের এলাকায় আছেন। তাই হাসপাতালে থাকা ভিখারি কালকে আসতে পারবেন কি-না অনিশ্চিত।
মামা পড়লেন মহা বিপদে। এখন উপায়? যদি হাসপাতালে থাকা ভিখারি আসতে না পারেন তবে তো অন্য কাউকে ঠিক করতে হবে। নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য নেতা ভিখারির কাছ থেকে নাম জেনে মামা তার ভাগ্নেকে নিয়ে রওনা দিলেন পঁচিশ কিলোমিটার দূরে রাগামা হাসপাতালে।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক্সিডেন্ট ওয়ার্ডে পাওয়া গেল ভিখারিকে। আপেল, কমলা আর কলা নিয়ে মামা ভিখারিকে দেখতে আসায় ভিখারি খুশিতে কাঁদতে লাগলেন। ভিখারির একটা পা মচকে গেছে। পরিস্থিতি যা তাতে নিশ্চিন্ত কালকে ভিখারি যেতে পারবেন না। মামা বললেন তার জন্য হাসপাতালে খাবার পাঠাবেন।
পরের দিন দুপুর বারটায় মামা-ভাগ্নে গেলেন অতিথি ভিখারিদের আনতে। মামা নিজের মাইক্রোটি নিজে চালিয়ে গেলেন। কথামতো চারজন নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করছিলেন। মামা তাদের বাড়ি নিয়ে এলেন। সবার আগে ওই চারজনকে খেতে দেয়া হল। চারজন পেটপুরে খেলেন। খাওয়া শেষে সবাইকে একটা করে লুঙ্গি, একটা করে গামছা, দুশো করে টাকা আর সবার পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত খাবার দেয়া হল। সবাই খুব খুশি, তারা নানা শ্বশুরের জন্য দোয়া-প্রার্থনা করলেন। ভিখিরিদের যেখান থেকে তুলে আনা হয়েছিল সেখানে আবার নামিয়ে দিয়ে এলেন মামা-ভাগ্নে।
বাড়িভর্তি মেহমান গিজগিজ করছে। সবাই মামার খোঁজ করছে। সেদিকে খেয়াল না করে এক প্যাকেট খাবার, একটা লুঙ্গি, একটা গামছা আর দুশো টাকা নিয়ে মামা-ভাগ্নে রওনা দিলেন হাসপাতালের উদ্দেশে।
আরও গল্প পড়তে ক্লিক করুন
No comments