বিয়ের সাক্ষী
ঘটনা
এক.
গায়ে
হলুদের রাতে গানের আসর
বসেছে। স্বাভাবিকভাবেই আসরে মদ্যপান চলছে।
বরের এক শিল্পী বন্ধু অন্য গ্রাম থেকে
এসেছেন বন্ধুর বিয়ের হলুদের আসরে গান গাইতে।
এদিকে বরের আপন পিসাতো ভাইও
একটু আধটু গানটান করেন।
প্রথমেই অতিথি শিল্পী গান ধরেছেন। তিনি গান গাইছেন
তো গাইছেনই। হারমোনিয়াম ছাড়ছেনই না। অবশ্য অতিথি শিল্পী
এত ভাল গাইছিলেন যে
সত্যি সবাই খুব উপভোগ
করছিলো। এদিকে বরের পিসাতো ভাই আগে গান
গাইতে না পারায় গজগজ
তো করছিলেনই শেষমেষ তিনি রাগ করে
বাড়ী চলে গেলেন।
এতো
গেল রাতের ঘটনা। পরের দিন সকালে
বিয়ের খ্রিষ্টযাগে বরের সেই পিসাতো
ভাইয়ের স্ত্রীর হওয়ার কথা বিয়ের সাক্ষী।
বর-কনে গির্জায় চলে এসেছেন।
তৃতীয় ঘন্টাও পড়ে গেছে। ফাদার
প্রবেশগীতি শুরু করার জন্য
তাগাদা দিচ্ছেন। কিন্তু মহিলা সাক্ষী অনুপস্থিত। এদিকে সাক্ষীকে ফোনের উপর ফোন করা
হচ্ছে কিন্তু সাক্ষী ফোন ধরছেন না। খবর পাওয়া
মহিলা সাক্ষী অথাৎ বরের পিসাতো
ভাইয়ের স্ত্রী অভিমান করে গির্জায় আসেন নি কারণ তার
স্বামীকে আগের রাতে সবার
আগে গান গাওয়ার অনুরোধ করা
হয় নি বা সুযোগ
দেওয়া হয়নি। বরের বাড়ীর সবাই
মহা ঝামেলায় পড়ে গেল। শেষে বরের বোন
সাক্ষীর বাড়ী গিয়ে বৌদিকে
অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে মাপ-মিনতি চেয়ে গির্জায়
নিয়ে এলেন। বৌদি সাক্ষী হলেন
ঠিকই কিস্তু সেটা কি মন
থেকে? সেই বিয়েতে সত্যিই কি সাক্ষীর শুভ
কামনা ছিল বর-কনের
জন্য?
ঘটনা
দুই.
মহিলা
সাক্ষী পার্লার থেকে এমনভাবে সেজে এসেছেন যেন
তার চুলের বাঁধন আর শাড়ী প্রদর্শন দুই-ই সর্ব
সাধারনের দৃষ্টিনন্দন
হয়। গির্জায় বর-কনের জন্য
নির্ধারিত স্থানের পাশে সাক্ষী বসা
মাত্রই ফাদার বললেন সাক্ষীকে মাথায় কাপড় দিতে হবে।
সাক্ষী আর যায় কোথায়! কোন
মতেই তিনি মাথায় কাপড়
দিবেন না। অতপর সেই
বিয়েতে তিনি সাক্ষীই হলেন না। কারণ
বিয়ের সাক্ষী হওয়ার চেয়ে নিজের সৌন্দর্য প্রদর্শনকে তিনি প্রধান্য দিলেন। এখন কি করা
যায়? ছেলের বোন নতুন করে সাক্ষী খুঁজতে
লাগলেন। শুধু সাক্ষী তো পেলেই হবে
না। সমস্যা আরো একটা আছে।
উপধর্মপল্লীতে বিয়ে হলে বিয়ের সাক্ষ্য
লেখার খাতায় সাক্ষ্য দিতে পরের দিন
ফিরানীর বা বউভাতের আগে ধর্মপল্লীতে যেতে হয়। তাই
যিনি সাক্ষী হবেন পরের দিন
শীতের সকালে তিনি সব কাজকর্ম ফেলে
ধর্মপল্লীতে দৌড়াতে রাজী হবেন কিনা
তাও দেখতে হবে। শেষমেষ কাউকে
না পেয়ে বরের বোন
নিজেই সাক্ষী হলেন।
আমার
নিজের চোখে দেখা ঘটনাগুলোই
মূলত এই লেখাটি লিখতে
আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমি আঠার গ্রামের
মেয়ে। নিয়মিত দেশে থাকি না।
তাই বিয়ে বাড়ি কিংবা
বিয়ের অনুষ্ঠানেও
আমার যাওয়া হয় না। গত
১৬ বছরে আমি মাত্র
৩টি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি। আর
দুইটি বিয়ের ঘটনাই আমি আপনাদের সাথে
সহভাগিতা করলাম। এই ঘটনাগুলো দেখার
পর থেকে আমার মনে
শুধু একটা প্রশ্ন বারবার
ঘুরপাক খাচ্ছে। আর তা হচ্ছে
বিয়ের সাক্ষী হতে হলে কি
কোন যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না?
(আঠার
গ্রামের রীতি অনুয়ায়ী) শুধুমাত্র
বরের বৌদি, দুলাভাই, বন্ধু কিংবা বন্ধুর বৌকেই বিয়ের সাক্ষী হতে হবে? আমরা
যখন কারো সাথে কোন
টাকা-পয়সা লেনদেন কিংবা
জমিজমা বেচাকেনা করি তখন দুই বা
ততোধিক সাক্ষী রাখি। এসব দরকারি এবং
গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমরা কিন্তু যাকে
তাকে সাক্ষী রাখি না। এমন
কাউকে সাক্ষী রাখি যিনি অভিজ্ঞ,
জ্ঞানী, বিচক্ষণ ও বিশ্বস্ত। অথচ আমাদের এলাকায় ডিসেম্বরের ২৭ তারিখে বিয়ে
হয়েই বউটি বা স্বামীটি
ডিসেম্বরের ২৯ তারিখে অন্য আরেকটি বিয়ের
সাক্ষী হচ্ছেন। এটি কতটুকু যুক্তিসংগত? যার বিবাহিত
জীবন সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতাই নেই
তিনি কিভাবে অন্য আরেক জনের বিয়ের সাক্ষী
হবেন? বিয়ে যেহেতু সারা
জীবনের একটা বন্ধন তাহলে
বিয়ের মতো এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ
কাজে আমরা কেন শুধুমাত্র আত্মীয়তার
খাতিরে সদ্য বিবাহিত এবং বিবাহিত জীবন
সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাক্ষী রাখি।
একটু
খেয়াল করলে দেখা
যাবে, অনেক ক্ষেত্রেই নব
দম্পতিদের জীবনে কলহ বা ভাঙ্গনের পেছনে
এসব আত্মীয় সাক্ষীরাই দায়ী থাকেন। বিয়ের
পর একই পরিবারে কিংবা পাশাপাশি
বসবাসের কারণে টাকা-পয়সা, জায়গা-সম্পত্তি, ছেলে-মেয়ে পরকীয়াসহ
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এরাই একে
অপরের দাম্পত্য জীবনে কলহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আবার
আমাদের এলাকায় বিয়ের সাক্ষী আমরা মুখে মুখেই
ঠিক করি। যেখানে সাক্ষীর
কোন দায়বদ্ধতা নেই। সাক্ষীর ইচ্ছে
হলে বিয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে
সবাইকে এক হাত দেখিয়ে দিতে
পারেন অথাৎ শুভ কাজের
শুরুতেই একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির
সৃষ্টি করতে পারেন। অথচ ভাওয়াল, রাজশাহীসহ
আমাদের দেশের অনেক এলাকায় বর-কনের বাড়ীতে বিয়ের আগে
যে গোয়ামিল অনুষ্ঠান হয় সেখানে বসে
সমাজের লোকজন বাড়ীর সবার সাথে আলোচনা করে ঠিক করেন
বিয়ের সাক্ষী হবেন কে বা কারা।
আমার
মতে, বিয়ের সাক্ষী হওয়া উচিৎ এমন
দুজন ব্যক্তির যারা বিবাহিত জীবন
সম্পর্কে অভিজ্ঞ।
যাদের বিবাহিত জীবন সমাজে অনুকরণীয়
এবংআদর্শস্বরুপ। যিনি সত্যি বর-কনের মঙ্গল
চান এবং শুধু বর-কনের বিয়ের দিনই
নয়, সারা জীবন তাদেরর মঙ্গল
কামনা করে প্রার্থনা করবেন।
তাদের নতুন জীবন শুরুর
শুভমুহূর্তটির সত্যিকারের
সাক্ষী হবেন। এখানেই সাক্ষীদের দায়িত্ব শেষ হবে না।
ভবিষ্যতে এই দম্পতির বিবাহিত জীবনের কোন সমস্যা হলে
এই নবদম্পতি যারতার কাছে নিজেদের সমস্যার কথা
না বলে প্রয়োজনে এই
সাক্ষীদের সাথে সহভাগিতা করবেন।
সাক্ষীরাও এই দম্পতিকে সর্বদা সুপরামর্শ দিতে এবং সহযোগিতা
করতে প্রস্তুত থাকবেন। এরা হতে পারেন বর-কনের কোন
শিক্ষক বা শিক্ষিকা, তাদের
কোন প্রিয় ব্যক্তিত্ব যাকে তারা আদর্শ মানেন, তাদের কোন মামা-মাসি,
কাকা-কাকি যে কোন
বয়সের বা আত্মীয়। হতে পারে এমন
কোন ব্যক্তি যিনি বর-কনের
নিকট কোন আত্মীয় নন
কিন্তু তাদের সাথে কথা বলে
আনন্দ পান বা স্বস্তি
বোধ করেন। বর-কনেকে বুঝতে
হবে যে সত্যি কারা আপনাদের মঙ্গল
কামনা করেন।
আবার
আমাদের দেশে বিয়ের সাক্ষীরা
বর-কনের পাশে বসেন।
বরের পাশে বসা পুরুষ
সাক্ষীর তেমন কোন কাজ না
থাকলেও কনের সাক্ষীর কিন্তু
বিস্তর কাজ। কনের শাড়ি, রিটভেল,
মেকআপ ঠিক আছে কিনা
খেয়াল রাখার পাশাপাশি নিজের সাজপোশাক নিয়ে এত ব্যস্ত
থাকেন যে বিয়ের মন্ত্র
পড়ানোর সময় সাক্ষীর যে কি ভূমিকা
তা তাদের মনেই থাকেনা। অবশ্য
এখানে একটা কথা বলে
রাখা দরকার যে আমাদের দেশে
বিয়ের সাক্ষীর যে কি ভূমিকা
এ বিষয়ে আমাদের মন্ডলী তেমন কোন শিক্ষাই দেয়
না। তাই বিয়ের সময়
কনের শাড়ি টানাটানি করা
ছাড়া সাক্ষীর আর কোন কিছু করার
থাকে না।
কনের
মালা পরানোর সময়, হেঁটে যাওয়ার সময়
যদি সাহায্যকারী দরকার হয় তবে বর-কনের পাশে দিদি,
বান্ধবি, বৌদি- দুলাভাই বসতেই পারেন। তবে সেটা সাক্ষী
হিসেবে নয়। আজকাল বিয়ের সময় সব গির্জাতেই
সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। বিয়ের
মন্ত্র গির্জায় উপস্থিত
সবাই শুনতে পান। তাই সাক্ষীকে
একেবারে বর-কনের সাথে
না বসলেও চলে। প্রয়োজনে সাক্ষী
দুজনকে আলাদা বসার জায়গা দেওয়া
যেতে পারে যেন সবাই দেখতে
পান এই বিয়ের সাক্ষী
কারা হবেন বা হচ্ছেন।
কনের শাড়ি-রিডভেল টানাটানি করা
কিন্তু সাক্ষীর কাজ নয়।
আমাদের
খ্রিষ্টমন্ডলীতে বিয়ের আগে প্রার্থীদেরকে যে
ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি দেওয়া হয় অন্য কোন
ধর্মে সেই ব্যবস্থা নেই।
একজন খ্রিষ্টভক্ত হিসেবে আমি মন্ডলীর এই সেবাকে সাধুবাদ
জানাই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি
মনে করি, বিয়ের প্রস্তুতি ক্লাসে
যদি বিয়ের সাক্ষী নির্বাচন ও নবদম্পতির জীবনের সাক্ষীদের ভূমিকা-প্রয়োজনীয়তা কি এবং যোগ্যতার
বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় তবে
অনেক দম্পতিই উপকৃত হবেন। এ ব্যপারে রবিবারেও
ফাদারগণ উপদেশ দিতে পারেন।
No comments