২রা নভেম্বর ও আমার ভাবনা
নভেম্বরের ২ তারিখ খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারীরা পালন করেন মৃত্যুলোকের পর্ব। যেসব আত্মীয়-স্বজন, পূর্বপুরুষরা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন খ্রিষ্টবিশ্বাসীরা এই দিনে তাদের স্মরণে কবরস্থানে খ্রিষ্টযাগসহ বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠান করেন। প্রার্থনা শেষে কবরে বাতি জ্বালানো হয়। খ্রিষ্টান বর্ষপুঞ্জি অনুসারে পুরো নভেম্বর মাসই উৎসর্গ করা হয়েছে মৃত আত্মাদের উদ্দেশে। অনেকে সারা নভেম্বর মাস জুড়ে কবরস্থানে ব্যাক্তিগতভাবেও প্রার্থনা করেন।
আমরা বর্তমান পৃথিবীর চাকচিক্যময়তায় এতটাই ব্যস্ত যে আমাদের মৃত আত্মীয়দের কথা মনেই থাকে না। অন্তত এই নভেম্বর মাসের অজুহাতে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মনে করার একটা ধামাকা সুযোগ পাচ্ছি।
আমার এই ধামাকা শব্দটি শুনে অনেকেই অবাক হচ্ছেন জানি। ধামাকা বলার কারন হচ্ছে আগে আমরা কবরস্থানে শুধু মোমবাতি জ্বালাতাম। অনেকে নিজেদের উঠানের ফুল গাছ থেকে ফুল নিয়ে কবরে দিতেন। এখন কিন্তু মোমবাতির সাথে পুরো কবরস্থান ফুলে ফুলে সাজিয়ে সেলফি কিংবা টিকটকের সুযোগ পাচ্ছি। মৃত আত্মাদের জন্য প্রার্থনা কতোটুকু হচ্ছে জানি না তবে অনেকে কিন্তু পর্বটি সেলিব্রেট করছি হেব্বি। কেননা এর সাথে আবার যোগ হয়েছে ইউরোপিয়ান কালচার Halloween.
গত ২রা নভেম্বরের পর থেকে ফেসবুক খুললেই দেখা যাচ্ছে কত রঙে-ঢঙে ছবি তোলার বাহার। এইদিনে অনেকে কবরস্থে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে কাঁদেন। সম্প্রতি যিনি কোলের শিশুটি হারিয়েছেন, সদ্য স্বামীহারা নারী, মা-বাবা হারা সন্তান অনেকেই কাঁদেন। আবার কেউ না কাঁদলেও বিষণ্ণ থাকেন। সারা বছর প্রতিটি মুহূর্তে হারানো মানুষটিকে মনে মনে স্মরন করলেও নভেম্বরের ২ তারিখে তাদের স্মৃতিগুলো যেন আরও বেশি কাঁদায়। অথচ পাশের কবরেই আরেকজন বিভিন্ন পোস দিয়ে ছবি তোলেন যা দেখতে শুধু দৃষ্টিকটুই নয়, অমানবিকও বটে।
এই যে এতো বাতি, ফুলের মালায় মৃত মা-বাবা-আত্মীয়দের কবর সাজানো হল সেটা কতটা আন্তরিক?
সাধারণত ২১শে ফেব্রুয়ারী, ভ্যালেনন্টাই ডে, পয়লা বৈশাখ বাংলাদেশে ফুলের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এবারের ২রা নভেম্বরের ছবি দেখে আমার মনে হল এই ফুলের ব্যবসায় নতুন একটা দিন যোগ হল। অনেকেই যেন কবরস্থান সাজানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।
যাই হোক, বছরের একটা দিন আমরা আমাদের মৃত বাবা-মা, দাদা-দাদিদের ফুলের মালা দিব এতে কারো অব্জেকশন দেয়ার কিছু নাই।
কিন্তু প্রশ্ন হল এরা যখন বেঁচে ছিলেন কতদিন আপনি তাদের খোঁজ নিয়েছেন?
২রা নভেম্বর কবরস্থানের ছবিগুলো দেখে কেন জানি আমার ছোট বেলায় দেখা রঞ্জিত মল্লিকের অভিনীত বিখ্যাত বাংলা সিনেমাগুলোর কথা বারবার মনে পরছে। বাড়ির কোন এক বউ দুষ্টু হবে আর শ্বশুর-শাশুড়িকে ঠিকমতো খাবার দিবে না, তাদের দিয়ে বাড়ির সব কাজ করাবে, নিজের ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে কেক-পিজা খাবে আরও কত অমানবিক দৃশ্য। আশির দশকে এসব সিনেমা দেখে চোখের জল ফেলেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তখন ভাবতাম এসব বুঝি সিনেমাতেই হয়। কিন্তু এখন বুঝতে শিখেছি এসব বাস্তবে হয় এবং আমাদের আশেপাশেই হয়। আমার তো মনে হয় কিছু কিছু পরিবারের ঘটনা সিনেমার গল্পকেও হার মানাবে।
অনেক টকশো, উপদেশে শুনি যে আজকালকার ছেলেমেয়েরা বয়স্ক বাবা-মাকে সময় দেয় না, তাদের সাথে কথা বলে না। এসব তো প্রাথমিক সমস্যা। আমাদের সমাজে এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে বৃদ্ধ মা-বাবার জন্য উচ্ছিষ্ট খাবার বরাদ্দ থাকে। মা-বাবা বিছানায় পড়ে কাতরালেও সন্তানরা চিকিৎসা করায় না। তিন-চার জন সন্তান হলে কে নিবে বৃদ্ধ মা-বাবার দায়িত্ব সেটা নিয়ে আরেক ঝামেলা, চিকিৎসা তো দুরের কথা। প্রচণ্ড গরমে বৃদ্ধ অসুস্থ বাবা-মা যখন বিছানায় শুয়ে কাতরান সন্তানেরা বিদ্যুৎ খরচ বাচাতে বাবা-মার ঘরের কারেন্টের লাইন কেটে দেয়। ছেলে মা-বাবার জন্য প্রতি মাসে বিদেশ থেকে আলাদা করে টাকা পাঠালেও ছেলের বউ তা গায়েব করে ফেলে। পরিবারের শান্তির কথা ভেবে বৃদ্ধ মা-বাবা মুখ বুজে সহ্য করে। এমন ঘটনাও আছে যে সন্তান থাকতেও অসুস্থ বাবা অথবা মাকে একা বাড়িতে মরে পরে থাকতে হয়েছে। আচ্ছা তখন কি একবারের জন্যও মনে পড়ে না এই বাবা-মা তাদের জন্য কি করেছেন?
আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য নিজেদের সর্বচ্চটা দিয়ে থাকি। আমাদের বাবা-মায়েরাও আমাদের ছোটবেলায় তাদের সর্বচ্চটাই দিয়েছেন। অথচ আমরা অনেকেই বাবা-মার বৃদ্ধ বয়সে আমাদের প্রতি তাদের আদর, ভালবাসা, স্নেহ, ত্যাগস্বীকার অস্বীকার করি, ভুলে যাই।
বাবা-মার মৃত্যুর পর এসব সন্তানরা যখন আদিখ্যেতা করে ঘটা করে চল্লিশা পালন করে, জন্ম অথবা মৃত্যু দিবসে ফেসবুকে ‘আই লাভ ইউ, আই মিস ইউ’ লিখে, ২রা নভেম্বর পুরো কবর ফুলের মালায় সাজায় তখন তাদের জন্য করুনা হয়। এসব লোক দেখানো ভালবাসা বন্ধ করা উচিত। বাবা-মা জীবিত থাকতে তাদের সাথে কি করেছেন বা করছেন আশেপাশের মানুষ তা দেখে জানে। তাই তাদের মৃত্যুর পর এসব আদিখ্যেতা করা মানে লোক হাসানো।
আসুন আমরা আমাদের বৃদ্ধ বাবা-মায়ের যত্ন নেই। সাধ্যমতো তাদের সেবা করি। তাহলে আমাদের সন্তানেরাও আমাদের দেখে শিখবে। তারাও আমাদের বৃদ্ধ বয়সে আমাদের সেবা-যত্ন করবে।
No comments