শ্রীলঙ্কার খাবার-দাবার
বিয়ের খাবার |
আজ শ্রীলঙ্কার খাবার-দাবার নিয়ে লিখব। শ্রীলঙ্কার খাবারের কথা বললে যে জিনিসটা সবচেয়ে আগে মনে পড়বে তা হচ্ছে নারিকেল। নারিকেল ছাড়া শ্রীলঙ্কান খাবার চিন্তাই করা যায় না। আমাদের বাংলাদেশের রান্নার প্রথম ও প্রধান উপকরণ যেমন তেল, শ্রীলঙ্কায় হচ্ছে নারিকেল। শ্রীলংকানরা রান্নায় তেল একদমই ব্যবহার করে না। শুধু কিছু ভাজলে তেল ব্যবহার করে তবে সেটিও নারিকেল তেল। আমরা যেমন রান্নার প্রথমেই চুলায় কড়াই বসিয়ে তেল দেই এখানে তেমন করে রান্না করা হয় না।
এখানে প্রতিদিন রান্নার সময় একটা করে নারিকেল কুড়িয়ে সেটাকে পরিমান মতো পানি দিয়ে কচলিয়ে দুধ বের করা হয়। দুধটা ছেঁকে নিয়ে আলাদা করা হয় আর ছোবড়াটাতে আবার পানি দিয়ে দ্বিতীয়বার একইভাবে দুধ বের করা হয়। প্রথমবারের দুধটা হয় ঘন আর সুস্বাদু। দ্বিতীয়বারের দুধটা হয় পাতলা আর পানসে। এবার রান্নার প্রণালী সম্পর্কে জানাব।
এখানে যে কোন মাছ, মাংস, সবজি কেটে ধুয়ে রান্নার পাতিলে রাখা হয়। এতে লবণ, পেঁয়াজ, আদা-রসুন, হলুদ, মরিচ আর দ্বিতীয়বার কচলে বের করা নারিকেলের দুধ দিয়ে চুলায় বসিয়ে দেয়া হয়। এই পানি শুকিয়ে গেলে তাতে দেয়া হয় প্রথমবার বের করা দুধ। দুধ দিয়ে কয়েকবার বলক আসলেই রান্না শেষ।
এখানে আদা-রসুন বাটা ব্যাবহার হয়না শুধুমাত্র ছেঁচে দেয়া হয়। এখানে একটা সবজি দিয়ে একটা পদ রান্না করা হয়। দুই বা ততোধিক সবজি একসাথে রান্না হবে না। মাছ-মাংসে আলু কিংবা অন্যান্য সবজি থাকবে না। সবকিছুতেই থাকবে নারিকেলের দুধ।
দুধকে এখানে বলা হয় কিরি। এই কিরি বা নারিকেলের দুধ দিয়ে একটা বিশেষ ভাত রান্না করা হয়, যাকে বলা হয় কিরিভাত। কিরিভাত রান্না করা হয় আতপ চাল দিয়ে। চাল ধুয়ে প্রয়োজনের চেয়ে একটু কম পানি দিয়ে বসাতে হয়। পানি শুকিয়ে গেলে নারিকেলের যে প্রথম দুধ বের হয় সেটাতে আন্দাজ মতো লবণ মিশিয়ে ভাতের মধ্যে দিয়ে ভালমতো মিশিয়ে খানিকক্ষণ রান্না করলেই হয়ে যাবে কিরিভাত।
কিরিভাত |
এই ভাতকে হাড়ি থেকে চামচ দিয়ে নিয়ে খেতে হয় না। এর খাওয়ারও এক বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। এই ভাতকে কলা পাতার মধ্যে ঢালা হয়। একে সুন্দর করে চারকোনা অথবা গোল কেকের মতো সেপ দিয়ে সেট করতে হয়। এরপর ছুরি দিয়ে কেটে পিস পিস করে পরিবেশন করা হয়। এই ভাত খাওয়া হয় পেঁয়াজ, মরিচ দিয়ে বানান একরকম ভর্তা দিয়ে নয় তো গুড় দিয়ে।
আমাদের দেশে কারো জন্মদিন বা বাড়িতে শুভ কোন উপলক্ষে যেমন ক্ষীর বা পায়েস রান্না করা হয় শ্রীলঙ্কায়ও যে কোন বিশেষ দিনে কিরিভাত রান্না করা হয়।
আমরা প্রতিদিন দুই, তিন অথবা বেশি ধনী হলে চার-পাঁচ পদ দিয়ে ভাত খাই কিন্তু এখানে প্রতিদিন সর্বনিম্ন সাত পদ দিয়ে ভাত খাওয়া হয়। খাবারে একটা মাছ অথবা মাংস থাকবে, একটা শাক, ডাল আর তিন-চার রকমের সবজি আলাদা আলাদা করে রান্না করা থাকবে। এছাড়া সাথে থাকে পাঁপড় ভাজা।
বিয়ে বাড়ির খাবার প্রথমবার আমি যখন দেখলাম আমার তো চ্চক্ষু চড়কগাছ। কমপক্ষে ষাট-সত্তুর পদ থাকবে। যারা উচ্চবিত্ত তাদের থাকে একশোরও উপরে। ভাত থাকবে কয়েক ধরনের। যেমন সাদা ভাত, সবজি ভাত, এ দেশের বিশেষ এক রকম হলুদ ভাত, আলাদা আলাদা মাংস দিয়ে কয়েক ধরনের ফ্রাইড রাইস, মিক্সড ফাইড রাইস, নুডলস, পাস্তা ইত্যাদি। দশ/পনের ধরনের মাংস, মাছ, বিভিন্ন সবজি দিয়ে রান্না নানান পদ। খাবার পর ডেসার্টও থাকে পনের/বিশ ধরনের।
তবে এরা আমাদের দেশের মতো পোলাও, করমা, রোস্ট খায় না। কিছু কিছু মুসলিম রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে বিরিয়ানি রান্না হয় তবে সেগুলো খেতে স্বাদে কিংবা গন্ধে আমাদের দেশের মত না।
শ্রীলঙ্কার সাধারণ এক খাবার নারিকেলের ভর্তা। আমাদের দেশে আগে যেমন বলতো ডাল-ভাত গরিবের খাবার। তেমনি এখানে গরিবের ঘরে আর কিছু থাক বা না থাক নারিকেল আছে এবং সেটা ভর্তা করেই দিন চলে। শ্রীলঙ্কার এমন একটি বাড়ি খুজে পাওয়া যাবে না যে বাড়িতে নারিকেল গাছ নেই।
শ্রীলঙ্কায় ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন রকমের পিঠা রয়েছে। তবে সেসবের সাথে আমাদের দেশের পিঠার তেমন কোন মিল নেই। শুধুমাত্র পোয়া পিঠার মতো এক রকম পিঠা রয়েছে। আর সব পিঠাতেই থাকে নারিকেলের ছোঁয়া। আরও একটা দুঃখের বিষয় হচ্ছে এখানে আমাদের দেশের মতো কোন ধরনের মিষ্টি পাওয়া যায় না। আমি খুব মিষ্টি পছন্দ করি বলে এটি আমার জন্য অত্যন্ত বেদনার।
No comments