ফেরা
ফেরা |
দেশভাগের আগে থেকেই মধু ব্যাপারী আর জকু মাষ্টার কাজ করতেন করাচীতে। ছোট বেলার দুই বন্ধু জাহাজে করে একসাথে করাচীতে যেতেন একসাথে আসতেন। দুজনেই নাকী করাচীর কোন হোটেলে বাবুর্চির কাজ করতেন। দুজনের বন্ধুত্ব পরম্পরাগতভাবে তাদের ছেলেমেয়েদের উপরও বর্তাল। একই গ্রামে বাড়ি হওয়ায় এদের ছেলেমেয়েদের একে অপরের বাড়িতে যাতায়াতে কে যে কার সন্তান তা যেন বুঝাই দায়। তবে এ রসায়নে প্রবল বাঁধা বিপত্তি ঘটলো ১৯৬৭ সনে জকু মাষ্টার তার দুই ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে দিল্লিতে পাড়ি জমালে পর। সেখানেই নিজে ও ছেলেরা বিস্তর পরিশ্রম করে বাড়ি করলেন, ছেলেমেয়েদের বিয়েসাদি করালেন। আর দেশের সম্পত্তি তিনি মুখে মুখে দিয়ে গেলেন বন্ধু মধু ব্যাপারীকে। এদিকে মধু ব্যাপারীরও তিন ছেলে দুই মেয়ে। তিনি বন্ধুর দেয়া সম্পত্তি ভোগ করে তা আবার নিজের ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন।
সে অনেক বছর আগের কথা। এখন আর জকু মাষ্টারও নেই মধু ব্যাপারীও নেই। তাদের ছেলেমেয়েরা বিয়েসাদি করে যার যার মতো সংসার সন্তান নিয়ে ব্যস্ত। মধু ব্যাপারীর ছেলে টমাস গমেজের একমাত্র মেয়ে চন্দ্রা। টমাসের আরো দুই ছেলে আছে। চন্দ্রা সবে এইসএসসি পরীক্ষা লিখে কলেজের পাশেই এক সেন্টারে ইংলিশ কোর্সে ভর্তি হয়েছে। সেদিন ইংলিশ কোর্স করে একাই বাড়ি ফিরছিল। বাস থেকে নামতেই রাস্তায় দেখা হলো অপরিচিত দুজন ভদ্রলোকের সাথে। একজনের বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি হবে আরেকজনের বয়স ত্রিশও হতে পারে আবার চল্লিশও হতে পারে। চোখে সানগ্লাস। বয়স্ক লোকটি চন্দ্রাকে ডেকে বললেন, 'এই যে মামনি তোমার নাম কি?'
'আমার নাম চন্দ্রা'
'শ্যামপুর গ্রামটা কোন দিকে বলতে পারো?'
'হ্যাঁ আমি সেখানেই যাচ্ছি । আমার সাথে যেতে পারেন। আপনারা কি এখানে প্রথম এলেন?'
'প্রথমই বলতে পারো। তোমার বাড়ি শ্যামপুরে?'
'হ্যা'
'কোন বাড়ি? তোমার বাবার নাম কি?'
'নাম বললে আমার বাবাকে আপনি চিনবেন?'
তিনজনেই হাঁটতে লাগলো। বয়স্ক লোকটি মেয়েটির কথায় খুব আগ্রহ পেলেন। তবে চোখে সানগ্লাস পরা লোকটি কিছুই বলছেন না। বারে বারে রুমাল দিয়ে কপাল মুছছেন।
মেয়েটি বললো, 'ব্যাপারী বাড়ি। আমার বাবার নাম টমাস গমেজ।'
'টমাসের মেয়ে তুমি?'
'আপনি আমার বাবাকে চেনেন?'
'চিনি না মানে। ছোটবেলায় তোমার জ্যাঠাদের সাথে সারাটা দিন কাটিয়েছি। তোমার বড় জ্যাষ্ঠা অনিল আমার বাল্যবন্ধু। তোমার বাবা তো তখন একেবারে পিচ্চি। ওকে খেলা নিতে চাইতাম না বলে কেঁদেকেটে সেকি কান্ড।'
'সত্যি! আপনার নাম কি?'
'আমার নাম রমেশ মাষ্টার। আমরা দিল্লি থেকে এসেছি'
'দিল্লি থেকে!'
'হ্যাঁ ও আমার ছেলে। বাংলা বলতে পারে না'
'তাই বুঝি!''
'গ্রামের কত পরিবর্তন হয়েছে। সেই পঁয়তাল্লিশ বছর আগে কেমন ছিল আর এখন কত উন্নত হয়েছে।'
কথা বলতে বলতে ওরা বাড়ির কাছে চলে এলো।
চন্দ্রা বললো, 'আপনারা কোন বাড়িতে যাবেন?'
'আমাদের তো বাড়িঘর আর কিছু নেই। তোমার সাথে না হয় তোমাদের বাড়িতেই যাই।'
'আমাদের বাড়ি?'
'না থাক, তোমার জ্যাঠার বাড়ি নিয়ে চলো।'
চন্দ্রা অতিথিদের জ্যাঠার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বলল, 'আমাদের বাড়ি পাশেই। আসবেন কিন্তু।'
টমাসের শরীরটা ভাল না। কয়েক মাস যাবৎ বিছানায়। চাকরীবাকরিও নেই। মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। দুই ছেলে এখনও স্কুলে যায়। ছেলেরা কবে সংসারের হাল ধরে কে জানে। নানান চিন্তায় টমাস আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মেয়ের কাছে রমেশের আগমনের কথা শুনে টমাসের বুকের ভেতরটা এক অজানা শংকায় কেঁপে উঠে।
এদিকে অনিল ছেলেবেলার বন্ধুকে প্রথম দেখায় চিনতে না পারলেও একে একে সব স্মৃতি মনে পড়ে যায়। রমেশ আর অনিল দুই বন্ধু মিলে খুব আড্ডা দেয়। রমেশের ছেলের নাম রোহিত। বাংলা কিছুই বুঝে না। রমেশের স্ত্রী দিল্লির মেয়ে। হিন্দিতে কথা বলেন। তাই রোহিতের বাংলা শেখা হয় নি। বাংলাদেশে এসে কারো সাথেই রোহিতের কথা হয় না হাসি বিনিময় ছাড়া। তবে চন্দ্রা অর্ধেক ইংরেজি অর্ধেক ভুলভাল হিন্দিতে রোহিতের সাথে কথা বলে।
চন্দ্রা খুব চটপটে মিশুক মেয়ে। সে রোহিতকে পুরো গ্রাম ঘুরে দেখালো। তাদের কলেজে নিয়ে গেল। চন্দ্রার এই চঞ্চলতা-উচ্ছলতা রোহিতের খুব ভাল লাগে। এক সময় রোহিতের সাথে চন্দ্রার খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেল। দিন সাতেক সব কিছুই ভাল কাটছিল।
সমস্যার সৃষ্টি হলো যখন রমেশের বাংলাদেশে আগমনের হেতু জানা গেল। রমেশ দেশে এসেছেন বাপের সম্পত্তি উদ্ধারের উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশ সরকার নাকী 'অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যাবর্তন' আইন জারি করেছেন। সেই সূত্র ধরেই পঁয়তাল্লিশ বছর পরে রমেশের স্বদেশের মাটির কথা মনে পড়েছে।
যে আশংকায় রমেশের আগমনের বার্তা শুনে টমাসের বুকটা কেঁপে উঠেছিল সেই আতঙ্কটাই সত্যি হলো। মধু ব্যাপারীর পাঁচ ছেলেমেয়ে আলোচনায় বসেন। অভাগা যেদিকে যায় নদীও নাকি সেদিকে শুকিয়ে যায়। তাই দেখা গেল জকু মাষ্টারের সম্পত্তির উপরেই টমাসের ঘর। ভাগে যে জমিজমা পেয়েছেন তাও জকু মাষ্টারের সম্পত্তি। ভাইয়েরা কেউই এই ব্যাপারে কিছু করতে পারবেন না জানিয়ে দিলেন। তাই যদি কিছু ছাড়তেই হয় তবে ছাড়তে হবে টমাসকে তার পুরোটাই। অন্যান্য ভাইদের কাছ থেকে ছাড় যাবে অল্পবিস্তর।
মরার উপর খাড়ার ঘা যাকে বলে। টমাস চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন। কি করে তিনি রমেশের ঋণ শোধ করবেন!
চন্দ্রা রোহিতকে বললো, 'আপনার বাবা কেন এখানে এসেছেন আপনি জানেন?'
'আসার আগে জানতাম না এখন জেনেছি'
'আপনি তো আমাদের অবস্থা দেখছেনই। সম্পত্তি দিতে না পারলে আপনার বাবা আমার বাবার কাছে পনের লাখ টাকা দাবী করেছেন। সেটা জানেন? '
'শুনেছি।'
'আপনাদের সম্পত্তি কিংবা টাকা দেওয়ার মতো অবস্থা আমাদের যে নেই সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?'
'হ্যাঁ সেটাও আমি বুঝতে পারছি'
'আমার বাবা অসুস্থ। আমাদের সংসার কোন রকমে চলছে। আপনাদের এই দাবী যে আমাদের জন্য কতটা হতাশার আপনাকে আমি বোঝাতে পারবো না। '
'চন্দ্রা বিশ্বাস করো আমি এসেছি শুধু একবার আমার দাদার দেশ-বাড়ি নিজের চোখে দেখতে। এই সম্পত্তির উপর আমার কোন লোভ নেই। আমি বাবার সাথে একমত নই।'
'আপনি কি পারেন না আপনার বাবাকে বোঝাতে? আপনার বাবার এই দাবীতে আমাদের যে ঘর ছাড়া হতে হবে, আমার ভাইদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। আর আমার বাবা সেই শোকে মরে যাবেন' বলেই চন্দ্রা কান্না করতে করতে চলে গেল।
রোহিতের মনটা বিষন্নতায় ভরে গেল। এতদিন যে উচ্ছল-চঞ্চল চন্দ্রাকে সে দেখেছে আজ সেই চন্দ্রা যেন সম্পূর্ণ উল্টো। এই চন্দ্রা যেন কর্তব্যপরায়ণ মেয়ে, দায়িত্বশীল বোন।
পরের দিন রমেশ মাষ্টার বন্ধু অনিলকে প্রস্তাব দিলেন তিনি চন্দ্রাকে তার ছেলের জন্য পছন্দ করেছেন। এ প্রস্তাবে যদি টমাস রাজী থাকেন তো তিনি সম্পত্তি আর দাবী করবেন না। প্রস্তাবে অনিলসহ তার আরো তিনভাইবোন যারপর নাই খুশি হলেও টমাস খুশি হলেন না। একে তো ছেলের বয়স বেশী প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি তার উপর ছেলে বাংলা বলতে পারে না। তার এইটুকু মেয়েকে বিয়ে করে কোথায় কোন প্রান্তে নিয়ে যাবে। সে আর কোনদিন দেখতে পাবে কি না কে জানে। তিনি রাজি নন।
অনিল ব্যাপারী চন্দ্রাকে ডেকে প্রস্তাবের কথা জানালেন। চন্দ্রার বাবা ছাড়া চন্দ্রার অন্যান্য জ্যাঠাপিসিরা এই প্রস্তাবে রাজি সে কথা জানাতেও ভুললেন না। চন্দ্রা অবাক হলো জ্যাঠার কথা শুনে।
বললো, 'জ্যাঠা আজ যদি আপনাকে সম্পত্তি ছাড়তে হতো বা সম্পত্তির বিনিময়ে আপনার মেয়েকে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হতো আপনি কি রাজি হতেন?'
'চন্দ্রা সমস্যাটা যদি আমাদের হতো তবে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হতো। এখন যেহেতু সমস্যাটা তোদের তাই তোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তোর বাবার বাঁচা-মরা, ভাইদের লেখাপড়া সব তোর উপর নির্ভর করছে। তুই যদি এভাবে বেঁকে বসে থাকিস তখন তোদের তো রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তোরা যে বিপদে পড়েছিস এর চেয়ে ভাল সমাধান কি আর হয়।'
চন্দ্রা রাগে, দুঃখে-কষ্টে, অপমানে শেষে রাজি হয়ে গেল। কথা হলো ডিসেম্বরে আবার তারা আসবেন এবং বিয়ে করে চন্দ্রাকে নিয়ে যাবেন।
সে বছরই ডিসেম্বর মাসে রমেশ মাষ্টার দেশে এসে রোহিতের সঙ্গে চন্দ্রার বিয়ে দিয়ে চন্দ্রাকে দিল্লি নিয়ে গেলেন। চন্দ্রার স্বামী রোহিত এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। চন্দ্রার প্রতি তিনি যথেষ্ট কেয়ারিং তবে তিনি তার ভালবাসার কথা মুখফুটে বলতে পারেন না। চন্দ্রা খেল কি-না, চন্দ্রার কখন কি লাগবে সব দিকেই তার খেয়াল। তবে কারণে-অকারণে খুনশুটি করা, অভিমান করা, যখন তখন চন্দ্রাকে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া এসবে তার কোন আগ্রহ নেই। চন্দ্রাকে নিয়ে তিনি শপিংয়ে যান না। চন্দ্রার হাতে টাকা দিয়ে বলবেন দিদির সাথে শপিংয়ে যেও।
বই কেনা বা পড়া ছাড়া রোহিতের তেমন কোন শখ বা নেশা নেই। সময় পেলেই তিনি বইয়ে মুখ গুজে পড়ে থাকেন। চন্দ্রার জন্যও ইংলিশ আর হিন্দি বই কিনে আনেন। চন্দ্রার জন্য তিনি হিন্দি শিক্ষিকা রেখে দিয়েছেন। চন্দ্রা ঘরে হিন্দি শিখে। চন্দ্রা আবার পুরোই তার উল্টো প্রকৃতির। হাসি-খুশি-প্রানবন্ত। তবে রোহিতের কাছে এসে চন্দ্রা যেন বদলে গেছে। তার আগের সেই পুরোনো জীবন সম্পূর্ণ ত্যাগ করে রোহিতের মতোই যেন সাদাসিধে হয়ে যাচ্ছে। এখন আর চন্দ্রা হিন্দি মুভি দেখে না, কবিতা আবৃত্তি করে না, যখন তখন গলা ছেড়ে গান গায় না।
রোহিতকে ঠিক ভালবাসতে না পারলেও চন্দ্রাকে, চন্দ্রার পরিবারকে বিশাল এক বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে বিধায় রোহিতের প্রতি চন্দ্রার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। রোহিতকে চন্দ্রা শ্রদ্ধা করে।
বিয়ের পরের বছরই চন্দ্রার কোল জুড়ে ফুটফুটে এক ছেলের জন্ম হলো। চন্দ্রার জীবনটা যেন আবার কলোরবে ভরে উঠলো। চন্দ্রার ছেলে এবার দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে বলে রোহিত আর চন্দ্রা ছেলের সাথে বেশীরভাগ সময় ইংরেজীতে কথা বলে। চন্দ্রার ইচ্ছে করে ছেলেকে একটু বাংলা শেখাতে। কিন্তু ছেলেটা ইংলিশ বলার পর যেটুকু সময় পায় বাংলার চেয়ে হিন্দিতে কথা বলতেই যেন স্বাচ্ছন্দবোধ করে। তবে চন্দ্রা সময় পেলেই ছেলের সাথে একটু আধটু বাংলায় কথা বলে।
এতদিন চন্দ্রা ছেলেকে নিয়ে সারাটা দিন ব্যাস্ত থেকেছে। কিন্তু ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করানোর পর থেকেই চন্দ্রার সারাটা দিন একা একা কাটে। বিশেষ করে সকাল সাতটা থেকে সেই দুপুর বারোটা পর্যন্ত চন্দ্রা সম্পূর্ণ একা।
এসময় চন্দ্রা একটা ফেসবুক একাউন্ট খুললো। ফিরে পেল অনেক পুরোনো বন্ধুকে। অনেকে বাংলাদেশে থাকে অনেকে আবার ইউরোপ-আমেরিকাতে। ছেলেকে স্কুলে দিয়ে এসে চন্দ্রা এখন তার স্কুল-কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাটিং করে, কথা বলে এভাবে বেশ চলছিল।
একদিন হঠাৎ চন্দ্রা অর্জুন সিং নামে একটা আইডি থেকে রিকোয়েষ্ট পেল। চন্দ্রার খুব বেশী বন্ধু নেই। অজানা এই আইডি থেকে রিকোয়েষ্ট পেয়ে চন্দ্রা এমনেই রেখে দিল। বেশ কিছুদিন পর চন্দ্রার কোন বন্ধু লাইনে নেই বলে চন্দ্রা অর্জুনের আইডিটি ঘুরে দেখলো।
ছেলেটি কবিতা লিখে। পুরো ওয়াল জুড়ে কবিতা। প্রেমের কবিতা, দেশের কবিতা, গ্রামের কবিতা,। চন্দ্রার মনে হয় এসব কবিতা যেন তার ফেলে আসা বাংলাদেশের কবিতা, তারই গ্রামের কবিতা। কয়েকটি কবিতা চন্দ্রার খুব ভাল লাগে। চন্দ্রা কবিতাগুলো পড়তে থাকে মনে মনে। বেশ কয়েকদিন পর চন্দ্রা আবার অর্জুনের আইডিতে ঢুকে দেখে নতুন বেশ কতগুলো কবিতা আপলোড করা হয়েছে। এবার চন্দ্রা কবিতাগুলো সেভ করে রাখে।
যখনই একা থাকে গলা ছেড়ে আবৃত্তি করে। একসময় চন্দ্রার মনে হলো অর্জুনকে সে তার ফ্রেন্ডলিষ্টে যুক্ত করবে। চন্দ্রা অর্জুনকে বন্ধু করে নেয়। সাথে সাথেই অর্জুনের ম্যাসেজ এলো -
'কেমন আছেন?'
চন্দ্রা কোন উত্তর দিলো না। তারপরদিন ভোরে আবার ম্যাসেজ 'শুভ সকাল'
এবারও চন্দ্রা কোন উত্তর দিলো না। কিন্তু চন্দ্রা অর্জুনের প্রত্যেকটি কবিতা ঠিকই দেখে ঠিকই একা একা আবৃত্তি করে।
'আমাকে আপনি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন। উত্তর দিচ্ছেন না যে। কেমন বন্ধু আমরা বলুন তো?'
চন্দ্রা 'শুভ সকাল' লিখেই ইন্টারনেট অফ করে রাখলো।
পরেরদিন আবার অর্জুনের 'শুভ সকাল' ম্যাসেজ এলো।
এবার চন্দ্রা উত্তর দেয়।
এভাবেই অর্জুনের সাথে চন্দ্রার বন্ধুত্ব শুরু হলো। বন্ধুত্ব গভীর হলে অর্জুন জানতে চাইলো কেন চন্দ্রা ভিনদেশী ছেলেকে বিয়ে করেছে? চন্দ্রা সবাইকে বলতো রোহিতকে সে ভালবেসে বিয়ে করেছে। কিন্তু এই প্রথম কাছের বন্ধু অর্জুনকে রোহিতের সঙ্গে তার বিয়ের আসল ঘটনাটা বললো।
রোহিত বললো, 'চন্দ্রা তুমি তো দেবী'
'মানে?'
'দেবী না হলে কেউ এত বড় ত্যাগস্বীকার করতে পারে? জানো আমার ইচ্ছে করছে তোমার পা ছুঁয়ে প্রনাম করার'
'কি বলছো এসব?'
'সত্যি চন্দ্রা। তোমার মা রত্নাগভা। তোমার মতো একজন দেবীকে তিনি গর্ভে ধরেছেন। তার প্রতিও আমি প্রনাম জানাচ্ছি চন্দ্রা'
এরপর একদিন অর্জুনের ম্যাসেজ আসে 'চন্দ্রা আমি তোমাকে ভালবাসি'। নিজের ভাষায় 'ভালবাসি' কথাটা কোনদিন শুনেনি চন্দ্রা। অর্জুনের লেখা 'ভালবাসি' শব্দটার প্রতি চন্দ্রা প্রচন্ড রকম দুর্বল হয়ে পড়ল। 'আমি তোমাকে জীবনের চেয়েও ভালবাসি চন্দ্রা' বাক্যটা যে এত মধুরময়, এতে যে এত মাদকতা লুকিয়ে আছে তা আগে চন্দ্রার জানা ছিল না। চন্দ্রা অর্জুনের চেয়ে অর্জুনের লেখা ম্যাসেজগুলোর প্রেমে পড়ে গেল। 'তোমাকে আমি ভালবাসবো জন্ম-জন্মান্তর' একরকম করে যে আর কেউ কখনও তাকে বলে নি। চন্দ্রা প্রতিদিন অপেক্ষা করে অর্জুনের ম্যাসেজের। সেও ছোট্ট করে উত্তর দেয়। এভাবেই শুরু -
চন্দ্রার স্বামী সকালে সাড়ে ছয়টায় অফিসে চলে যায়। চন্দ্রা তার ছেলেকে স্কুলে দিয়ে ঠিক সাতটায় বাসায় ফেরে। ইন্টারনেট অন করেই দেখে অর্জুনের ম্যাসেজ 'শুভ সকাল'। অর্জুন অনলাইনেই থাকে। অপেক্ষা করে কখন চন্দ্রা আসবে লাইনে। এরপর দুজনের সুন্দর কিছু মুহূর্ত।
কিছুদিন শুধুই ম্যাসেজ বিনিময়। এরপর অডিও কল, ভিডিও কল। চন্দ্রার কন্ঠ প্রথম শুনে অর্জুন যেন মাতাল হয়ে গিয়েছিল। এর আগে নাকি অর্জুন এত মধুর কন্ঠ শুনেনি। অর্জুনের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে চন্দ্রা পুলকিত হয়েছিল। চন্দ্রার মধুর কন্ঠ না শুনলে যেন অর্জুনের দিন শুরু হতে চায় না। চন্দ্রা ছবি না পাঠালে অর্জুন অভিমান করে সেদিন ঘুম থেকেই উঠবে না। দুজনের মধ্যে কত না খুনসুটি, কতনা মধুময়তা।
চন্দ্রা নিজের স্বামী-সন্তান-সংসার ভুলে অর্জুনেকে পাগলের মতো ভালবাসে ফেলে। অর্জুন চন্দ্রাকে নিয়ে নতুন করে সুখের সংসার সাজানোর প্রস্তাব দেয়। অর্জুন চন্দ্রার জন্য সব ছাড়তে রাজি বাবা-মা, সমাজ, ধর্ম সব। সে শুধু চন্দ্রাকে চায়, চন্দ্রার ভালবাসা চায়। চন্দ্রাকে পেলেই তার জীবন স্বার্থক। কিন্তু চন্দ্রা রাজি হয় না। কারণ চন্দ্রা তার স্বামীর কাছে ঋণী, চন্দ্রা সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের কাছে দায়বদ্ধ। সে পারবে না সব ছেড়ে অর্জুনের সাথে আবার নতুন করে শুরু করতে।
অর্জুন বলে, 'চন্দ্রা থাক তোমাকে আমার জন্য কিছু ছাড়তে হবে না। তুমি শুধু আমাকে এভাবে ভালোবেসো তাতেই হবে।'
একদিন বিকেলে চন্দ্রার ছেলে ঘুমে, বাইরে অঝোরে বৃষ্টি, অর্জুন চন্দ্রাকে ফোন করে। সেদিন ভিডিও কলে শুধুমাত্র চন্দ্রার মুখ দেখেই অর্জুনের সাধ মিটে না। অর্জুন আরো কিছু দেখতে চায়, চন্দ্রার দেহের ভাঁজ। এমন প্রস্তাব শুনে চন্দ্রা অর্জুনের উপর রাগ করে ফোন কেটে দেয়। চন্দ্রা রাগে, লজ্জায়, অপমানে কান্না করতে থাকে।
এরপর থেকে অর্জুন আর চন্দ্রার সাথে কোন যোগাযোগ করে না। এভাবেই চললো প্রায় তিনদিন। এদিকে অর্জুনের বিরহে চন্দ্রা অসহায় হয়ে পড়ে। সে অর্জুনের সাথে একটু কথা বলার জন্য পাগল হয়ে উঠে। কিন্তু অর্জুন চন্দ্রার কোন খোঁজখবর নেয় না। শেষে আর থাকতে না পেরে চন্দ্রাই অর্জুনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। অর্জুন বুঝতে পারে আর যাই হোক চন্দ্রার সাথে সম্পর্ক করে সে তার স্বার্থ উদ্ধার করতে পারবে না। তাই চন্দ্রা যোগাযোগ করলেও অর্জুন আর সেই আগের অর্জুন থাকে না।
এখন চন্দ্রা দশটা ম্যাসেজ লিখলে অর্জুন একটার উত্তর লিখে হ্যাঁ অথবা না। কিংবা শুধুমাত্র লাইক বাটনটা টিপে রাখে। এখন অর্জুন আর চন্দ্রার ছবি চায় না। চন্দ্রাকে ফোন করে না। এখন চন্দ্রার ভালবাসাকে অর্জুনের ন্যাকামী মনে হয়। চন্দ্রা বুঝতে পারে অর্জুনের পরিবর্তন । চন্দ্রা অর্জুনকে অনুযোগ করে ম্যাসেজ লিখলো, 'কেন আমায় অবহেলা করছো?'
অর্জুনের উত্তর আসে, 'তোমাকে আমি অবহেলা করি- এই মিথ্যে কথা শুনতে আমার ভাল লাগে না। তোমার যদি মনে হয় আমি সত্যি তোমাকে অবহেলা করছি তবে প্লিজ আমার সাথে আর যোগাযোগ করো না।'
'অর্জুন আমি তোমাকে ভালবাসি তাই তুমি যোগাযোগ না করলে ভয় হয় এই বুঝি আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলবো। এবার তুমি বলো আমি কি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবো?'
'না করো না প্লিজ। দরকার হলে আমিই করবো'
অর্জুনের এমন উত্তরে অর্জুনকে নিয়ে চন্দ্রার মনের গভীরে সাজানো পৃথিবীটা যেন এক নিমিষেই দুমরে মুচরে ভেঙ্গে যায়। চন্দ্রার বুকের পাজরগুলো একটা একটা করে ভেঙ্গে যেতে থাকে। চোখের জল চন্দ্রার নিত্য সঙ্গি হয়ে উঠে।
চন্দ্রা দেখে অর্জুন অনলাইনেই থাকে কিন্তু চন্দ্রাকে কোন ম্যাসেজ দেয় না। চন্দ্রার খুব ইচ্ছে করে অর্জুনের সাথে একটু কথা বলতে, অর্জুনের একটা ম্যাসেজ পেতে কিন্তু অর্জুন যে তাকে যোগাযোগ বারণ করেছে।
আর থাকতে না পেরে দিন চন্দ্রা লিখলো, 'অর্জুন তোমার সঙ্গে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে।'
দুই ঘণ্টা পর অর্জুন ফোন দিল।
'কেমন আছো অর্জুন?'
'ভাল না জ্বর আসছে।'
'ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে?'
হঠাৎ রেগে গিয়ে অর্জুন বলে, 'ডাক্তারের কাছে যাব কেন? আমি কি রোগি? জ্বর মানুষের হয় না? জ্বরের জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হয় যত্তসব। ফোন করতে বলেছ কেন?'
অর্জুনের কথা শুনে চন্দ্রার চোখ দিয়ে দরদর করে জল ঝরতে থাকে।
'কথা বলো না কেন?'
চন্দ্রা কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু চন্দ্রার গলা দিয়ে কোন স্বর বের হয় না। কেমন যেন একটা কষ্টের দলা গলায় আটকে থাকে। চন্দ্রা দলাটাকে নীচে নামানোর জন্য ঢোক গিলে কিন্তু নামে না।
'কথা বলবে না তো ফোন করতে বলেছো কেন' বলেই অর্জুন ফোনটা কেটে দেয়।
অর্জুন তার ব্যবহারে চন্দ্রাকে সব বুঝিয়েই দিয়েছে। অর্জুন হারিয়ে যায় চন্দ্রার পৃথিবী থেকে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলেও চন্দ্রা অর্জুনকে ভুলতে পারলো না। প্রতিদিন প্রতিক্ষণে সে মনে মনে অর্জুনকে খুঁজে বেড়ায়। অপেক্ষায় থেকে থেকে চন্দ্রা নিজেকে শক্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে।
অভিমানে একদিন সে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় ফলে সব স্যোস্যাল মিডিয়া থেকে দূরে চলে যায় চন্দ্রা। স্বামী, সন্তান আর সংসারের প্রতি মনোযোগী হতে চেষ্টা করে। এত কিছুর পরেও অর্জুনই গোপনে তার সাধনার পুরুষ থেকে যায়। মনে মনে সে অর্জুনকেই পূজা করতে থাকে। এক সময় ধীরে ধীরে চন্দ্রা বিষ্ণন্নতায় ডুবে যেতে থাকে। এখন চন্দ্রার বাগানে আর ফুল ফুটে না। অযত্নে অবহেলায় ফুলের গাছগুলো শুকিয়ে মরে গেছে। গাছের ফলগুলো পেকে মাটিতে পড়ে যায় কেউ তার খবর রাখে না। চন্দ্রার ছেলের পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ থেকে খারাপ হয়। ঘটে যায় চন্দ্রার জীবনে আরো অনেক ঘটনা।
প্রায় বছর খানেক পরের কথা। চন্দ্রার ফোনের ইন্টারনেট এতদিন বন্ধ ছিল। গত পরশু থেকে ওয়াইফাই লাইন পেয়ে ম্যাসেঞ্জারে চন্দ্রাকে এ্যাকটিভ দেখা গেল। সকালে এক অচেনা নম্বর থেকে ম্যাসেঞ্জারে ফোন আসে। চন্দ্রার ছেলে জয় ফোন রিসিভ করলো।
'হ্যালো, কে বলছেন?'
'আমি কি চন্দ্রার সাথে কথা বলতে পারি?'
'মা তো বাসায় নেই।'
'জয় কেমন আছো? তুমি আজ স্কুলে যাও নি?'
'আমরা তো এখন বাংলাদেশে নানার বাড়ি এসেছি '
'তোমার মা কোথায়?'
জয় কাঁদতে থাকে
'কাঁদছ কেন জয়?'
'মাকে কাল হাসপাতালে রেখে এসেছি।'
'কেন কি হয়েছে তোমার মায়ের?'
'সবাই বলছে আমার মা নাকি পাগল হয়ে গেছে'
'কোন হাসপাতালে আছে তোমার মা?'
'জায়গাটার নাম পাবনা'
'পাবনা?'
'হ্যাঁ পাবনার হেমায়েতপুর'
'তোমার বাবা কোথায়?'
'আমরা তো মাকে হাসপাতালে রেখে আগামীকাল ইন্ডিয়া চলে যাব। তাই আজ বাবা গেছে আবার মাকে দেখতে'
'কান্না কর না জয়। তুমি চিন্তা করো না। তোমার মা ভাল হয়ে আবার তোমাদের কাছে ফিরে যাবে।'
'সত্যি বলছেন আঙ্কেল?'
'হ্যাঁ সত্যি। মানুষের অসুখ হয় না? ডাক্তার দেখালে, ওষুধ খেলে ভাল হয়ে যাবে।'
'কিন্তু সবাই যে বলছে আমার মা পাগল। সত্যি কি আমার মা পাগল আঙ্কেল?'
অর্জুন চুপ করে রইলো। এই প্রথম হয় তো চন্দ্রার জন্য অর্জুনের চোখদুটো ভিজে উঠেছিল।
চন্দ্রা শুধু বাংলায়ই বিড়বিড় করে কথা বলছে। তাই ইন্ডিয়ার ডাক্তাররা বাংলায় কথা বলতে পারবে এমন পরিবেশে রেখে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
পরের দিন অর্জুন গেল হেমায়েতপুরের মানসিক হাসপাতালে। অনেজ খোঁজ-খবর করে চন্দ্রাকে খুঁজে বের করলো। এক বছর আগে ভিডিও কলে দেখা সেই চন্দ্রা আর আজকের চন্দ্রার মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান।
অর্জুন বললো, 'কেমন আছো চন্দ্রা?'
চন্দ্রা অনেকক্ষণ অর্জুনের দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল। অর্জুনকে চিনতেই পারে নি চন্দ্রা।
আরও গল্প পরতে ক্লিক করুন
No comments