নুপুর-১
বিশাখার যেমনি রুপ, তেমনি তার মুখ আর ঠিক তেমনই তার হাতের কাজ। কোনটার চেয়ে কোনটা কম নয়। হালিমা, খুশির মা, বেলার মা যে কাজ তিনদিনে করে সেই একই কাজ বিশাখা করে মাত্র একদিনে। বিশাখাকে কোন কাজের কথা দুই বার বলতে হয় না। সূর্য উঠার আগেই বিশাখা কাজে চলে আসে। কাজেকর্মে কোন ফাঁকফোকর নেই। এজন্য সারা গ্রামে বিশাখার চাহিদা বেশী। একদিনও তার বসে থাকার জো নেই। করো বাড়ীতে মেয়ে-জামাই আসবে, পিঠা বানাতে হবে, বিশাখার ডাক পড়ে।ঘরদোর লেপামুছা করতে হবে, বিশাখাকে দরকার। ধান সিদ্ধ করতে হবে তাতেও বিশাখাকে চাই। কারণ তার মতো নিখুঁত কাজ আর কাউকে দিয়ে হবে না।
নয় বছরের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বিশাখা খ্রীষ্টান পাড়ার এক বাড়ীতে থাকে। বাড়ীর মালিক পরিবার নিয়ে থাকেন ঢাকায়। বিশাখা সারাদিন অন্যেরবাড়ী কাজ করে রাতে ঐ বাড়ীর এক ঘরে রাত্রী যাপন করে ছেলে হাসুকে নিয়ে। প্রায় তিন বছর ধরে বিশাখা এই সূর্যনগর গ্রামে আছে। বিশাখার ছেলে হাসু সুর্যনগর সরকারী বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। বিশাখা যেদিন যে বাড়ীতে কাজ করে হাসুও সেদিন সে বাড়ীতে খায়। তবে এতে কোন সমস্যা নেই কারণ বেলার মা বা হালিমার সাথেও একটা করে বাড়তি মুখ আছে। বরং বিশাখাকে কাজে নিলে গৃহর্কতারই লাভ হয় কেননা তিন দিনের কাজ বিশাখা এক দিনেই উৎরে দিতে পারে। এটাই বিশাখার চাহিদার মূল কারণ। তবে বিশাখার এই ব্যাপক চাহিদা সত্ত্বেও গ্রামের মহিলাদের কাছে বিশাখা একেবারেই অপছন্দের। আর এর প্রধান কারণ হচ্ছে বিশাখা পায়ে নূপুর পড়ে। মহিলাদের কথা হচ্ছে, 'কাজের বেটি পায়ে নূপুর পড়বে কেন?'
বিশাখাও কথায় কম যায় না। তার এক কথা, 'দেখ মাসি আমার বয়স মাত্র ছাব্বিশ বছর। তোমাদের ঘরের মেয়ে বউরা কি পায়ে নূপুর পড়ে না? তারা পড়লে যদি দোষ না হয় তবে আমার দোষটা কোথায়? কাজ কইরা খাই বইলা কি আমার কোন সখ আল্লাদ নাই?'
এর পর আর কিছু বলা চলে না। তবে অনেকে আবার মনে করেন যেদিন বিশাখা তাদের বাড়ীতে কাজ করে সেদিন গৃহকর্তারা অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেকটা বেশী সময় বাড়ীতে কাটান। যেমন, সকালে বাজার থেকে তারাতারি ফেরেন, বিকেলে হাঁটাহাঁটির সময়রও নাকি দেরীতে যান তারাতারি ফেরেন এমন কথা শোনা যায়।
বিকেলে স্নান করে বিশাখা চুল মেলে দিলেই গৃহিণীদের চোখ টাটায়। তাদের ধারনা কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো বিশাখা ইচ্ছে করেই বেশী বেশী দুলিয়ে হাঁটে। এ ব্যাপারে গৃহিণীদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা থাকলেও প্রকাশ্যে তো আর এ সব আলোচনা করা চলে না তাই যত দোষ ঐ পায়ের নূপুরের। যদিও বিশাখার চলাফেরা কিংবা কথাবার্তায় কাউকে আকর্ষণ করার কোন লক্ষণই নেই। সবই স্বাভাবিক।
কাজের নৈপুন্যের জন্য আশেপাশের হিন্দু-মুসলিম পাড়া থেকেও বিশাখার ডাক আসতে থাকলো। তবে বিশাখা খ্রিষ্টান পাড়া ছেড়ে অন্য পাড়ায় কাজ করতে নারাজ। এমন কি আশেপাশের পাড়া থেকে তাকে বেশী মজুরি দেওয়ারও প্রলোভন দেওয়া হলো। খ্রিষ্টানপাড়া একদিন কাজ করলে তিন বেলা খাওয়াসহ দেওয়া হয় আধা কেজি চাল। চালের কেজি দশটাকা হিসেবে আধা কেজি চালের দাম মাত্র পাঁচ টাকা। এদিকে আশেপাশের পাড়া থেকে তাকে তিনবেলা খাওয়াসহ নগদ দশটাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলো।
বিশাখা এক কথার মানুষ। সে অন্য পাড়ায় কাজ করবে না। তবে এই সুযোগটা বিশাখা হাতছাড়া করলো না। সে খ্রিষ্টান পাড়ার সর্বত্র জানিয়ে দিল তার মজুরি বাড়াতে হবে। বিশাখার দাবী, তাকে কাজে নিলে তিনবেলা খাওয়া এবং আধা কেজি চালের সঙ্গে নগদ দুই টাকা দিতে হবে।
গৃহিণীরা গর্জে উঠলেন। এত বড় কথা? সবাই যদি আধা কেজি চালের বিনিময়ে কাজ করে তবে তাকে কেন আরো দুই টাকা বেশী দিতে হবে? সবাই মিলে পরামর্শ করলেন তারা আর বিশাখাকে কাজে নেবেন না। তখন বিশাখার দেমাগ কই যায় তারা দেখে নেবেন। তাদের ধারণা বিশাখা কাজ না পেলে সেধেই তাদের কাছে আবার পুরানো মজুরিতে কাজ করবে।
মহিলাদের আন্দোলনের কথা বিশাখারও কানে গেল। সেও বাড়ীতে চুপচাপ দিনদুই বসে রইলো। টানা তিন বছর সে একনাগারে কাজ করেছে এবার শরীরকে একটু বিশ্রাম দেওয়া দরকার। ঠিক সেই সময়ে স্কুলে আম-কাঁঠালের ছুটি হলো। বিশাখা ছেলেকে নিয়ে শেখরনগর বাপের বাড়ী বেড়াতে গেল। হাসু খুবই খুশি। কত ছুটিছাটা যায়, স্কুলের সব বন্ধুরা তাদের মামার বাড়ী দাদার বাড়ী বেড়িয়ে আসে। হাসুর আর কোথাও যাওয়া হয় না। খুশিতে যাওয়ার আগের দিন হাসুই সর্বত্র বলে বেড়ালো তারা নানীর বাড়ী যাচ্ছে। ফলে সারা গ্রামে চাউর হয়ে গেল বিশাখার প্রস্থানের খবর। মহিলারা বেজায় খুশি এবার বিশাখার উত্তম শিক্ষা হয়েছে। কাজ না পেয়ে কাঁথা বালিশ গুছিয়ে বিশাখা গ্রাম ছেড়েছে।
বিশাখা তো গেল চলে তবে সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়লেন গ্রামের মহিলারাই। খুশির মা, বেলার মা আর হালিমাকে দিয়ে তাদের পোষাচ্ছে না। খুশির মা তো কাজে আসেন সকাল নয়টায়। এসেই মুড়ি আর চায়ের পেয়ালা নিয়ে বসেন। মুড়ি চিবাতে চিবাতে সারা গ্রামের কেচ্ছা শুরু করেন। সেখানে চলে যায় তার প্রায় ঘন্টা খানেক। আর যদি পাতা ঝাড়ু দিতে যান তবে পাতার গায়ে বাতাসও যেন লাগে না। বাড়ীর উঠোন দিয়ে ভিখিরিসহ যে লোক যাবে তার সাথেই কথা বলতে হবে। কি কথা হলো সেই কথা আবার ইনিয়ে বিনিয়ে গৃহিণীদের বলবেন। তার নাকী আবার শিলেশ্বর আছে। ঠান্ডা পানির কোন কাজ করবেন না। কাপড় ধুতে পারবেন না। দুপুর দুইটার আগে স্নান করবেন। স্নান করতে আবার বাড়ী যাবেন। আসবেন ঘন্টাখানেক পর। সাথে আনবেন টিফিন ক্যারিয়ার। দুপুরে ভাত খেয়ে রাতের খাবার নিয়ে ঘড়ির কাটা ধরে বিকেল চারটায় সময়ই তিনি ফুট্টুস। আগে এত সমস্যা ছিল না। বিশাখার প্রস্থানের পরই এসব সমস্যার উদয়। বেলার মাকে নিলে আরেক সমস্যা। তিনি আবার ভারী কাজ করবেন না। পিঠা বানানোর কাজ তিনি পছন্দ করেন। কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া তো আর পিঠা-পায়েস করা চলে না। হালিমাকে কাজে নিলে রান্নার আয়োজন যেনতেন হলে হবে না। কারণ তিনি কোন বাড়ীতে কাজে গিয়ে কি খেয়েছেন তা আবার অন্য বাড়ীতে রসিয়ে-কষিয়ে বলে বেড়াবেন। শুধু তাই নয়, রান্নায় তেল-লবণের পরিমান কেমন ছিল তারও বিস্তারিত বলতে ছাড়বেন না। বিশাখা বাপের বাড়ী যাওয়ার দিন দশের মধ্যেই গৃহিণীদের কাছে তার গুরুত্ব আবার নতুন করে প্রমানিত হলো।
এদিকে ছেলের স্কুল শুরু হওয়ার আগের দিন বিশাখা গ্রামে এসে হাজির। বিশাখার প্রস্থানে যারা বিজয়ের হাসি হেসেছিল, তার আগমনে তারাই আবার স্বাস্তির হাসি হাসলো। বিশাখা ভর সন্ধ্যায় বাড়ীতে পৌঁছালে দেখা গেল একে একে বেশ কয়েকজন গৃহিণী পরেরদিন কাজের জন্য বিশাখাকে অনুরোধ করতে গেল।
বিশাখার চাহিদামত নগদ দুটো টাকা বেশী দেওয়ার বিষয়টিও গোপনে ফায়সালা হয়ে গেল। তবে বিশাখা আরো দুটো দিন সময় নিল বিশ্রামের জন্য। মুখের সামনে হাসির ফোয়ারা ফুটালেও বিশ্রামের কথা শুনে গৃহিণীরা আবার চটে গেলেন। কাজের বেটির আবার বিশ্রাম কি? দশ দিন তো নূপুর পায়ে দিয়ে বাপের বাড়ী দিব্যি ঘুরে বেড়িয়ে এলো এখন নাকী আবার বিশ্রাম। যত্তসব, ব্যাঙ্গের আবার সর্দি।
আগামী পরশু যার বাড়ীতে কাজে যাবে তিনি নিচু স্বরে বলে গেলেন, 'বিশাখা পায়ের নূপুরটা খুলে কাজে যাবি কিন্তু বুঝলি?'
বিশাখা সবে স্নান করেছে। চুল শুকাচ্ছিল তাল পাতার বাতাসে। সে কারো দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিল, 'বিশাখা এই জীবনে আর পায়ের নূপুর খুলবো না। তারে যদি কাজে নিতেই হয় তবে সে নূপুর পইড়াই কাম করবো।'
গৃহিণীদের বলার আর কিছু নেই। যে চারজন তাকে কাজের কথা বলতে এসেছিলেন তারা কেউ একদিন কেউ দুইদিনের এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে বিশাখার বাড়ীর বাইরে গিয়েই আবার শুরু করলো,
প্রথমজন, 'মাগির কথা শুনছো? জীবনে নাকী পায়ের নূপুর খুলবো না। জমিদারের বেটি আইছে।'
দ্বিতীয়জন, 'মাতারি কথা যে কইলো, একবার নি আমাগো দিকে তাকাইছে।'
তৃতীয়জন, 'হ এমন কইরা কথা কইলো যেন আমরাই ওর চাকর।'
চতুর্চথ, 'গেছিল তো আবার আইলো ক্যা?'
প্রথমজন, 'কপালে ভাত জুটে নাই তাই ফিরা আইছে।'
দ্বিতীয়জন, 'মাগীর যে ত্যাজ কে দিব ওরে ভাত? দেমাগ দ্যাখাইয়া গেল আবার ব্যহায়ার মতো ফিরা আইলো।'
তৃতীয়জন, 'এ রকম জেদি মাগী গো কপালে না জুটে ঘর না জুটে বর।'
যার যার বাড়ী না যাওয়া পর্যন্ত এ রকমই মন্তব্য চলতে থাকলো।
দুই দিন বিশ্রাম শেষে বিশাখা আগের মতোই বাড়ী বাড়ী কাজ শুরু করলো। সেই আগের মতোই গৃহিণীরা বিশাখার আগে পিছে ট্যা ট্যা করতে লাগলো। সময় সুযোগ বুঝে মুখের সামনেও তিরস্কার করতে লাগলো। আর বিশাখাও তো ছেড়ে কথা বলার পাত্রী নয়। সেও মুখের উপর উপযুক্ত জবাব দিতে ছাড়লো না।
বিশাখা নিজের মনে কাজ করে। কোনো বাড়ীর কথা কোনো বাড়ীতে বলে বেড়ায় না। কারো কোন ক্ষতি করে না তবে কেন যে সবাই তার বিপক্ষে তা বিশাখার বোধগম্য নয়। এভাবেই চলতে লাগলো দিন। এর মধ্যে নাকী বিশাখার বেশ কয়েকটি বিয়ের প্রস্তাব এসেছে আর সেসব খুশির মা মারফত শোনা কথা। গ্রামের সব গৃহিণীরাই জানেন এই খবর। তাই তারা একত্র হলেই আবার আলোচনা-
প্রথমজন, 'বিয়ার প্রস্তাব আইছে তো বিয়া বহে না ক্যা?'
দ্বিতীয় জন, 'বিয়া হইলে কি আর নষ্টি ফষ্টি করতে পারবো'
তৃতীয়জন, 'যেই ব্যাটা ওরে বিয়া করবো তার খবর আছে। যে মুখ ওর'
চতুর্থজন, 'খ্রিষ্টান পাড়ার ভাতের স্বাদ পাইছে না। এখন অন্য পাড়ার ভাত ওর মুখে রচবো?'
প্রথমজন, 'মাগীর আক্কলটা দেখছো এত বড় একটা পুলা। এহনো পায়ে নূপুর পড়ে। শরমলজ্জা বলতে নাই।'
সবাই একত্র হলে বিশাখার গুণকীর্তন ছাড়া এদের যেন কোন কাজই নেই।
বিশাখাকে যেমন তারা সহ্য করতে পারে না আবার বিশাখাকে ছাড়া তাদের কাজও যেন উদ্ধার হয় না।
বিশাখাকে উচিত শিক্ষা দিতে আবারও গৃহিণীরা এক হলো। এবার মেঘ না চাইতেই যেন জল। একদিন এক গৃহিণী সন্ধ্যার পরে কর্তার সাথে বাজার থেকে ফিরছিলেন। বিশাখার বাড়ীর পাশ দিয়ে ফেরার পথে গৃহিণীর চোখে পড়লো কোন এক পুরুষ বিশাখার ঘরে প্রবেশ করছে। এই তো দারুন এক সুযোগ যেন হাতে এসে ধরা দিল। গৃহিণী বাড়ী ফিরে কোন রকমে হাতের জিনিষপত্র ফেলে রেখেই ছুটলো তার সাথীদের তাজা খবরটা দিতে। সন্ধ্যা পার হয়েছে অনেক আগেই তবুও যে কয়জনকে পারলেন তিনি খবরটা পৌছে দিলেন। একজন বুদ্ধি দিলেন বেশী মানুষকে জানাতে না। কারণ বিশাখা জানতে পারলে আগেই সতর্ক হয়ে যাবে। তাছাড়া খবরের সত্যতাটাও দেখা দরকার। কোন পুরুষ কি দরকারে বিশাখার ঘরে গেছে তার বিস্তারিত না জেনে পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না।
বুদ্ধিমতি গৃহিণীর কথা মতো ব্যপারটি কয়েকজনের মধ্যেই গোপন রইলো। তিনি তার ছেলেকে বললেন এ ব্যাপারে খোঁজখবর করতে। যুবক ছেলে সন্ধ্যার পর বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয় তাই সে খবরের সত্যতা যাচাইয়ের দায়িত্ব নিলো। ছেলে তার বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করে বিশাখার বাড়ীর চারপাশ দিয়ে কয়েকটি চক্কর দিল। কিন্তু তেমন কোন আলামত খুঁজে পেল না। তারা বিশাখার ঘরের টিনের বেড়ার ফাঁক ফোকর দিয়ে দেখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। কারণ নতুন টিনের ঘর কোন ফুটোফাটা নেই। কি আর করা যায়। সেদিনের মতো ছেলেদের অভিযান শেষ হলো। পরের দিন দিনের বেলা বিশাখা কাজে গেলে বিশাখার ছেলেও স্কুলে গেল। দুপুরের এক ফাঁকে গ্রামের মানুষ যখন খুব একটা ঘর থেকে বের হয় না ঠিক তখন ছেলেরা গিয়ে পেরেক আর হাতুরি দিয়ে বিশাখার ঘরের টিনের বেড়ায় কয়েকটি ফুটো করে দিয়ে এলো।
বিশাখার বাড়ীর চারপাশে বড়বড় আম গাছ। সন্ধ্যা থেকেই ছেলেরা ঐ সব আম গাছের আড়ালে ওঁত পেতে রইলো কখন কে বিশাখার বাড়ী আসে তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য। গরমের দিন। সন্ধ্যা হয় অনেক দেরীতে। বিশাখা কাজ সেরে বাড়ী ফিরলো সাতটায়। হাসুও ফিরেছে তার সাথে। রাত সাড়ে সাতটার দিকে দেখা গেল সত্যিই কেউ একজন বিশাখার বাড়ীর দিকে আসছে। লোকটি এদিক সেদিক তাকিয়ে ঘরের শেকল নাড়লো। বিশাখাও ঘরের দরজা খুলে দিল যেন তার জন্যই সে অপেক্ষা করছিল। ছেলেরা অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে সব দেখছিল।
একজন বললো, 'বিশাখাকে ডাকলে কেমন হয়?'
আরেকজন বললো, ;অপেক্ষার কর, আগে খেলা জমতে দে, দেখি না কি হয়।'
অন্ধকারে বেড়ার ফুটোয় চোখ রেখে মশার কামড় খেতে খেতে ছেলেরা অপেক্ষা করতে লাগল কখন খেলা জমে। এদিকে বিশাখার ঘরে বৈদ্যুতিক বাতি নেই। হারিকেন নিভু নিভু করে চৌকির এক কোনায় রাখা হয়েছে আর কুপি বাতি জ্বালিয়ে বিশাখা ভাত খাবার আয়োজন করছে। লোকটির চেহারা ভাল বোঝা যাচ্ছে না। লোকটি হাসুর সাথে চৌকিতে শুয়ে আছে। অন্ধকারের জন্য চৌকির দিকটাও ভাল দেখা যাচ্ছে না। ভাত খাবার প্রস্তুত করে বিশাখা ডাকলো, 'হাসু তর কাকারে নিয়া খাইতে আয়'
ছেলেরা চিন্তিত। হাসুর কাকা হয় নাকি? কিন্তু যে লোকটি হাসুর হাত ধরে খেতে এলো তিনি অপরিচিত কেউ নন। তিনি মনিপাড়ার হরিলাল কাকা। কিন্তু হরিলাল কাকার সাথে বিশাখার সম্পর্ক থাকবে কেন। হরিলালের বৌ আছে আরো আছে তিন মেয়ে। তিনি এখানে কি করেন। এমন সময় বিশাখা বললো,
'হাসু তর কাকারে ক প্রত্যেকদিন মোগলাই পরোটা খাইলে আমি কিন্তু মোটা হইয়া যামু। তখন কিন্তু আমারে তর কাকায় আর পছন্দ করবো না।'
ওরে বাব্বা এ সব আবার কি কথা। ছেলেরা তো 'থ'।
'মা কাকায় আইজও মোগলাই পরোটা আনছে?' বলেই হাসু খেতে শুরু করলো। হরিলালও খাচ্ছে আর বিশাখা বাতাস দিচ্ছে। ওমা একি হরিলাল বিশাখাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। ছেলেদের কাছে সব পরিস্কার হয়ে গেল। এটি অনৈতিক সম্পর্ক ছাড়া আর কিছু না। হাসুর খাওয়া শেষ। বিশাখা হাসুকে বললো, 'হাসু কাকারে বাতাস কর।'
হাসু লক্ষী ছেলের মতো হরিলালকে বাতাস করতে লাগলো। বিশাখা খেতে যাবে আর এমন সময় হরিলাল বললো, 'আজ তুমার হাতে খাইতে হইবো না আমিই তুমারে আইজ খাওয়াইয়া দিব।'
বিশাখা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। হরিলাল বিশাখাকে খাওয়াচ্ছে আর হাসু বাতাস দিচ্ছে। ঠিক সেই সময় দরজায় জোরে জোরে লাথি পড়তে লাগলো।
অনেক চিৎকার চেচামেচির পর দরজা খোলা হল। দুজনকে টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করা হলো। খাবারের থালা উল্টো পড়ে রইলো। হাসু পুরো ঘটনায় হকচকিয়ে গেল। হরিলালকে দুয়াবে বের করেই এলোপাথারি লাথি মারতে লাগলো ছেলেরা। একজনের হাতে আবার বাঁশ। সে বাঁশ দিয়ে হরিলালকে দিল কয়েকটা বারি। হরিলালের হাঁটুর নিচে কেটে রক্ত পরতে লাগলো।
এদিকে মহিলারা আগে থেকেই দরজা খুলে অপেক্ষা করছিলেন। ঘটনার সত্যতা জেনে একজন খবর দিতেই মহিলার দল এসে উপস্থিত। আর তারা নিয়ে পরলেন বিশাখাকে। বিশাখার চুলের মুঠি ধরে তারা উত্তম মধ্যম দিতে লাগেন। বিশাখার পায়ের নূপুরের উপর যার যত জ্বালা ছিল সবাই তা মিটিয়ে নিলেন।
শাস্তির প্রথম পর্ব শেষ হলে দুজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো গ্রামের মাতব্বরের বাড়ীতে বিচারের জন্য। রাত তখন দশটা। এদিকে হরিলালের বাড়ীতে খবর দেওয়া হলো। হরিলালের বৌ তিন মেয়ে ও প্রতিবেশী কয়েকজন পুরুষ নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এসে উপস্থিত হলো। বাকী গ্রামবাসীরাও উপস্থিত। সবার উপস্থিতিতে মাতব্বর দুজনকে জুতাপেটা করার রায় দিলেন। বিশাখার একমাত্র বুকের ধন হাসু, হরিলালের বৌ-তিন মেয়ে আর গ্রামবাসীর সামনে দুজনকে জুতাপেটা করা হলো। আর বিশাখাকে ঐ রাতের মধ্যেই গ্রাম ছাড়ার র্নিদেশ দেওয়া হলো। বিচার শেষ।
দুজনের শরীরে কেটে ছিড়ে রক্তাত অবস্থা। হরিলাল চোখ মেলতে পারছেন না। একটা চোখ ফুলে ঢোল। একটা পা ভেঙ্গে গেছে। হরিলালের বউ এসে হরিলালকে উঠানো চেষ্টা করছে আর বিশাখার চৌদ্দ গোষ্ঠির নাম উদ্ধার করছে। বিশাখার ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। হাসু চিৎকার করে কেঁদেই চলছে। কারো হৃদয়ে একটু মায়ার উদয় হলো না। গ্রামবাসীরা সবাই সাধ্যমত গালিগালাচ করে যার যার বাড়ী চলে গেলেন। হরিলালের বউ তার সাথে আনা প্রতিবেশেীদের সহায়তায় হরিলালকে নিয়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
সাহসী, কর্মঠ, আত্মপ্রত্যয়ী বিশাখা উঠোনে নির্জীব পড়ে রইলো। মাতব্বরের নাতী প্রদীপ হাসুর বয়সী। তারা সাথে একই ক্লাসে পড়ে, একই সঙ্গে খেলাধুলা করে। প্রদীপ জানালা ধরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। বন্ধু আর তার মায়ের অসহায়ত্ব দেখে প্রদীপের ছোট্ট মনটা ভারাক্রান্ত। চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। মাতব্বর তার বাড়ীর গেট বন্ধ করার জন্য চাকরকে আদেশ দিয়ে নাতীর হাত ধরে ঘরের ভেতরে চলে গেলেন। আট বছরের ছোট্ট হাসু অনেক কষ্টে মাকে উঠাতে চেষ্টা করে বার বার ব্যর্থ হল। মাতব্বর বাড়ীর চাকর বিশাখাকে বাড়ী ছাড়ার জন্য বারবার তাগিদ দিতে লাগলো।
একসময় ছোট ছেলের হাত ধরে অনেক কষ্টে বিশাখা উঠে দাঁড়াল। সেই রাতের পর থেকে বিশাখার আর কোন সন্ধান কেউ জানলো না।
আরও পড়তে ক্লিক করুন
No comments