মুরগীর রান -কি আছে এতে সম্মান নাকি পেটুকতা!
খুব ছোটবলায় বিটিভিতে একটা নাটক দেখেছিলাম যার বিষয়বস্তু ছিল এক বিয়ে বাড়ির ঘটনা। খাওয়ার সময় বরের দুলাভাইয়ের পাতে ভুলক্রমে মুরগীর রান পরেনি বলে সে এক বিরাট গন্ডগোল। শেষমেষ বিয়েটি ভেঙ্গেই গেল।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক চালচিত্র বর্ণনা দিতে গিয়ে দেশী-বিদেশী অনেক আলোচনায় বিয়ে বাড়ির এই ঘটনাটি আমাকে বলতে হয়েছে। এমন কি অনেক সময় বন্ধুদের আড্ডায় ঘটনাটি হাসির খোড়াকও যুগিয়েছে। তবে সব শেষে আমি দৃঢ়তার সাথে একটি কথাই বলেছি আর তা হলো যে ঘটনাটি নাটকে দেখানো হয়েছিল সেটি ছিল প্রায় ২৬/২৭ বছর আগেকার। বর্তমানে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আর আমাদের খ্রিষ্টানদের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা কখনোই ঘটে না।
দীর্ঘ আট বছর পর দেশে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল গত জানুয়ারীতে। আর সেখানে নিজের চোখে যা দেখলাম বর্ববরতার মাপ কাঠিতে তা ২৬ বছর আগে দেখা নাটকের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
বর-কনের বাড়ী একই গ্রামে হওয়ায় দুই পরিবারের সব আত্মীয়-স্বজনই একে অপরের পরিচিত। বিয়ের দিন দুপুরে বরের বাড়ীতে খাবার পরিবেশন শুরু হলে একজন মা তার এসএসসি পরীক্ষার্থী ছেলেকে একটি টেবিলে বসিয়ে দিলেন। পরের দিন গনিত পরীক্ষা থাকার কারণে মা তার ছেলেকে তাড়াতাড়ি খেয়ে বাড়িতে চলে যেতে বললেন। আর তখনই একজন কোটপরা ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে নিয়ে ছেলেটির পাশে বসলেন। খাদ্য পরিবেশনকারী প্লেটে করে পোলাও ও মুরগীর রোষ্ট পরিবেশন শুরু করলেন। দেখা গেল এসএসসি পরীক্ষার্থী ছেলেটি এবং কোটপরা ভদ্রলোক মুরগীর রান পেয়েছেন। আর ভদ্রমহিলাটি পেয়েছেন অন্য সাধারন একটি টুকরো। পরীক্ষার্থী ছেলেটি খাবার জন্য প্লেটে হাত দিতেই ভদ্রলোক ছেলেটিকে থামিয়ে দিয়ে ছেলেটির সামনে থেকে রানসহ প্লেটটি নিয়ে তার স্ত্রীকে দিলেন আর স্ত্রীর প্লেটটি নিয়ে ছেলেটিকে দিলেন।ছেলেটি কিছু না বলে তাড়াতাড়ি খেয়ে চলে গেল। আমার মনে হলো ঐ ছেলের জায়গায় অন্য কোন ছেলে হলে নিশ্চয়ই তথাকথিত ভদ্রলোকের এমন কাজের প্রতিবাদ করতো। যাই হোক স্বামী-স্ত্রী তৃপ্তির ঢেকুর তুলে খেলেন।
কেন ভদ্রলোক ছেলেটির প্লেট পরিবর্তন করলেন? আসলে কি ছিল ঐ প্লেটে? মুরগীর রানই তো ছিল?
বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত যে দেশী মুরগী যেগুলো হাঁটে-দৌড়ায় সেগুলোর রানের মাংসে আয়রনের পরিমান বেশী থাকে। হাঁটা এবং দৌড়ের মতো পরিশ্রমের কারণে মুরগীর পেশী সবল হয় এবং মাংস কিছুটা লালচে হয়। মুরগীর ঐ লালচে রানের মাংসে গরু কিংবা খাসির মাংসের প্রায় সমপরিমান আয়রণ থাকায় মুরগীর রানকে রেডমিট বললেও কোন অংশেই ভুল হবে না। তবে সেটা অবশ্যই দেশি মুরগী, ফার্মের মুরগী নয়। ফার্মের মুরগী যেহেতু শুয়ে-বসে কাটায় তাই এই মুরগীর রানসহ গোটা শরীরে একই সমপরিমান পুষ্টিগুণ বজায় থাকে।
তাহলে ভদ্রলোক কেন অন্যের রানসহ প্লেটেটি চুরি করেছিলেন? রানের মধ্যে কি তাহলে কোন সম্মান লুকিয়ে আছে?
বাড়িতে সাধারনত পুরুষ সদস্যদেরই রানের মাংসটা দেওয়া হয়, নয় তো ছোট ছেলেমেয়েদের। কোন মা কি বলতে পারবেন সন্তানকে রেখে তিনি নিজে রানের মাংস খেয়েছেন? আমি হলফ করে বলতে পারি আমরা এমন একজন মাকেও খুজে পাব না। কারণ রানের টুকরোটিকে আমরা এতো সম্মান দিয়ে ফেলেছি যে সেটি কেবল স্বামী-সন্তানদেরই প্রাপ্য। আর তাই তো খাদ্য পরিবেশনকারী মমতাময়ী মাকে বাদ দিয়ে পুরুষ এবং ছোট ছেলেটিকে রানের টুকরো দিয়েছিলেন। এবার তাহলে চিন্তা করে দেখুন বিয়ে বাড়িতে ভদ্র লোকটি কিভাবে ছোট ছেলেটির সামনে থেকে প্লেটটি নিলেন এবং ভদ্র মহিলাটিই বা কিভাবে ছেলেটির কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া রানটি খেলেন?
এখন আমি আর ঐ লোককে ভদ্রলোক বলছি না। আসলে লোকটি একজন চোর। যে কিনা ছোট একটা ছেলের প্লেট থেকে মুরগীর রান চুরি করেছেন। লোকটি একজন প্রতারক যে কিনা ছোট ছেলের প্লেটটি বদলিয়ে নিজের স্ত্রীকে দিয়েছেন। লোকটি আসলে নির্দয়-লোভী যে কিনা ছোট একটি ছেলের মন ভেঙ্গে দিয়ে রান খাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে ছেলেটিকে ঠকিয়েছেন। আর সেই স্ত্রী লোকটি হচ্ছেন মা জাতের কলঙ্ক যে কিনা সন্তানের বয়সী ছেলের মুখের অন্ন কেড়ে নিয়ে আনন্দের সঙ্গে খেয়েছেন।
এবার আরেকটি ঘটনা বলি, একজন মহিলা নিজের মেয়েকে এবং কাজের মেয়েকে নিয়ে এক বিয়ে বাড়িতে গেছেন। ১২ জনের টেবিলের সবাই মুরগীর অন্যান্য টুকরো পেলেও দুর্ভাগ্যবশত কিংবা সৌভাগ্যবশত কাজের মেয়েটির প্লেটে রান পড়লো। বিধাতাও হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন কাজের মেয়েটি তার আট বছরের জীবনে কখনো মুরগীর রান খায় নি। কিন্তু হায়! রান খাওয়ার কপাল নিয়ে যে মেয়েটি জন্ম নেয় নি। কারণ মহিলাটি আট বছরের কাজের মেয়ের প্লেটটি একইভাবে বদলী করে তার পনের বছরের মেয়েকে দিয়েছিলেন। কারণ বাড়ীর কাজের মেয়ের রান খাওয়ার অধিকার নেই।
পাঠক বন্ধুরা, এই ঘটনা বিশ্লেষনের দায়িত্ব আপনাদের উপরেই ছেড়ে দিলাম।
এসব তথাকথিত ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা আমাদের খ্রিষ্টান সমাজে আরো অনেক আছে। টাইকোট পরলেও খাবার টেবিলে এদের আসল ভদ্রতা ধরা পরে। এরা যদি দিনের আলোতে জনসম্মুখে অন্যের প্লেটের রান চুরি করতে পারে তবে আরো বড় ব্যাপারে এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে আরো কত কি ই না করতে পারে?
এই ঘটনা দেখার পর কেন জানি আমার বার বার মনে হয়েছে ভাগ্যিস খ্রিষ্টানদের খাবার পরিবেশন করা হয় বিয়ে পড়ানোর পর। নয় তো খ্রিষ্টানদের অনেক বিয়েও হয় তো ভেঙ্গে যেত মুরগীর রান না পাওয়ার কারণে।
আসলে মুরগীর রানে কোন সম্মান নেই। সম্মান লুকিয়ে থাকে আমাদের আচার-ব্যবহারে। মুরগীর রান চুরি করে খেলেও আপনাকে কেউ সম্মান করবে না বরং লোভ-পেটুকতা সংবরণ করলে আপনার সংযমী আচরনের জন্য মানুষ আপনাকে সম্মান করবে।
No comments