সম্পর্ক
পিপ
পিপ পিপ। বাঁশির এই শব্দ কানে আসা
মাত্রই আমরা যে যেখানে
থাকতাম ছুটে বাড়ী চলে আসতাম।
আমরা জানতাম কানা রঞ্জন ভিক্ষা
চাইতে এসেছেন। সারাদিনে অনেকেই ভিক্ষা চাইতে আসতো। তাদের কাউকেই আমরা ভিক্ষা দিতাম
না। মায়েরা দিতে বললেও কেমন যেন অনিহা
নিয়ে দিতাম। তবে কানা রঞ্জনের
ব্যাপারটাই ছিল আলাদা। আমাদের ডেকে আনার দারুণ
এক কসরত জানতেন তিনি।
আর সেটি হচ্ছে তার
বাঁশি। তার বাঁশের বাঁশির
শব্দ শুনে মনে হতো যেন
পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য ব্যপার ঘটছে। কি মধুরই না
লাগতো।
তাকে
আমরা কানা রঞ্জন বললেও
তিনি ছিলেন পুরোপুরি অন্ধ, জন্মান্ধ। কিছুই দেখতেন না তবে তার
অদ্ভুদ কতগুলো গুণ ছিল। যেমন,
যাদের সাথে তার একবার
পরিচয় হতো শুধুমাত্র গলার
স্বর শুনে তিনি বলে
দিতে পারতেন কার সাথে তিনি
কথা বলছেন, আগে কোথায় সেই
ব্যক্তির সাথে তার পরিচয়
হয়েছিল, তার বাড়ী কোথায় বিস্তারিত।
কানা রঞ্জনের বয়স তখন চল্লিশ
কি পঁয়তাল্লিশ হবে। নীল চেক লুঙ্গি
আর হালকা নীল রঙ্গের শার্ট
পড়তেন তিনি। কাঁধে একটা ঝোলা। হাতে একটা বাঁশের
লাঠি আর সেটাকেই অদ্ভুত এক কসরতে বাজাতেন
তিনি। আমার বুদ্ধি হবার পর থেকেই
আমি কানা রঞ্জনকে দেখেছি।
তিনি আমাদের গ্রামে আসতেন প্রতি বুধবারে। আমাদের বাড়ী আসতে আসতে
তার বেজে যেত বেলা
দশটা কি সাড়ে দশটা। আমি
তখন প্রাইমারি স্কুল পড়ি। দশটায় স্কুল
শুরু হতো। কানা রঞ্জন দশটার
আগে আগে আসলে বাড়ীতেই
দেখা হতো আর যদি
তার একটু দেরী হতো
তবে হয় তো স্কুলের পথে
আশে পাশে কোথায়ও দেখা
হতো। আমি বলতাম, ‘বলতো
আমি কে?’
কানা
রঞ্জন বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে বলতেন, ‘তুমি
শিউলি, স্কুলে যাও বুঝি?’
আমরা একে একে সব বান্ধবীরা আমাদের নাম জিগ্যেস করতাম। কানা রঞ্জন প্রতিবারেই নির্ভুলভাবে আমাদের নাম বলে দিতেন। শুধু নাম নয়, তিনি আমাদের বাড়ীর নাম এবং বাবার নামও বলে দিতেন।
কানা রঞ্জন মুসলমান হলেও তিনি কোন মুসলমান গ্রামে ভিক্ষা করতে যেতেন না। তিনি সপ্তার সাতদিন সা তটি খ্রিষ্টান গ্রামে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করতেন। একদিন ভিক্ষা দেওয়ার পর কানা রঞ্জন আমার মাকে জিগ্যেস করলেন, ‘মাসি আপনার বড় ছেলের বয়স কত হইলো? বিয়ে সাদী করাইবেন না?’
আমার
মা বাইরের মানুষের সাথে অকারণে ঘরের
গল্প করতে পছন্দ করেন
না। তাই অনিহা সত্যেও বললেন, ‘হ্যাঁ ছেলের বিয়ের বয়স তো হয়েছে।‘
‘মেয়েটেয়ে
দেখছেন মাসি?’
মা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কেন
তুমি আবার ঘটকালিও কর
না কি?’
‘না
মাসি ঘটকালি করি না। তবে
জানাশুনা অনেক মেয়ে আছে
তো তাই আর কি
বললাম।‘
‘তুমি
তো একজন মুসলমান, খ্রিষ্টান
মেয়েদের খবর তুমি জান
কিভাবে? তাছাড়া তুমি তো চোখেও দেখনা।‘
‘হ
মাসি আমি চোখে দেখি
না ঠিকই, তবে মাসি আপনাগো
এই গ্রামে অনেকগুলো সম্বন্ধ কিন্তু আমি ঠিক করে
দিছি। ঐ যে মাতবর
বাড়ীর মেজ ছেলে গতবার বিয়ে
করলো ঐ মেয়েটার খবর কিন্তু আমিই
দিছিলাম।‘
আমি
ও আমার মা অবাক
হই। কানা রঞ্জন খ্রিষ্টান
ছেলেমেয়েদের বিয়ে ঠিক করে
দেন বিষয়টি আমাদের অদ্ভুদ মনে হয়। কানা
রঞ্জন বলতে থাকে, ‘মাসি
আমরা ভিক্ষুকরা বাড়ী বাড়ী যাই তো
তাই কোন বাড়ীর মেয়েরা
কেমন আমরা ঠিক বলতে
পারি। মাসি যদি দরকার মনে
করেন তো বইলেন। আমার
জানাশুনা কয়েকটা ভাল মেয়ে আছে।‘
কানা
রঞ্জন চলে যায়। তবে
মা কানা রঞ্জনের কথাগুলো
গুরুত্বের সঙ্গেই নেন। বাবার সঙ্গে বসে
আলাপ করেন। এখানে সেখানে
মেয়ে দেখে তো কম
টাকা পয়সা নষ্ট হলো
না। তাই কানা রঞ্জনের কথা
মতো যদি সত্যি ভাল
মেয়ের খোঁজ পাওয়া যায় তবে মন্দ
কি।
মা পরের বুধবারের জন্য অপেক্ষা
করে থাকে্ন। কানা রঞ্জন ভিক্ষা
করতে আসেন। তবে মা খুব একটা তাগিদ
দেখান না। কথাটা কানা
রঞ্জনের তরফ থেকেই শুরু
হয়।
‘মাসি
কিছু চিন্তা ভাবনা করলেন নাকি?’
‘কিসের
কথা কও?’
‘ঐ যে ছেলের জন্য
মেয়ের কথা বলছিলাম যে’
‘ওওও
তা মেয়ে তো দরকার।
কোথায় পাওয়া যাবে ভাল একটা
মেয়ে?’
‘মাসি
রাইপুরে মাষ্টার বাড়ীতে একটা ভাল মেয়ে
আছে। আর আছে একটা
বেলানগরের কাজী বাড়ীতে। কাজীবাড়ীর মেয়েটার গায়ের রঙ ধবধবে সাদা
না তবে মেয়েটা একেবারে
লক্ষী।‘
আমি
হেসে বলি, ‘মেয়ে যে লক্ষী
তুমি জানলে কিভাবে? তোমাকে বেশী বেশী ভিক্ষা
দেয় বুঝি। আর মেয়ে সাদা
না কালা তাও তুমি
জান?’
কানা
রঞ্জন আমার কথায় হাসে।
‘হ দিদি আমারে ভিক্ষা
দেয়। তোমার মতোই আমার বাঁশির শব্দ
শুনলে দৌড়াইয়া আসে। এই মেয়ে
দেখার জন্য তোমাগো গ্রামের
একজন গেছিল। ছেলের বাড়ীর সবাই নাকী ধবধবে
সাদা তাই ঐ মেয়ে
তারা পছন্দ করে নাই। তাগো নাকী সাদা
বউ দরকার। দিদি তোমাগো কি
খুব সাদা বউ দরকার?’
আমার
মা বলেন, ‘না না এত
সাদা দরকার নাই। মেয়ের স্বভাব
চরিত্র আর চেহারা কাটিং ভাল
হলেই হবে।‘
‘হ মাসি তাইলে এই মেয়ে দেখতে পারেন।‘
কানা রঞ্জনের কথামতো মা পরের সপ্তাহে রানীমাসিকে নিয়ে রাইপুর আর বেলা নগরে যায়। মেয়ে দেখে আসে। বেলা নগরের শ্যামলা মেয়েকে মায়ের পছন্দ হয়। গায়ের রং শ্যামলা হলেও মেয়েটি দেখতে খুবই মিষ্টি। একদিন ধুমধাম করে বড় দাদার বিয়ে হয়ে গেল শ্যামলা বর্ণের মেয়ে লতার সঙ্গে। কানা রঞ্জনের কথা একদম ঠিক। খুবই লক্ষী মেয়ে লতা। তবে বিয়ের সময় ঘনিয়ে এলে আমরা কানা রঞ্জনের কথা একদম ভুলে গেলাম। বিয়ে হলো শুক্রবার। বুধবার কানা রঞ্জন এলো ভিক্ষা করতে। এসেই সে তার বাঁশিতে ফুঁ দিল। বাড়ীতে উচ্চশব্দে গান বাজছে। এর মধ্যে কানা রঞ্জনের বাঁশির সুর আমাদের কারো কানে পৌছালো না। বিয়ে উপলক্ষে বাড়ীতে দুইজন কাজের মহিলা রাখা হয়েছিল। তাদের একজন কানা রঞ্জনকে দেখে বললো, ‘চোখে দেখনা ঠিক আছে, কানে তো শুন যে বাড়ীতে বিয়ার ধুম লাগছে। এই ধুমের মধ্যে তোমারে ভিক্ষা দিব কে? যাও যাও মাপ করো। বাড়ীর মানুষ ব্যস্ত আছে।‘
কানা রঞ্জন কথা বাড়ান না। চলে যান। পরের সপ্তায় কানা রঞ্জন আসেন। সেদিন বাড়ীতে তেমন কোন ঝামেলা নেই। কানা রঞ্জনের বাঁশি শুনেই আমি মাকে বলি, ‘মা ওনাকে তো বিয়ের সময় বলাই হয় নি।‘
‘উনি
ভিক্ষুক মানুষ, চোখে দেখে না।
সবচেয়ে বড় কথা উনি
তো আমাদের কোন আত্মীয়-স্বজন না। ওনাকে বিয়ের
সময় বলার দরকার কি?’
আমি
কথা বাড়াই না। ভিক্ষা দেই।
কানা রঞ্জন ভিক্ষা নিয়ে পিপ পিপ
পিপ বাঁশি বাজিয়ে চলে যান।
আমরা তিন ভাই বোন। বড় দুই দাদা পিঠাপিঠি আর আমি দাদাদের অনেক পরে হয়েছি। বড় দাদার বিয়ের বছর খানেক পরে কোন একদিন কানা রঞ্জন ভিক্ষা করতে এলে মা-ই কথা পাড়েন,
‘রঞ্জন
ছোট ছেলেরও তো বিয়ে করানোর
সময় হলো। তোমার জানাশুনা
কোন মেয়ে আছে না কি?’
কানা
রঞ্জন উৎসাহিত হন। বলেন, ‘মাসি
আছে কয়েকটা মেয়ে। তো বড় বউ
কেমন হইলো বললেন না তো কিছু।‘
‘বড়
বউ ভালই। এইবার আরেকটা ভাল মেয়ের সন্ধান
দিতে হবে কিন্তু।‘
আবার
কানা রঞ্জন আরেকটা মেয়ের সন্ধান দেন। এবারও মা
আর রানীমাসি মিলে মেয়ে দেখে আসে।
মেয়ে পছন্দ হয় এবং নির্দিষ্ট
সময় বিয়েও হয়ে যায়। এবারও
বিয়েতে কানা রঞ্জনকে দাওয়াত দেওয়া হয় না। কারণ
কানা রঞ্জন আমাদের কোন আত্মীয় নন। তবে
এবার বিয়ের পর কানা রঞ্জনকে
একটা নতুন লুঙ্গি দেওয়া
হয়। লুঙ্গি পেয়ে কানা রঞ্জন যারপরনাই খুশি হন।
আমার
দাদারা ভাগ্য নিয়ে জন্মেছিলেন বলতে
হবে। নয় তো এমন
লক্ষী বউ তো আর
সবার কপালে জুটে না। মায়েও
ভাগ্য সুপ্রসন্ন যাকে বলে বউমা
ভাগ্য। ছেলের বউরা একেবারে মায়ের মতো শুশুড়িকে দেখাশুনা
করে।
আমি যখন অষ্টম শ্রেনীতে পড়ি তখন আমাকে মিশনারী স্কুলে দেওয়া হলো। এজন্য আমাকে গোল্লা গ্রামে সিষ্টারদের দ্বারা পরিচালিত এক হোষ্টেলে থাকতো হতো। আমাদের হোষ্টেল থেকে স্কুলের দূরত্ব ছিল প্রায় এক কিলোমিটার। আমরা হোষ্টেলের মেয়েরা দল বেঁধে এক সাথে স্কুলে যেতাম গ্রামের মেঠো পথ ধরে। বাড়ীতে সবার ছোট এবং একমাত্র মেয়ে হওয়ায় খুব আদরের ছিলাম। হোষ্টেলে আসার পর বাড়ীর কথা খুব মনে পরতো। ভাবতাম মা কেমন আছেন, বাবা, দাদা, বউদিরা কে কেমন আছেন কে জানে? এখানে বসে যদি তাদের কোন খবর পেতাম তাহলে কি মজাই না হতো। আশেপাশে পরিচিত কেউ নেই। কষ্টে বুক ফেটে যেতে চাইতো।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে সুনিলের দোকানের কাছে দেখি কানা রঞ্জন বসে বসে মুড়ি খাচ্ছেন। জানি না কেন, কানা রঞ্জনকে দেখে যে কি ভাল লেগেছিল। মনে হয়েছিল খুব কাছের খুব আপন কারো সাথে যেন আমার দেখা হলো। স্কুলে যাওয়া আসার পথে কারো সাথে কথা বলা আমাদের নিষেধ ছিল। কিন্তু কানা রঞ্জনকে দেখে বিধি নিষেধ ভেঙ্গে আমি তার সামনে হাজির হলাম।
‘বলতো
আমি কে?’
‘তুমি
তো শিউলী। কি ঠিক না?’
‘একদম
ঠিক। কিভাবে বুঝলে যে আমি শিউলী।‘
‘তোমার
কন্ঠ শুনে।‘
কানা
রঞ্জনের কথায় আমার আনন্দ
আর তার প্রতি আমার
আগ্রহ আরো বেড়ে যায়।
এই দূর প্রবাসে কানা রঞ্জনকে আমার
খুব কাছের একজন বলে মনে
হয়।
‘তা
তুমি এখানে কেন? বেড়াতে আসছ
নাকী?’
‘না
আমি এখানকার স্কুলে ভর্তি হয়েছি। হোষ্টেলে থাকি।‘
আমার
সাথে আমার এক বান্ধবী
ছিল শিলা। শিলা আমাকে জিগ্যেস
করলো, ‘লোকটি কে? তোর কি হয়
রে?’
শিলার প্রশ্নে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। তাই তো উনি তো একজন ভিক্ষুক। আমার আবার কে হবেন? শিলাকে আমি কি বলবো তাই ভাবছিলাম। আমাকে যেন কানা রঞ্জনই রক্ষা করলেন। বললেন, ‘দিদি আমি রঞ্জন। আমি ভিক্ষুক। ভিক্ষা করি। দিদির গ্রামে ভিক্ষা করতে যাই তো তাই দিদিরে চিনি।‘
কানা রঞ্জনের পরিচয় শুনে বা কি কারণে শিলা তাগাদা দেয়, ‘চল চল দেরি হয়ে যাবে। সবাই
চলে গেছে। আমাদের দেরী দেখলে সিষ্টার বকবে।‘
কিন্তু
আমার ইচ্ছে করে কানা রঞ্জনের
সাথে আর একটু কথা
বলতে। হয় তো কানা
রঞ্জন বুঝতে পারে। বলে, ‘দিদি আজ তো
বিসুতবার, আগামী বুধবারে আবার তোমাদের গ্রামে যামু। তোমার কোন খবর আছে
নাকি? কিছু বলতে হইবো
তোমার বাড়ীতে?’
আনন্দে আমার চোখে জল এসে পড়ে। এমন কিছুই তো আমি চাইছিলাম। বাড়ীর একটা খবর, বাড়ীতে একটা খবর। আমি বললাম, ‘ সবাইকে বলো আমি ভাল আছি। আমার জন্য যেন চিন্তা না করে।‘
‘দিদি আমি এই গ্রামে প্রতি বিসুতবারদিন আসি। তুমি যাও তাইলে। তোমার মাকে আমি খবরটা পৌঁছে দিব।‘ বলেই সে তার বাঁশিতে ফুঁ দেয়। পিপ পিপ পিপ …
আমি পরের বৃহস্পতিবারের অপেক্ষায় থাকি। কখন ছুটি হবে।
কখন আবার দেখা হবে
কানা রঞ্জনের সাথে। সত্যিই স্কুল ছুটির পর হোস্টেলে ফেরার পথে আবারও কানা রঞ্জনের সাথে দেখা
হয়ে যায় সুনিলের দোকানের
সামনে। দুপুর দেড়টা বাজে। এই ভর দূপুরে
সবার ভাত খাওয়ার কথা কিন্তু কানা
রঞ্জন এ সময় মুড়ি
খায়। আমি কাছে গিয়ে
বলি, ‘বল তো আমি কে?’
‘তুমি
শিউলী দিদি। কেমন আছ দিদি?’
‘আমি ভাল আছি। তুমি কেমন আছ?’
‘ভাল আছি। দিদি তোমার মা তোমার জন্য কুড়িটা টাকা পাঠাইছে।‘ বলেই সে তার লুঙ্গির কোচ থেকে কয়েকটি নোটের মধ্যে থেকে ঠিক কুড়ি টাকার একটা নোট বের করে দেয়। আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই। টাকার নোটে আমি আমার মায়ের গন্ধ পাই। কানা রঞ্জনের দিকে তাকালে আমি আমার বাড়ীর উঠোন, গাছপালা দেখতে পাই যেন কানা রঞ্জন আমাদের উঠোনেই দাঁড়িয়ে আছে। কানা রঞ্জন একে একে বাড়ীর কে কেমন আছে, কে আমার সম্পর্কে কি জিগ্যেস করেছে সবই বলতে থাকে। কানা রঞ্জন থামলে আমি পরের টুকু শোনার জন্য বিচলিত হই। শেষে কানা রঞ্জন আমার হাতে দুটো লজেন্স দিয়ে বললেন, ‘দিদি এই ধরো এইটা তোমার জন্য। দোকান থেকে মুড়ি কিনলাম তো তোমার কথা মনে পড়লো। তাই তোমার জন্য কিনলাম।‘ আমার চোখে আবার জল চলে আসে। আমি কানা রঞ্জনকে ধন্যবাদ দিয়ে হোষ্টেলে চলে যাই।
এভাবেই
চলতে থাকে প্রতি সপ্তাহে
কানা রঞ্জনের সাথে আমার সাক্ষাৎ।
মা বাড়ী থেকে এটা সেটা পাঠাতেন
আর আমি পাঠাতাম আমার
খবর। কোন কারণে কোন
সপ্তাহে কানা রঞ্জনকে না দেখলে আমি
বিচলিত হতাম। তখন আমার গ্রাম থেকে গোল্লা যাওয়ার একমাত্র বাহন ছিল লঞ্চ।
ঘন্টা দেড় দুই সময়
লাগতো। আমাদের বাড়ী থেকে প্রায়
এক কিলোমিটার হেঁটে লঞ্চঘাট আবার গোল্লা লঞ্চঘাট থেকে
আমাদের হোষ্টেল আরো এক কিলোমিটার।
বর্ষার সময় অবস্থা হতো ভিষণ করুণ। একদিন কানা রঞ্জন বললেন,
‘দিদি শুনলাম সরকার রাস্তা নাকি পাকা করবো। লঞ্চ
নাকি আর চলবো না।
গাড়ী চলবো।‘
‘তাই
নাকি? তাহলে তো খুবই ভাল
হবে।‘
‘হ দিদি। তোমাগো জন্য সুবিধা হইব তবে আমার
খুব অসুবিধা হইবো দিদি। আমার
এই লঞ্চে চইড়া অভ্যাস তো।
লঞ্চে ঝামেলা কম। লঞ্চের সবাই
আমারে চিনে আর ভিক্ষা করতে
করতে যাই। আলাদা একটা সুবিধা
ছিল। গাড়ীতে উঠবার পারি না। বমি
আসে। লঞ্চ বন্ধ হইলে
আমার যাতায়াতে খুব মসকিল হইবো।
কি জানি তোমাগো সাথে
আর দেখা হইবো কি
না।‘
কানা রঞ্জনের
অসুবিধার কথা শুনে আমার
খুব কষ্ট হয়। ছোট্ট
মনটা হাহাকার করে উঠে সত্যিই কি কানা রঞ্জনের
সাথে আমার আর দেখা
হবে না?
হোষ্টেলের
মেয়েদের সাথে অভিভাবকদের দেখা
করার নিয়ম ছিল মাসের
প্রথম শুক্রবার। একবার কোন এক আত্মীয়ের
বিয়ে বা কোন বিশেষ
অনুষ্ঠানের কারণে আমার মা আমার সাথে দেখা
করতে আসতে পারলেন না।
আগের দিন বৃহস্পতিবার কানা
রঞ্জন আমাকে খবরটা দিলেন। খবরের সাথে মায়ের দেওয়া
আধা কেজি মুড়ি, আধা
কেজি চানাচুরের প্যাকেট, এক কেজি বিস্কেট,
একটা সাবান আর পঞ্চাশ
টাকা। অর্থাৎ আমার সাথে দেখা করতে এসে
মা যা যা আনতেন
সবই তিনি পাঠিয়েছেন কানা
রঞ্জনের মাধ্যমে। সাথে একটা চিঠি। কানা রঞ্জন বুধবার
গ্রামে গেলে আমার মা এসব
কিছু তার মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন।
আর কানা রঞ্জন এই
বড় ব্যাগখানা বয়ে বয়ে সারাগ্রাম
ভিক্ষা করে দুপুরে আমার হাতে দিয়েছেন।
আমার খুব খারাপ লাগছিল
কারণ ব্যাগটা বইতে নিশ্চয়ই কানা রঞ্জনের কষ্ট
হচ্ছিল। তবে আমি মুখে
কিছু বললাম না। ধন্যবাদ দিয়ে
চলে আসার সময় আবারও তিনি
আমায় পিছু ডেকে দুটি
লজেন্স দিলেন। এরপর বাঁশিতে ফুঁ দিলেন পিপ পিপ পিপ……………।
ঢাকা
হোষ্টেলেও থাকলাম প্রায় সাড়ে ছয় বছর।
এই ছয় বছরে আমি কানা রঞ্জনকে
প্রায় ভুলেই গেলাম। লেখাপড়া, পরীক্ষা, ভবিষ্যত গড়া স্বপ্ন সব
কিছু মিলিয়ে জীবনে অনেক পরিবর্তন হলো। সেই
সাথে আমাদের গ্রামেরও অনেক উন্নয়ন হলো। এখন আর ইছামতি
নদীতে লঞ্চ চলে না।
আগের মতো লঞ্চে করে
ছয় সাত ঘন্টা ঝিমুতে ঝিমুতে ঢাকা যেতে হয়
না। পাকা পিচঢালা রাস্তায়
ঢাকা টু বান্দুরা বাস চলে।
ঢাকার লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে আমি তখন গ্রামে। হঠাৎ একদিন আমার কানা রঞ্জনের কথা মনে পড়ে। মাকে জিজ্ঞেস করতে মা জানালেন কানা রঞ্জন নাকী আর আমাদের গ্রামে ভিক্ষা করতে আসে না। আমার মনে পড়ে কানা রঞ্জন বলেছিলেন, সে বাসে চড়তে পারে। তার মানে লঞ্চ না চলায় কানা রঞ্জনের সত্যিই খুব অসুবিধা হয়েছে। তাহলে কানা রঞ্জন এখন অনেক গ্রামেই যেতে পারে না নিশ্চয়। আশেপাশের গ্রামেই যায়। আরো একটা প্রশ্ন আমার মনে উদয় হয় আচ্ছা কানা রঞ্জনের বাড়ী কোথায়? কানা রঞ্জনের কাছ থেকে কোন এক সময় আমি আমার পরিবার কত উপকার পেয়েছি। প্রায় সাড়ে তিনটা বছর সপ্তায় সপ্তায় তার কাছ থেকে আমি আমার বাড়ীর খবর নিয়েছি অথচ লোকটার বাড়ী কোথায় কখনো জিগ্যেস করা হয় নি। লোকটা এখন কেমন আছে কোথায় আছে কে জানে?
এরই
মধ্যে মায়ের ডায়বেটিস ধরা পড়েছে। দাদারা
মাকে ঢাকা নিয়ে গিয়ে
ভাল ডাক্তার দেখিয়ে এনেছে। এখন মাকে নিয়ে
আর ঢাকা দৌড়োতে হয়
না। মা নাকী নবাবগঞ্জেই
ডাক্তার দেখান। নবাবগঞ্জ উপজেলা আর সেই আগের
মতো নেই। যেন বড়
একটা শহর। রাস্তাঘাটের পাশাপাশি ব্যবসা বানিজ্যের প্রসার ঘটেছে। সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো
উন্নয়ন ঘটেছে চিকিৎসা খাতে। বাগমারা থেকে নবাবগঞ্জ পর্যন্ত
সুউচ্চ মনোরম ক্লিনিক
আর ডায়নোষ্টিক সেন্টার। এসব প্রাইভেট চিকৎসা
প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশে নবাবগঞ্জ মেডিকেল হাসপাতালটি বড়ই করুণ হতশ্রী।
তবুও দরিদ্রের শেষ আশ্রয়স্থল।
একদিন
আমি মায়ের সাথে গেলাম একটা
মনোরম ডায়নোষ্টিক সেন্টারে। ডাক্তার অনেকগুলো টেষ্ট দিলেন। এগুলো পরীক্ষা করিয়ে আবার রিপোর্ট দেখিয়ে
যেতে বললেন। টেষ্ট করানো শেষ রিপোর্টের জন্য বসে
আছি। হঠাৎ দেখি কানা রঞ্জন পাশেই এক
ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনছেন।
তাকে দেখে আমি নিজের
অজান্তেই ফিরে গেলাম আমার সেই
ছোট্ট বেলায়। মনে হলো দৌড়ে
গিয়ে তাকে বলি, বলতো
আমি কে? এখন নিশ্চয় তিনি
আমাকে চিনবেন না। মনে কৌতুহল
হলো। আমি এগিয়ে গেলাম।
দোকানে অনেক মানুষ। কানা রঞ্জন ওষুধ
কিনে সবে দোকান থেকে বের হবে
এমন সময় আমি বললাম,
‘বলতো
আমি কে?’
আমাকে
অবাক করে দিয়ে বললেন,
‘তুমি শিউলী দিদি, তাই না?’
‘এত
বছর পর তুমি আমায়
কিভাবে চিললে?’
আমার
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি
বললেন, ‘দিদি তোমার মা
কেমন আছে? দাদা-বৌদিরা?’
‘সবাই
ভাল আছে।‘
‘লঞ্চ
চলে না তো তাই
আর তোমাদের গ্রামে যাওয়া হয় না। বাসে
উঠবার পারিনা। অনেক কষ্ট করে এখানে আসছি
রিক্সায় করে। তা দিদি
তুমি এখানে কি কর?’
‘আমার
মায়ের ডায়বেটিস হয়েছে তাই ডাক্তার দেখাতে
এসেছি।‘
‘দিদি ডায়বেটিসটা এখন সবারই তাই
না! এই আমারও ডায়বেটিস
হইছে। মেডিকেলে গেছিলাম। এই এতগুলি ওষুধ
দিছে। দিদির কি ডাক্তার দেখানো
শেষ?’
‘হ্যাঁ কয়েকটা
পরীক্ষা করতে দিয়েছে তাই
রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি।‘
‘আমারেও
দিছে পরীক্ষা করতে তয় আজ
করবো না।‘
আমার
হঠাৎ মনে হলো হয় তো কানা রঞ্জনের কাছে যথেষ্ট টাকা
পয়সা নেই। তাই পরীক্ষা
করাবেন না। খুব কষ্ট হলো
কানা রঞ্জনের জন্য। ঠিক তখন মা
দূর থেকে ডাকতে লাগলো শিউলী
শিউলী বলে। কানা রঞ্জন
বললেন, ‘দিদি তোমারে ডাকতেছে
যাও। আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক।‘ আমি চলে আসার
জন্য পা বাড়াতেই কানা
রঞ্জন বললেন, ‘দিদি বাঁশি শুনবা না?
আমি
উত্তর দেওয়ার আগেই কানা রঞ্জন
বাঁশিতে ফুঁ দিলেন পিপ পিপ পিপ………।
আশেপাশের
সবাই আমাদের দিকে অদ্ভুদ কৌতুহল
নিয়ে তাকিয়ে রইলো।
মায়ের রিপোর্টগুলো হাতে পেয়ে ডাক্তারকে দেখালাম। রিপোর্ট ভাল তেমন কোন সমস্যা নেই। ডাক্তার একই ওষুধ লিখে দিয়ে তিনমাস পর দেখা করতে বললেন। রিক্সার জন্য রাস্তায় দাঁড়াতেই দেখি পাশে বড় একটা জটলা, শোরগোল। একজনকে জিগ্যেস করলাম,
‘ভাই
কি হয়েছে এত জটলা কেন?’
‘একজন
লোক বাসের চাপায় মারা গেছে’
পাশের
আরেজন বললেন, ‘যে লোকটা মারা
গেছে সে অন্ধ ছিল।
বাস আসতেছে দেখে নাই।‘
হঠাৎ
আমার বুকটা মোচর দিয়ে উঠলো।
কানা রঞ্জন নয় তো!
আমি
মাকে বললাম, ‘মা মনে হয়
কানা রঞ্জন। আমি গিয়ে দেখে
আসি।‘
‘ঝামেলায় যেতে
হবে না’
আমি
মায়ের কথা উপেক্ষা করে
সামনে এগিয়ে গেলাম। মাও এলেন আমার
পেছনে পেছনে। ভীর ঠেলে সামনে গিয়ে দেখি কানা
রঞ্জনের নির্জীব দেহটি রাস্তায় পড়ে আছে। মাথা
থেকে রক্তের স্রোত রাস্তায় নেমে গেছে। কি
বিভৎস সেই দৃশ্য। আমার
মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো। আচমকা
মা আমার হাত টান
দিয়ে বললেন, ‘চল বাড়ী চল।‘
সবাই
যখন বলাবলি করছে কে এই
লোক? এনার বাড়ী কই?
কেও বলছে, এনার সাথে আর
কি কেউ নাই? কেউ বলছে
উনাকে হাসপাতালে নিতে হবে। কেউ
বলছে পুলিশে খবর দিতে হবে।
ঠিক তখনই পাশের
একজন আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এই মেয়েটাই তো উনার
সাথে কথা বলছিল। মেয়েটির
কি হয় উনি?’
আরেকজন জিজ্ঞেস
করলেন, ‘লোকটিকে
আপনি চিনেন? লোকটি আপনার কি হয় আপা?’
আমি
কি বলবো কিছুই বুঝতে
পারছি না। আমার প্রচন্ড
মাথা ব্যাথা করছিল।
মা বললেন, ‘উনি আমাদের কেউ
হন না।‘
‘আমি
তো এই আপার সাথে
লোকটিকে কথা বলতে দেখেছি।‘
মা গলার স্বর উচ্চু
করে বললেন, ‘কথা বললেই কি
আত্মীয় হয় নাকি? লোকটি
জিজ্ঞেস করছিলেন রক্ত পরীক্ষা কোথায়
করা যায়?’
আমি
মায়ের মুখের দিকে হা করে
তাকিয়ে রইলাম। মা আমার আমাকে
টানতে টানতে রিক্সায় উঠালেন। একা একাই বলতে
লাগলেন, ‘মরবি তো মর
দূরে গিয়ে মর, তা
না একেবারে আমাদের সামনে এসে!’
আরও গল্প পড়তে ক্লিক করুন
No comments