Header Ads

সুন্দরী উপন্যাস


সুন্দরী




রিপার জ্যাঠাতো বোনের বিয়ে। রিপা তার কলেজের সব ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের দাওয়াত দিয়েছে। ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর সংখ্যা চারজন। তিনজন রিপার সঙ্গে একই হোস্টেলে থাকে আর জয়িতা থাকে ধানমণ্ডিতে নিজেদের বাড়িতে। হোস্টেলে থাকার কারণে বিয়েতে যেতে তিন বান্ধবীর কোন সমস্যা নেই। সমস্যা শুধু জয়িতাকে নিয়ে। তবে জয়িতা রিপাকে আশ্বাস দিয়েছে, তার এই সতের বছরের জীবনে চেয়ে পায় নি এমন কোন জিনিস নেই। তার বাবা-মা তাকে এত ভালবাসেন যে কোন কিছুতেই তাকে না বলতে পারেন না। বিয়েতে তার বাবা অবশ্যই যেতে দিবেন। তাই জয়িতা আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, 'তোরা ভাবিস না, আমি যথা সময়ে তোদের সাথে বিয়েতে যাচ্ছি।' 

চারতলা বাড়ির চতুর্থ তলায় জয়িতারা থাকে। বাবা-মা আর দুই ভাই নিয়ে জয়িতাদের সুখের সংসার। জয়িতার বাবা সংকর গমেজ জয়িতাকে খুব ভালবাসেন। আর জয়িতার সারা জগৎই যেন বাবাকে ঘিরে। সংকর গমেজ ঢাকা শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। বাপদাদার কোন অবদান নেই তার এই প্রতিষ্ঠার পেছনে। সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় তিনি এই অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন। ছেলেমেয়েদেরও তিনি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য উৎসাহিত করেন। জয়িতার মা সুমিতা একজন গৃহিণী। সংকর গমেজের জীবনের সকল সফলতার একমাত্র প্রেরণা যাকে বলে যোগ্য সহধর্মিণী। 

জয়িতা হলিক্রস কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ভাইদের মধ্যে একজন ক্লাস এইটে আর অন্যজন সিক্সে পড়ে। তিন ভাইবোনের মধ্যে জয়িতা সবচেয়ে বেশি চঞ্চল। বলতে গেলে এই বাড়ির প্রানই হচ্ছে জয়িতা। 

রাতে খাবার টেবিলে রিপার বোনের বিয়ের কথাটা তুলতেই সবাই কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। দুই ভাই বলল, 'দিদি আমাদের নিবে না?'

মা বললেন, 'না চারদিনের জন্য কোথাও যাওয়া চলবে না। একদিনের ছুটি আমি না হয় মঞ্জুর করতে পারব কিন্তু চারদিনের জন্য হবে না।' বলেই সুমিতা স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'তুমি কি বল?'

জয়িতা বাবার দিকে চেয়ে অনুনয়ের স্বরে বলল, 'বাবা!'

জয়িতার বাবা একটু গম্ভীর প্রকৃতির। সারাদিন ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও স্ত্রী-সন্তাদের ব্যপারে তিনি খুবই সচেতন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, 'তা যাচ্ছ কোথায় সেটা তো বলবে? ধারেকাছে হলে না হয় ভেবে দেখা যাবে।' বলেই তিনি মুচকি হাসতে লাগলেন। বাবার হাসি দেখে জয়িতা মনে মনে নিশ্চিন্ত হল সবাই মুখে যাই বলুক না কেন তাকে যেতে দিবে। জয়িতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলল, 'বাবা শশীপুর।' 

'শশীপুর?' আচমকাই যেন সংকর গমেজের ঠোঁটদুটি নড়ে উঠল। শশীপুর শব্দটা শোনামাত্র সংকর গমেজের হাসিটা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। চেহারায় রাজ্যের বিস্ময় একে বললেন, 'কোন শশীপুর?'

'ঢাকার একদম কাছে নবাবগঞ্জের শশীপুর। বেশি দূরে নয় মাত্র দুই ঘণ্টার রাস্তা। বাবা যেতে দিবে তো  বল না বাবা?' 

নবাবগঞ্জের শশীপুর শোনার পর আর কোন কথা জয়িতার বাবার কানে পৌছালোনা। তিনি গভীর দুশ্চিন্তা নিয়ে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে নিজের ঘরে গেলেন। জয়িতার মা থালাবাসন গুছাতে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি স্বামীর এই পরিবর্তন খেয়াল করলেন না তবে বিষয়টি জয়িতার নজর এড়ালনা। সে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, 'মা তুমি বললে বাবা নিশ্চয় যেতে দিবে। একবার বলে দেখ না।'

'আচ্ছা বলব। তবে তোকে ছাড়া চারদিন থাকতে আমারও কিন্তু খুব কষ্ট হবে।' 

'মা এখনই কিন্তু বলবে'

'ঠিক আছে বলবো' বলে তিনি শোবার ঘরে চলে গেলেন।  

সুমিতা শোবার ঘরে গিয়ে দেখে জয়িতার বাবা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। সুমিতা বললেন, 'মেয়েকে কিছু না বলে চলে এলে যে?'

'জয়িতাকে বল এতদুর যেতে হবে না। '

'সমস্যাটা কি শুধু দূরত্বের জন্য?'

জয়িতার বাবা কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে কি যেন ভাবতে লাগলেন। স্বামীর কোন উত্তর না পেয়ে সুমিতা আবার বললেন, 'মাত্র দুই ঘণ্টার পথ। ওর সব বান্ধবীরা যাচ্ছে। ও যেতে না পারলে খুব কষ্ট পাবে। মেয়ে কিন্তু তোমার অনুমতির অপেক্ষায় আছে। কি বল? আমি কি ওকে যেতে বলব?' 

'না' সংকর গমেজ এমন কঠিন স্বরে না শব্দটি উচ্চারণ করলেন যে সুমিতা অবাক হয়ে স্বামীর দিকে চেয়ে রইলেন। সংকর গমেজ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আরও কঠিন স্বরে বললেন, 'পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে আমি আমার মেয়েকে যেতে দিব, শুধুমাত্র শশীপুর ছাড়া।'  

'মেয়ে নিশ্চয়ই কারণটা জানতে চাইবে'

'এ ব্যপারে আমি আর একটি কথাও বলতে চাইছি না সুমিতা।' 

সুমিতা কিছুক্ষন বসে থেকে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। এদিকে জয়িতা মায়ের পেছনে পেছনে গিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ভেতরের সব কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল। মা ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই সে নিজের ঘরে চলে গেল। 

জয়িতার কানে শুধু একটি কথাই প্রতিধ্বনি হতে লাগল, 'আমি আমার মেয়েকে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে যেতে দিব শুধুমাত্র শশীপুর ছাড়া।' 

কিন্তু কেন? কেন বাবা তাকে শশীপুর যেতে দিতে চাইছেন না? কি আছে সেখানে? বাবা কি এর আগে কখনো শশীপুর গিয়েছে? জয়িতার মনে নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল। 

সুমিতা জয়িতার ঘরে গিয়ে দেখে জয়িতা পড়ার টেবিলে বসে মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। মেয়ের মাথায় হাত রেখে সুমিতা বললেন, 'চারদিন তোকে ছাড়া তোর বাবা থাকতে পারবে না।' 

'মা বিষয়টা কি শুধুই চারদিনের না কি অন্য কিছু?'

সুমিতা হকচকিয়ে বললেন, 'অন্য কিছু আবার কি হবে?' বলেই তিনি মেয়ের গুছানো ঘর গুছাতে শুরু করলেন। জয়িতা চেয়ার থেকে উঠে মায়ের হাত দুটি ধরে বলল, 'মা তুমি কি সত্যি কিছু জান না কেন বাবা আমাকে শশীপুর যেতে দিতে চায় না?'

সুমিতা হাসির চেষ্টা করে বললেন, 'আমি আবার কি জানব? ' 

'ঠিক আছে বাবা যখন চাইছে না আমি  শশীপুর যাব না'

'তোর কি খুব খারাপ লাগছে?'

'একটু লাগছে, তবে...।

'তবে কি?' 

জয়িতা কিছু না বলে রিপাকে ফোন দিল, 'হ্যালো রিপা শুক্রবার বাবা বাড়িতে একটা বিরাট পার্টির আয়জন করেছে। সারপ্রাইস পার্টি। ছোট ভাইয়ের জন্মদিন। কাউকেই এখনও কিছু জানানো হয়নি। বাবা বলেছে দুটো অনুষ্ঠানই গুরুত্বপূর্ণ। আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমি কোনটাতে  যাব? আমি ভাবছি ছোট ভাইটার জন্মদিন আর আমি না থাকলে ও খুব কষ্ট পাবে রে। সো..............বুঝতেই পারছিস। রাগ করিস না। প্লিজ রি......।'

মেয়ের কথা শুনে সুমিতা অবাক হয়ে গেল। জয়িতা অনেক বড় হয়ে গেছে। কি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা সে তার বাবাকে ছোট করতে  চাইছে না। সন্তানের কাছে এর চেয়ে বেশি তো বাবা মা কিছু আশা করে না। সুমিতা মনে মনে খুশি হলেন তাহলে মা হিসেবে তিনি জয়িতাকে সুশিক্ষা দিতে পেরেছেন। 

জয়িতা ফোন রেখে মাকে জরিয়ে ধরে বলল, 'নো প্রব্লেম মা, রিপাকে ম্যানেজ করা গেছে।' 

সুমিতা মেয়ের মাথায় হাত রেখে মুচকি হাসলেন। এরপর ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। জয়িতা লক্ষ করল মা যেন আঁচলে চোখ মুছলেন। 

জয়িতার সারারাত ঘুম হল না। শশীপুর শব্দটা জয়িতার বুকে পাথরের মত চেপে রইল কিন্তু মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই যে জয়িতা কোনকিছু নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত। 

নিষেধের বেড়াজাল ছিন্ন করার ধর্মই যেন এই বসয়ের। শশীপুর যাওয়ার জন্য জয়িতা মরিয়া হয়ে উঠল। মনে মনে পরিকল্পনা করতে লাগল কিভাবে যাওয়া যায় শশীপুর।  



বিয়ে বাড়িতে মহা ধুমধাম করে চারদিন পর রিপা তার বান্ধবীদের নিয়ে ঢাকায় ফিরে এল। পরেরদিন কলেজে জয়িতার সাথে বান্ধবীদের দেখা হলে তারা বিয়েবাড়ির গল্পে মেতে রইল। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু সময় পেল মোবাইলে ছবি দেখল, কোন ছবিতে কাকে কেমন দেখাচ্ছে, কেমন হলে আর একটু ভাল হত এসব নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা চলল। জয়িতার কোন গ্রামের বাড়ি নেই, গ্রামে গিয়ে তার কখনো থাকা হয়নি। ছুটিছাটা হলে সংকর গমেজ তার পুরো পরিবার নিয়ে চলে যান দেশের বিভিন্ন পর্যটন এলাকায়। বেশ কয়েকবার তারা দেশের বাইরেও বেড়াতে গিয়েছে। একবার থাইল্যান্ড, একবার নেপাল আর ভারত যাওয়া হয়েছে কয়েকবার। 

জয়িতা শশীপুর সম্পর্কে রিপাকে নানান প্রশ্ন করতে লাগল তবে সে যা জানতে চায় তেমন কোন ক্লু পেল না। আসলে জয়িতা কি জানতে চায় তা তার নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়। শশীপুর ঘিরে জয়িতার আগ্রহ দেখে রিপা বলল, 'তুই তো গেলি না। গেলে গ্রাম আর গ্রামের বিয়েতে যে কি আনন্দ হয় উপভোগ  করতে পারতি। মন খারাপ করিস না তোকে খুব শিগগিরই আমাদের গ্রামে নিয়ে যাব।' জয়িতা রিপার কথায় খুশি হল। সে মুখফুটে যা বলতে পারছিল না রিপা যেন তাই-ই বলে দিল।  

বিকেলে জয়িতা রিপাদের হোস্টেলে গেল। বাইরে ঝুম বৃষ্টি থাকায় রিপা আর তার বান্ধবীরা ঘুমাচ্ছিল। জয়িতা রিপার সাথে দেখা করতে চায় বলে ভেতরে খবর পাঠাল। 

রিপা জয়িতাকে দেখে অবাক, 'এই বৃষ্টির মধ্যে তুই?'

'তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে'

'আয় রুমে আয়'

'না রুমে যাব না। আমি তোর সাথে একা কথা বলতে চাই।'

'কি এমন জরুরি কথা? কলেজে তো কিছুই বললি না।'

'কলেজে তোকে আর একা পেলাম কোথায়?'

'চল তাহলে বারান্দায় গিয়ে বসি।' বলেই রিপা জয়িতার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে বসাল। ছোট একটা  বারান্দা খুবই ছিমছাম। লোহার একটা গোল টেবিল সাথে তিনটা চেয়ার আর রেলিঙে ছোটছোট ফুলের টব ঝুলানো। এমনিতে বারান্দাটা হোস্টেলের মেয়েদের পদচারনায় মুখরিত থাকে আজ বৃষ্টির কারনে সবাই ঘুমাচ্ছে। 

'চা খাবি তো জয়িতা?'

'না কিচ্ছু খাব না তুই বস'

রিপা চেয়ার টেনে জয়িতার সামনে বসল। জয়িতা রিপার হাত দুটো ধরে বলল, 'আমি তোদের বাড়ি যেতে চাই'

'আমাদের বাড়ি? কি ব্যাপার বলত?'

'না মানে লতাদি আমাকে এত স্নেহ করেন। তার বিয়েতে যেতে পারলাম না তাই ভাবলাম হঠাৎ একদিন গিয়ে লতাদিকে সারপ্রাইস দেই। তাছাড়া রাখি সুমি ওদের মুখে তোদের গ্রামের প্রশংসা শুনে আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে। তোদের গ্রামটা ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করছে।'

'ওরা আবার গ্রাম ঘুরে দেখার সময় পেল কই? সারাক্ষনই তো বিয়ে বাড়ি নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তবে জানিস সত্যি ওরা খুব মজা করেছে। আর ওরা ছিল বলে আমাদের অনেক হেল্প হয়েছে। '

জয়িতা গম্ভীর মুখে বলল, 'কবে নিয়ে যাবি আমাকে তোদের গ্রামে সেটা বল?'

'বোস ওদের ডেকে তুলি। একটা প্ল্যান করি, তারপর চল চারজন বেড়িয়ে পড়ি। 

'না ওরা না শুধু তুই আর আমি যাব।'

'ব্যাপারটা কি বলত জয়িতা? তোকে কেমন যেন গোমড়া দেখাচ্ছে। ' 

জয়িতা হাসার চেষ্টা করে বলল, 'কিচ্ছু হয় নি, এবার বল কবে নিয়ে যাবি আমায় তোদের শস্য-শ্যামল-সবুজ গ্রামে? '

রিপা মাথা চুলকে বলল, 'আগামী শুক্রবার?'

'ঠিক আছে তাহলে আজ উঠি, বৃষ্টি আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে।' 

জয়িতা বৃষ্টির মধ্যেই উঠে পড়ল। অন্য সময় বৃষ্টি ভীষণ পছন্দ করে তবে আজ তার কিছুই ভাল লাগছে না। আজ সোমবার শুক্রবার আসতে আরও চারদিন বাকি। সবচেয়ে বড় কথা বাবা-মাকে মিথ্যে বলতে হবে। জয়িতা কখনও মিথ্যে বলে না। তবে কিভাবে জয়িতা বাড়ি থেকে বের হবে সেটাই চিন্তা করতে লাগল। 

হোস্টেল থেকে ফেরার সময় লতাদির জন্য একটা শাড়ি কিনে এনেছে জয়িতা। লাল আর সবুজের মিশ্রনে একটা তাঁতের শাড়ি। নতুন বৌদের নাকি লাল শাড়ি পরলে খুব সুন্দর মানায়। শাড়িটি খুব যত্ন করে প্যাকেট করল সে। এদিকে মা খাবার ঘর থেকে ডাকছে। জয়িতার খিধে নেই। তবুও সে খেতে গেল কারন তার ভেতরে যে কিছু একটা চলছে তা সে কাউকে বুঝতে দিতে চায় না। সে স্বাভাবিকভাবে খাবার টেবিলে গিয়ে বসল। চরম বিরক্তির সাথে বলল, 'দূর আগামি শুক্রবার যেতে হবে রাজেন্দ্রপুর শিক্ষা সফরে।' জয়িতা এমনভাবে বলল যেন তার যেতে একটুও ইচ্ছে নেই।  

সংকর গমেজ বললেন, 'শিক্ষা সফর তো লেখাপড়ারই একটা অংশ মা'

ছোটভাই বলল, 'দিদি তুমি না গতবার রাজেন্দ্রপুর গেলে? এবার ওই একই জায়গায় যাচ্ছ নাকি?'

জয়িতা ঘাবড়ে গেল, সত্যি তো! ইস কেন যে তার মুখ দিয়ে রাজেন্দ্রপুর বের হল? সামলে নিয়ে সে বলল, 'সেই জন্যই তো যেতে ইচ্ছে করছে না। একই জায়গায় বারবার দেখার কি আছে বল তো বাবা?'

জয়িতার বাবা বেশ উৎসাহ পেলেন। বললেন, 'একই জায়গায় তুমি যতবার যাবে, প্রত্যেকবার তুমি সেখানে নতুন কিছু না কিছু আবিষ্কার করবে। ভাববে কই আগেরবার তো ওই জিনিসটা দেখা হয় নি।' বলেই তিনি হা হা করে হাসতে লাগলেন। সংকর গমেজ প্রান খুলে হাসলেন। মেয়ে যে শশীপুরের ব্যপারটা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে এই বিষয়ে তিনি যেন নিশ্চিন্ত। মনে মনে সন্তোষ প্রকাশ করলেন, মেয়ে তার বড়ই লক্ষ্মী একবার না করতেই দ্বিতীয়বার রা করেনি। 

সংকর গমেজ আবার বলতে শুরু করলেন, 'গতবার শিক্ষাসফর থেকে এসে তুমি যে এসাইনমেন্ট করেছিলে এবার দেখবে একই জায়গায় গিয়ে তোমার এসাইনমেন্ট হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যাও মা খুশি মনে যাও' 

জয়িতার মাথা থেকে যেন বড় একটা বোঝা নেমে গেল। সারাদিনের জন্য বাইরে যাওয়ার অনুমতি মেলায় সে খুশি হল তবে মিথ্যে বলায় তার ভেতরটা খচখচ করতে লাগল। জয়িতা ভাবল রাজেন্দ্রপুর বলে ভালই হয়েছে নয়তো ফিরে এসে ভাইদের হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন হয়ে যাবে। 

শুক্রবার খুব ভোরে জয়িতা ঘুম থেকে উঠল। ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ নিয়ে তার রুম থেকে বেড়িয়ে দেখে খাবার টেবিলে বাবা। শুক্রবার বাবা সাধারনত একটু দের করেই ঘুম থেকে উঠেন। আজ বাবাকে টেবিলে দেখে জয়িতা ভড়কে গেল। তার মনে হল বাবা হয় তো সব জেনে ফেলেছে। 

জয়িতা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, 'বাবা আজ এত সকালে উঠেছ যে?'

'যাবার আগে ভাল করে নাস্তা করে যাও।'

ইচ্ছে না থাকলেও জয়িতা টেবিলে বসল। আজ সে কোনরকম ঝামেলা করতে চায় না। যতটুকু সম্ভব সবাইকে মানিয়ে ঘর থেকে বের হতে হবে। বাবা চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন, 'তাড়াতাড়ি খেয়ে নিচে এসো আমি গাড়ি বের করছি।'

জয়িতা ভড়কে গিয়ে বলল, 'তুমি কোথায় যাবে?'

'তোমাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে আসি'

জয়িতার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সে বলল, 'না বাবা আমি রিক্সা নিয়েই যেতে পারব। তাছাড়া আজ তোমার ছুটিরদিন তুমি গিয়ে ঘুমাও বাবা।'

'সেজন্যই যাচ্ছি। আজ ছুটিরদিন এত সকালে রিক্সা পাবে না। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।'

জয়িতা অস্বস্তিতে পড়ল। আজ শুক্রবার কলেজের গেইট বন্ধ থাকবে। বাবা কলেজে গেলেই বুঝে ফেলবেন জয়িতা মিথ্যে বলেছে। তখন কি উত্তর দিবে জয়িতা? কিন্তু উপায় নেই বাবা ইতিমধ্যেই গাড়ির চাবি নিয়ে নিচে নামতে শুরু করেছেন। জয়িতাও বাবার পেছনে পেছনে এসে গাড়িতে গিয়ে বসল।

পুরো রাস্তা ফাঁকা। বাবা মেয়েকে অনেক উপদেশ দিতে লাগলেন। জয়িতা কোন কথা বলল না হাঁ হু ছাড়া। তার টেনশন হচ্ছিল কলেজের গেইট বন্ধ থাকবে সে বাবাকে কি উত্তর দিবে? হঠাৎ বুদ্ধি করে জয়িতা বলল, 'বাবা রাখি, রিপা, কনা আমার জন্য তেজগাঁও কলেজের সামনে অপেক্ষা করবে। আমাকে তুমি ওখানে নামিয়ে দাও।'

'ঠিক আছে আমরা বরং ওদের সেখান থেকে তুলে নিয়ে যাব।'

জয়িতা ভাবল কোন রকম তেজগাঁও কলেজের সামনে নেমে যেতে পারলেই হল। ধানমন্ডি থেকে ইন্দিরা রোড আসতে ১০ মিনিটও সময় লাগলো না। তেজগাঁও কলেজের কাছে আসতেই দেখে রিপা দাঁড়িয়ে আছে। জয়িতার বাবা বললেন, ‘ দেখ তোমার বান্ধবী। ওকে গাড়ীতে উঠে আসতে বল।

বাবা রিপা একা এসেছে। সুমি রাখীর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তুমি বরং আমাকে এখানে নামিয়ে দাও। ওরা কখন আসবে কে জানে।‘

জয়িতার বাবা এতে রাজী হলেন। এতক্ষণ জয়িতার মুখে কালো দুশ্চিন্তার যে ছায়া ছিল তা যেন ক্ষণিকের মধ্যেই পরিবর্তন হয়ে আনন্দেরঝিলিক দেখা গেল। সে উৎসাহীত হয়ে বললো, ‘বাবা তুমি সাবধানে যেও কিন্তু।‘

ঠিক আছে তুমিও সাবধানে থেকো। আর সময় পেলে ফোন দিও আমরা চিন্তায় থাকবো।

গাড়ি থেকে নেমে জয়িতা হাত নেড়ে বাবাকে বিদায় জানাল। জয়িতার বাবা চলে গেলেন। ঠিক তখনই পেছন থেকে রিপার বললো, ‘চল বেড়িয়ে পড়া যাক।‘

জয়িতা আর রিপা সিএনজি নিয়ে সোজা গুলিস্থান চলে গেল। সেখান থেকে বাসে করে সোজা শশীপুর।




ঢাকা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নবাবগঞ্জ উপজেলা। সদর উপজেলা থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার এগুলেই খ্রিষ্টান বসতি চোখে পড়বে। ইছামতি নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা খ্রিষ্টান গ্রামগুলোর একটি শশীপুর। আধুনিক প্রযুক্তি, সভ্যতা এবং উন্নয়নের আশীর্বাদে পরিপুষ্ট হলেও সবুজের সমারোহ আর অপরুপ সৌন্দর্যের  চাদরে ছাওয়া শশীপুর গ্রাম। 

রিপার বাবা নিখিল রোজারিও শশীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মেয়ের আসার খবর তিনি আগেই পেয়েছিলেন তাই সকাল ১০টার আগেই বাসষ্ট্যান্ডে এসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। বাসষ্ট্যান্ড থেকে রিপাদের বাড়ি হাঁটা পথ। যথা সময়ে বাস এসে থামলো। আগে রিপা বাস থেকে নামলো। জয়িতা বাস থেকে নামতেই হঠাৎ কোত্থেকে একটা পাগলি এসে জয়িতাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে লাগলো, ‘আমি কইছি না আসবো, আইছে। দেখ দেখ সবাই দেখ আইছে। আমি জানতাম।‘ 

জয়িতা এরকম পরিস্থিতিতে একদম ভড়কে গেল। রিপার বাবা তার হাতের ছাতা উঁচিয়ে পাগলিকে বলতে  লাগলেন, ‘এ্যাই সুদ্ধি ছাড় ছাড় নইলে দিব এক বারি। ছাড় বলছি ছাড়।

ঠিক সেই মুহূর্তে রাস্তায় দাঁড়ানো সিএনজি থেকে এক লোক নেমে এসে পাগলিকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিল। পাগলি ছিটকে পড়লো ফুটপাতের এক কোনায় গর্তে। লোকটি সেখানে গিয়ে পাগলিকে এলোপাথারি লাথি মারতে লাগলো। এ ঘটনায় রাস্তায় ছোটখাট একটা জটলা তৈরি হল। পাগলি চুপ করে মাথা ঢেকে উপুর হয়ে রইলো যেন সে খুব লজ্জা পেয়েছে। 

রোগা পাতলা পাগলির গায়ে শাড়ি নেই। শুধু পেটিকোট আর ব্লাউস পড়া। চুলগুলো খাওয়া খাওয়া করে কাটা। হাতপায়ের নখগুলো বড়বড় যেন মাত্রই মাটি খুঁড়ে বেড়িয়ে এসেছে। পাগলি জামাকাপড় শরীর সবটাই নোংরা ময়লা। মুখে আবার কালো কালো ছোপ ছোপ দেখলে মনে হয় কালি মেখেছে। সিএনজি ড্রাইভার পাগলিকে লাথি মারছে আর বলছে, ‘হারামজাদি তুই মানুষের গায়ে হাত দেস। তোর হাত দুইটা আজ আমি না ভাঙ্গছি। ওঠ ওঠ যা এহান থিক্যা।বলেই লোকটি আরো কয়েকটি লাথি মারলো। পাগলিকে দেখে জয়িতার খুব মায়া হলো। পাগলির দিকে তাকিয়ে সে ভাবতে লাগলো আহা তার জন্যই আজ এই পরিস্থিতি হলো। রিপার বাবা লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘তুমি কিছু মনে করো না মা। চল আমরা বরং যাই।

জয়িতা চলে আয়।বলেই রিপা বাবার সাথে হাঁটতে শুরু করলো। জয়িতাও তাদের পেছনে পেছনে হাঁটছে। কিছুদূর এগোতেই পেছনে আবার শোরগোল শোনা গেল। ওরা তাকিয়ে দেখে পাগলিটি দৌড়ে ওদের দিকেই আসছে আর পাগলির পেছনে সেই সিএনজি ড্রাইভার। চোখের পলকেই পাগলিটি দৌড়ে জয়িতার সামনে এসে দাঁড়াল। ঠিক একই ভঙ্গিতে জয়িতাকে জড়িয়ে ধরলো। জয়িতার মাথায় গালে হাত বুলাতে লাগলো তবে মুখে কোন কথা বললো না। জয়িতা ভয় পাচ্ছে কিন্তু চিৎকার করছে না। পাছে পাগলি ওর গলা টিপে ধরে এই ভয়ে। রিপাও ভয়ে দূরে সরে গেল। রিপার বাবা আবার ছাতা উঁচিয়ে পাগলিকে সরে যেতে বলছেন। কিন্তু পাগলি জয়িতাকে যেন আদর করছে। এমন সময় সিএনজি ড়্রাইভার তার পায়ের স্পঞ্চের স্যান্ডেল খুলে পাগলির গালে ঠাসঠাস করে মারতে লাগলো। রিপা জয়িতার হাত ধরে টানতে টানতে জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করলো। জয়িতা শুনতে পেল পাগলি চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে, ‘ওকে আর একটু দেখবো, আর একটু দেখবো। একটু দেখতে দে।‘

রিপার মা জলখাবার প্রস্তুত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রিপা তার মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘জান মা জয়িতার গ্রাম দেখার অনেক শখ। ওদের কোন গ্রামের বাড়ী নেই। ছোট বেলা থেকেই শহরে মানুষ হয়েছে। দিদির বিয়েতে আসতে পারে নি বলে ব্যস্ত হয়ে আজই চলে এসেছে। এদিকে সুদ্ধির ঘটনায় জয়িতা এতটাই হকচকিয়ে গেল যে সে কেন শশীপুর এসেছে তা যেন সে ভুলেই গেল। তার সমস্ত চিন্তা জুড়ে রইলো শুধু সেই পাগলি। ইস কিভাবেই না লোকটি পাগলিকে মারছিল। রিপার মা কয়েকটি পেয়ারা এনে বললেন, ‘নাও মা এগুলো খেয়ে দেখ। এগুলো আমাদের গাছের পেয়ারা। শহরে কি তোমরা এমন ফ্রেস ফল পাবে?’

রিপার বাবা হাতমুখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকলেন। একটুকরো পেয়ারা নিয়ে বললেন, ‘বুঝলে মনি সুদ্ধির উৎপাত আবার বেড়েছে। আজ যা করলো তুমি না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবে না।

বলবে না বলবে না করেও হঠাৎ জয়িতা জিজ্ঞেস করলো, ‘সুদ্ধি কে আঙ্কেল?’

সুদ্ধি হচ্ছে এই শশীপুর গ্রামের আবর্জনা। এই যে তুমি আমাদের এই শশীপুরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসেছো, কিন্তু এসে কি দেখলে? দেখলে একটা আবর্জনা যে কি-না গ্রামের সৌন্দর্য নষ্ট করছে, পরিবেশ নষ্ট করছে।

রিপার মা মনি বললো, ‘তুমি এভাবে বলছো কেন?’

আসলে কথায় আছে না ধর্মের কল বাতাসে নড়ে কথাটা একদম ঠিক বুঝলে? ঐ সুদ্ধি হচ্ছে তার জলন্ত প্রমান। এই সব হচ্ছে ওর বাপের পাপের ফল।

আচ্ছা আঙ্কেল উনার বাবার পাপের শাস্তি উনি পাবেন কেন?’

‘যদি তাই না-হয় তবে সুদ্ধির মত একটি নিস্পাপ মেয়ের জীবন তো এমন হবার কথা না মা।

রিপা বললো, ‘আচ্ছা বাবা ওর নাম সুদ্ধি কে রাখলো? কেমন অদ্ভুত নাম তাই না?’

অদ্ভুদ তো বটেই, তবে ওর আসল নাম সুদ্ধি নয় সুন্দরী। আর এই অদ্ভুদ নামটি রেখেছিল সুন্দরীর দাদী। আমরা তো মানুষের নাম বিকৃতি করতে ওস্তাদ। কেউ উচ্চারণ করতে না পেরে বিকৃতি করে আবার কেউ ইচ্ছে করেই নাম বিকৃতি করে।

বাবা সুদ্ধি বলো আর সুন্দরীই বলো আমি কিন্তু এমন নাম আর কোথাও শুনিনি, জয়িতা তুই শুনেছিস?'

না আমিও শুনিনি। এই নাম ছাড়া উনার আর কোন নাম নেই।?’

বাবা তোমাকে তো বলা হয় নি, জয়িতা কিন্তু খুব বড় মাপের একজন লেখিকা। বেশ কয়েকটি পত্রিকা আর ম্যাগাজিনে ওর লেখা ছাপা হয়েছে। যেখানেই যায় সেখানেই লেখার জন্য গল্প খুঁজে বেড়ায়। এই যে সুদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইছে, কয়েকদিন পর দেখবে কোন এক পত্রিকায় ওর এই পাগলীর গল্প ছাপা হয়েছে।বলেই রিপা হি হি করে হাসতে লাগলো।

জয়িতা যেন লজ্জা পেল বললো, ‘না আঙ্কেল এই একটু আধটু চেষ্টা করি আর কি।

হ্যাঁ লেখালেখি খুব ভাল অভ্যাস চেষ্টা চালিয়ে যাও।

আঙ্কেল আপনার যদি অসুবিধা না থাকে আমি সুদ্ধির বিষয়ে শুনতে চাই।

রিপার বাবা চশমা খুলে টেবিলে রেখে চোখ বন্ধ করলেন। যেন তিনি স্মৃতি হাতরাচ্ছেন। এদিকে সুদ্ধির ব্যাপারে রিপার কোন আগ্রহ আছে বলে মনে হলো না। তবে সে জয়িতার পাশে বসে পা নাচিয়ে নাচিয়ে চানাচুর খেতে লাগলো অন্যমনঙ্কভাবে। নিখিল রোজারিও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুরু করলেন-

বুঝলে মা প্রায় ২৫ বছর আগের কথা। সুদ্ধি তখন সবে শৈশব পেরিয়ে কৈশরে পা দিয়েছে। আজ যে সুদ্ধিকে দেখলে সে সুদ্ধি এরকম ছিল না। উপচে পড়া রুপ ছিল সুদ্ধির। সুদ্ধির সেই রুপের আগুনে পুড়েনি এমন কোন ছেলে এই শশীপুরে ছিল না। আমরা সুদ্ধিকে এক নজর দেখার জন্য স্কুল ফাঁকি দিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। মনে হতো বিধাতা যেন প্রচুর সময় নিয়ে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সুদ্ধিকে তৈরি করেছেন। যেমন চোখ, তেমনি নাক, তেমনি তার ঢেউ খেলানো চুল, যেন অবিকল প্রতিমা। আমরা যে সুদ্ধিকে এক নজর দেখার জন্য পাগল ছিলাম সুদ্ধি যেন তা খেয়ালই করতো না। আমাদের পাত্তাই দিত না সে। লেখাপড়ায়ও সুদ্ধি ছিল খুব তুখোড়। অপরুপ রুপের কারণেই সুদ্ধির দাদী শখ করে নাতনীর নাম রেখেছিলেন সুন্দরী। তবে ওর ভাল নাম হলো মেরিনা। সুন্দর একটি নাম। কিন্তু এই সুদ্ধির অন্তরালে কখন যে মেরিনা আর সুন্দরী নাম দুটি হারিয়ে গেছে।‘

একটু থেমে তিনি আবার শুরু করলেন, ‘জান আমরা ছয় বন্ধু ছিলাম, খুবই ঘনিষ্ট। এই সুদ্ধিকে এক নজর দেখার জন্য আমরা কারণে অকারণে সুদ্ধিদের বাড়ীর আশেপাশে ঘুরতাম। আর সুদ্ধির বাবা পচু মাতব্বার আমাদের উদ্দেশ্য আঁচ করতে পারতেন। তবে তিনি সুযোগে আমাদের দিয়ে বিনা পয়সায় কত কাজ যে করিয়ে নিতেন তার হিসেব নেই। কাজ করতে আমাদের যেন কোন ক্লান্তি লাগতো না। আশায় থাকতাম যদি একটু সুদ্ধির দেখা পাই। ভাবতাম এই হয়তো সুদ্ধি এসে দোতলার বারান্দায় দাঁড়াবে। আমাদের দিকে এক পলক তাকাবে। কোন কোন দিন সুদ্ধির দেখা পেতাম তবে বেশীরভাগ সময়ই তার দেখা পেতাম না। রিপার বাবা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লেন।

কি রে জয়িতা পাগলের গল্পে মগ্ন হলে চলবে? তুই না আমাদের গ্রাম ঘুরে দেখবি?’

একটু দাঁড়া প্লিজ।

'কি যেন বলছিলাম? হ্যাঁ, সুদ্ধির বাবা ছিলেন আমাদের গ্রামের মাতব্বর। তোমরা টেলিভিশনে যেমন দুষ্টু মাতব্বরের চরিত্র দেখ, সুদ্ধির বাবা ছিলেন ঠিক তেমন একজন লোক। এমন কোন খারাপ কাজ ছিলনা যা তিনি করতেন না। প্রকাশ্যে তিনি কাঠের ব্যবসা করতেন। আর পাছে ঘুষ নিয়ে অন্যায়ের পক্ষে বিচার করা, গরিব নিরীহ মানুষদের ঠকানো, মদের ব্যবসা করা সব কিছুই তিনি করতেন। যে বললাম আমাদের দিয়ে বীনা পয়সায় কাজ করিয়ে নিতেন।বলেই তিনি হো হো করে হাসতে লাগলেন।জয়িতার হাসি পাচ্ছে না সে পুরো গল্প শোনার জন্য উৎসুক হয়ে রইলো।

রিপার বাবা আবার শুরু করলেন, ‘সুদ্ধির বাবার আরো একটা বদ অভ্যাস ছিল। তিনি নিয়মিত ফকির বাড়ীতে যাতায়াত করতেন, যাদু টোনা করতেন। গ্রামে তার বিপক্ষে কেউ কথা বললেই দেখা যেত কিছুদিন পর কোন কারণ ছাড়াই ব্যক্তি ভিষণ অসুস্থ হয়ে পড়তেন। বীনা কারণে অসুস্থ হয়ে অনেকেই মারা যেতেন। সবাই বলে সুদ্ধির বাপের কুনজরে পড়ে যাদু টোনার কারণেই নাকী তাদের মৃত্যু হয়েছে। জয় পাড়ায় সুদ্ধিদের কিছু জমি ছিল। সেখানেই পাশের জমির মালিকের সাথে মাতব্বরের জমিজমা নিয়ে বিরোধ হয়েছিল। শুনেছি জমি নাকী আসলেই মাতব্বরের ছিল না। নিয়ে অনেক মামলা মোকাদ্দমা হলো। মামলার রায় হওয়ার কিছুদিন আগে জমির যে আসল মালিক তিনি পাগল হয়ে গেলেন। মামলা আর চললো না, রায় গেল মাতব্বরের পক্ষে। সবই শোনা কথা তবে গ্রামের সবাই সুদ্ধির বাবাকে খুব ভয় পেতেন। আর এজন্য কেউ সাহস করে সুদ্ধিকে ভালবাসার কথা কিংবা বিয়ের কথা বলতো না। সুদ্ধি বড় হতে লাগলো। ওর রুপের আলো যেন আরো ছড়াতে লাগলো। হঠাৎ একদিন শুনলাম সুদ্ধির বিয়ে ঠিক হয়েছে। তবে সেই ভাগ্যবান রাজপুত্রটি এই গ্রামের কেউ নন। তিনি অনেক দূরদেশের রাজপুত্র। সুদ্ধির বাবা তার প্রথম জীবনে জাহাজে কাজ করতেন। সেখানেই না কি তার সাথে পরিচয় হয়েছিল চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর। ঐ ব্যবসায়ীর বড় ছেলে কি যেন তার নাম------‘ বলেই রিপার বাবা মাথা চুলকাতে লাগলেন।

‘নামটা মনে পড়ছে না তবে তিনি বিশাল বড়লোক। রঙয়ের বিরাট ব্যবসা তাদের। বাড়ীতে নাকি কয়েকটি ঘোড়াও আছে। বিয়ে উপলক্ষে সুদ্ধিদের বাড়ীতে রঙ করানো হলো। পাছে গ্রামের লোকেরা বলতে লাগলো জামাইয়ের কোম্পানীর রঙ তো তাই প্রয়োজনের তুলনায় কিপটে মাতব্বর একটু বেশীই ঢালছেন। মজার কথা কি জান? বিনে পয়সার কাজ জেনেও মাতব্বর বাড়ীর পুরো রঙয়ের কাজ আমরা ছয় বন্ধু মিলেই করলাম। দুঃখ পেলেও হাসি মুখে কাজ করলাম পাছে সুদ্ধিকে একটু দেখতে পাই। তখন এই শশীপুরে কেবলমাত্র একটিই দালান বাড়ী তাও আবার দোতলা, বুঝতেই পারছো ব্যপারস্যপার। আমরা জানতাম গরিবের পেটে লাথি মেরে মাতব্বর দালান বাড়ী, ধন সম্পদ করেছিলেন। এদিকে শোনা গেল সুদ্ধির বর নাকী ঘোড়ায় চড়ে বিয়ে করতে আসবেন। কিন্তু শেষে তিনি ঘোড়ায় চলে এলেন না। চট্টগ্রাম থেকে শশীপুর অনেক দূরের পথ। তাই ঘোড়া আনা সম্ভব নয়। তবে বিয়ের আগে সুদ্ধির হবু স্বামীর ঘোড়ায় চড়া একটা ছবি শশীপুরে ভাইরাল হয়ে গেল। যাকেই পান মাতব্বর তাকেই ছবিটি দেখান। অনেকে ছবি দেখার উদ্দেশ্যে নানা উছিলায় মাতব্বর বাড়ী যেতেন। আমিও কয়েকবার ছবিটি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। ইয়া লম্বা চওড়া একটা লোক সাদা পাঞ্জাবী পড়ে ঘোড়ায় বসে আছেন। মোটা গোঁফটাও যেন লোকটিকে খুব মানিয়েছিল। পাছে হাত লেগে ছবিটি নষ্ট হয়ে যায় তাই মাতব্বর ছবিটিকে লেমেনেটিং করিয়ে এনেছিলেন। শশীপুর গ্রামের প্রত্যেকটি যুবকের মনে বেদনার সুর ছড়িয়ে সুদ্ধির বিয়ে হয়ে গেল। আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। তবে সবাই বললো বেশ মানিয়েছিল দুজনকে। যেন সোনায় সোহাগা। মাতব্বর তার একমাত্র মেয়ের উপযুক্ত জামাই পেয়ে আশে পাশের গ্রামের হাজারো মানুষকে তিনদিন ধরে খাওয়ালেন। সুদ্ধি চলে গেল শ্বশুরবাড়ী। একদিনেই গ্রামের জৌলুস কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তখন দোকানে, বাসষ্ট্যান্ডে, কিংবা মাতব্বর বাড়ী গেলে কোথাও কোন উৎসাহ হতো না। গ্রামটা খালি খালি লাগতো। কি যেন গ্রাম থেকে হারিয়ে গেছে। আমরা সব বন্ধুরা বিষন্ন মনে কয়েকদিন কাটালাম।

বিয়ের একমাস পর সুদ্ধি গ্রামে ফিরে এলো। গ্রামের প্রত্যেকটি যুবকের মনে আবারও আনন্দের ঢেউ খেলে গেল। আবারো গ্রাম মুখরিত হলো। আমরা জানতাম সুদ্ধি এখন অন্যের বউ তবুও যাকে ভাললাগে তাকে দেখে আনন্দ পাওয়া তো অন্যায় নয়। তাই না? আমরা আবারও কারণে অকারণে রাস্তা ধরে যাওয়া আসা শুরু করলাম। বিয়ের পর সুদ্ধির রুপ যেন আরো খুলেছিল। আর সে যে কতটা সুখী হয়েছিল তা ওকে দেখেই আন্দাজ করা যেত। সুদ্ধি গ্রামে রইলো সপ্তাহ খানেক। এর মধ্যে সুদ্ধির স্বামী সুদ্ধিকে নিতে এলেন। বিয়ের সময় লোকটিকে দূর থেকে দেখেছিলাম। এবার কাছ থেকে দেখে মনে হলো সত্যি তিনি শুধু ধন সম্পদের দিক থেকেই বড় নন। খুব বড় মনের মানুষ তিনি। সুদ্ধি তার স্বামীর সাথে চট্টগ্রাম চলে গেল। আমরাও আস্তে আস্তে সুদ্ধিকে ভুলে গিয়ে নিজেদের সংসার জীবন শুরু করলাম।

প্রায় বছর খানেক পর শুনলাম সুদ্ধির একটি মেয়ে হয়েছে। এই খবর শুনে মাতব্বর চট্টগ্রাম গিয়ে নাতনীকে দেখে এলেন। নাতনী নাকী সুদ্ধির মতোই দেখতে সুন্দরী হয়েছে। একেবারে পরী। মাতব্বরের ইচ্ছা ছিল মেয়ে নাতনীকে শশীপুর নিয়ে আসার। কিন্তু এত দূরের পথ। তার মধ্যে সুদ্ধির শ্বশুরবাড়ীর নিয়ম পরিবারে সন্তান জন্মালে এক বছরের মধ্যে তারা কোন ধরণের যাত্রা করে না। মেয়ে নাতনী আনতে পারলেন না বলে সুদ্ধির বাবা খুব আপসোস করলেন। এদিকে আমাদের ঘরেও রিপা এলো আমরা ভুলে গেলাম সুদ্ধির কথা। মাস ছয় পর হঠাৎ সুদ্ধি তার মেয়েকে নিয়ে এসে হাজির। শুনলাম সুদ্ধির শরীর খুব একটা ভাল না। ডাক্তার সুদ্ধিকে আবহাওয়া পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন। সুদ্ধির আসার সপ্তাহ পার হলেও আমরা সুদ্ধিকে একদিনের জন্যও দেখিনি। মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ওর বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতাম।

একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ রাস্তায় খুব চেচামেচির শব্দ। বাইরে বেড়িয়ে দেখি সুদ্ধিদের বাড়ীর সামনে ছোটখাট একটা জটলা। বাড়ীর সামনে সিএনজি, পাশেই একটা বাচ্চা খুব চিৎকার করছে। এগিয়ে গেলাম। ভাবলাম হয় তো সুদ্ধির মেয়েটার অসুখ তাই এই ভর সন্ধ্যায় ডাক্তারের কাছে যাবে।

বাবার কথার মাঝখানে রিপা হঠাৎ বলে উঠলো, ‘গল্পটা এখনো ধরতে পারিস নি জয়িতা? তুই কেমন লেখিকা বলতো? পরের টুকু আমি জানি। কি এক অজানা অসুখে সুদ্ধির মেয়েটা মারা গেল আর সুদ্ধি হলো পাগল। তাই না বাবা?’

না গল্পটা এমন নয়বলেই দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লেন নিখিল রোজারিও।

এমনই তো হবার কথা তাই না বাবা?’

যেটা জানো না সেটা নিয়ে মজা করা আমি পছন্দ করি না।

সরি বাবা

আঙ্কেল এরপর কি হলো?’

জানো আমি সেদিন সুদ্ধিকে দেখে অবাক হয়েছিলাম। আমি তো ওকে চিনতেই পারি নি। সুদ্ধির বাবা মা জোর করে কাউকে সিএনজিতে তোলার চেষ্টা করছিলেন। রোগা পাতলা একজন মহিলা কামিনি ফুল গাছের ডাল শক্ত করে ধরে আছে। সে সিএনজিতে উঠবে না। ওর কোমড় পর্যন্ত খোলা চুলগুলো ওর মা বাঁধার চেষ্টা করছেন। কাছেই সরি পিসির কোলে সুন্দর ফুটফুটে একটি বাচ্চা একদম পরীর মতো। বুঝতে অসুবিধা হলো না এটি সুদ্ধির মেয়ে। আমি সরিপিসিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পিসি মহিলাটি কে?’

আমাদের সুদ্ধি।

সুদ্ধি?’ আমি যেন হোঁচট খেলাম।একি আমাদের সেই স্বপ্নের সুদ্ধি?’

সুদ্ধিকে আমার চিনতে অনেকটা সময় লাগলো। একি চেহারা হয়েছে ওর? একদম অচেনা একজন মহিলা। রোগা পাতলা শুকিয়ে একদম কাঠ। সুদ্ধির চুলগুলো খোলা ছিল কিন্তু চুলে ছিল না সেই স্নিগ্ধতা, সুদ্ধি শাড়ি পড়ে ছিল কিন্তু তার দেহে ছিলনা কোন মাধুর্য। সন্ধ্যার আলো আঁধারে সুদ্ধির সুন্দর মুখ খানি  দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু সেই মুখে নেই কোন লাবণ্য। সুদ্ধির সেই মায়াময় চোখে নেই চঞ্চলতা যেন তার চোখ জুড়ে শুধুই ভয়। কাকে ভয় পাচ্ছে সুদ্ধি? ‍আমি সুদ্ধির বাবাকে জিগ্যেস করলাম, ‘আঙ্কেল কি হয়েছে?’

মাতব্বর আমার কথায় বিরক্ত হলেন। আমি আবারও জিগ্যেস করলাম, 'আঙ্কেল সুদ্ধির কি হয়েছে?'

সময় সুদ্ধি তার বাবার ধরে রাখা হাত একটা ঝাটকা মেরে ছাড়িয়ে দিল দৌড়। আঙ্কেল সুদ্ধির পেছন পেছন দৌড়াতে শুরু করলেন। সুদ্ধির মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সুদ্ধির শরীরটা ভাল না কে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। কিন্তু তো যেতেই চাইছে না।

আমি বললাম, ‘আমি কি আপনাদের কোন সাহায্য করতে পারি?’

আমার কথা যেন শুনতেই পান নি এমন ভাব করে তিনি সরিপিসির কোল থেকে সুদ্ধির মেয়েকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। আর সুদ্ধির মেয়েটি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলো। টুকুন একটা মেয়ে একবারে আমার রিপার বয়সী। মেয়েটার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল’ বলেই তিনি চোখ মুছলেন

জয়িতা ধরা গলায় বললো, ‘আঙ্কেল তার পর?’

আমি সাতপাঁচ না ভেবেই মাতব্বর বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলাম। সুদ্ধি উঠানে পা ছড়িয়ে বসে চিৎকার করে বলছে, ‘আমি ফকির বাড়ি যাব না। আমি ফকির বাড়ি যাব না।‘ রোগা পাতলা সুদ্ধির এই আকুতি শুনে ভেতরটা কেমন জানি মোচর দিয়ে উঠলো। সুদ্ধির বাবা সরিপিসির কানে কানে কি যেন বলে দোতলায় চলে গেলেন। সরি পিসি এসে সুদ্ধিকে জোর করে টেনে তুলতে চেষ্টা করতে লাগলেন। সুদ্ধি গোঁ মেরে বসে রইলো। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। যার সাথে কোন দিন কথা হয়নি অথচ সে ছিল আমার স্বপ্নের রানী এই অবস্থায় তাকে কি বলা যায়। পাশেই সুদ্ধির মায়ের কোলে মেয়েটি কাঁদছে। হঠাৎই আমি বলে বসলাম, ‘সুদ্ধি ওঠ তোমার মেয়েটা যে কাঁদছে। মেয়ের কথা শুনে সুদ্ধি উঠে মায়ের কোল থেকে মেয়েকে নিতে চাইল কিন্তু সুদ্ধির মা দিতে চাইছেন না। আমি বললাম, ‘আন্টি বাচ্চাটিকে ওর কোলে দিন।সুদ্ধির মা আর বাঁধা দিলেন না। সুদ্ধি তার মেয়েটিকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। সুদ্ধির পেছনে পেছনে সুদ্ধির মা আর সরিপিসিও চলে গেলেন। দোতলার বারান্দা থেকে মাতব্বর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তুমি এবার যেতে পার।এরপর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার আর কোন মানেই হয় না। আমি চলে আসলাম। রিপার বাবা কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন।

বাবাকে চুপ থাকতে দেখে রিপা বলল, ‘জয়িতা তুই পাগলির গল্প শোন আমি রান্না ঘরে মায়ের কাছে যাচ্ছি।‘

জয়িতা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। রিপার কথায় শুধু মাথা নেড়েসায় দিল। গল্পের বাকীটু  শোনার জন্য নিখিল রোজারিও দিকে জয়িতা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইল।

এর দিন দুয়েক পর, হ্যাঁ দিনটি ছিল মঙ্গলবার। আমি সবেমাত্র হাট থেকে বাড়ি ফিরেছি। কলপারে হাতমুখ ধুতে গিয়ে শুনি আবারও সুদ্ধিদের বাড়িতে চিৎকার চেচামেচি। আমি হাতমুখ না ধুয়েই রাস্তায় নেমে গেলাম। দেখি সরিপিসি দৌড়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমাকে দেখেই হাত উঁচিয়ে ডাকলেন, ‘নিখিল শিগগির আয়।

'কি হয়েছে পিসি?’

ওরা যে সুদ্ধিকে মেরে ফেললো

কে? কে মেরে ফেললো সুদ্ধিকে?’

বাড়ীতে ফকির এসেছে। সুদ্ধিকে নাকি ভুতে ধরেছে।

বল কি পিসি?’

আয় বাবা আয় শিগগিরি আয়।বলেই ফিরে আবার আমার আগে আগে মাতব্বর বাড়ী চলে গেল। আমিও পিসির পিছু পিছু বাড়ীতে ঢুকলাম।

গিয়ে কি দেখলেন আঙ্কেল?’

‘সুদ্ধির বর্তমান জীবন যাত্রায় এখন এই শশীপুরের সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সেই সব কথা আসলে ভূলেই গিয়েছিলাম। আজ আবার সব যেন চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে’ বলেই তিনি চোখ মুছলেন। জয়িতা রিপার বাবার দিকে এক দৃষ্টে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে পরের টুকু শুনবে বলে।

‘যা দেখলাম তা দেখে নিজের চোখকেও আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। উঠোনে সুদ্ধির দুই হাত এক গাছের সঙ্গে বেঁধে এক সাধুবাবা বড় এক লাঠি দিয়ে সুদ্ধিকে বেধর পেটাচ্ছেন। সাধুবাবার পরণে গেরুয়া রঙের লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। মাথায় আধা পাকা চুলগুলো জটালো। তিনি সুদ্ধিকে পেটাচ্ছেন আর জোরে জোরে বলছেন, ‘বল তুই কে?’

সুদ্ধি চিৎকার করে কাঁদছে। সুদ্ধির বাবা মা সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। কেউ কিছু বলছেন না। সুদ্ধির মেয়েটা তার এক ভাই-বউয়ের কোলে কেঁদেই চলছে। শুধুমাত্র সরিপিসি সাধুকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সাধুবাবা সরিপিসিকে বাম হাত দিয়ে ঠেলে সরাতে চেষ্টা করছেন।

সাধুবাবা বললেন, ‘মাতব্বর সাব ওর কান্দে খুব বড়ডা চাপছে। সময় লাগবো।

‘যা যা করতে হয় আপনি করেন।

সাধুবাবার সাথে অল্প বয়স্ক একজন শিষ্য। তিনি আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করছিলেন। সাধুবাবা সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মরিচ পোড়নোর ব্যবস্থা কর।

ভর সন্ধ্যায় কি যে এক পরিবেশ তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না মা। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ করে বলেই ফেললাম, ‘এসব কি হচ্ছে? ছাড়ুন মেয়েটাকে ছাড়ুন।আমার কথা শুনে সাধু বাবা আমার দিকে ফিরে তাকালেন। সুদ্ধির বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘মাতব্বর সাব বাইরের লোকজন আইলো ক্যামনে?’

সুদ্ধির বাবা আমার দিকে বড়বড় চোখ করে তাকালেন। আমি সুদ্ধির বাবাকে ভয় পেলাম না। এগিয়ে গিয়ে সাধুবাবার লাঠিটি টেনে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলাম। সরিপিসিকে বললাম সুদ্ধির হাত খুলে দিতে। পিসি সুদ্ধির হাত খুলতে লাগলো। সাধুবাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কাজটা ভাল হইতেছেনা।ওরে ভুতে পাইছে। ভূত ছাড়ান লাগবো। আপনে এহান থেকে যান।

'ওকে কোনো ভুতে ধরে নি।  মানসিকভাবে অসুস্থ। ওকে ডাক্তার দেখাতে হবে।

ডাক্তার?’ সাধুবাবা বিদ্রুপের স্বরে বললেন, ‘কোন দিন শুনছেন ডাক্তাররা ভুত ছাড়াইছে?  ভুত ছাড়ানের বিদ্যা ডাক্তাররা জানেন না।

আমি মাতব্বর সাহেবের কাছে গিয়ে বললাম, ‘আঙ্কেল সুদ্ধি মানসিকভাবে অসুস্থ ওকে ডাক্তার দেখান। ভাল হয়ে যাবে। এসব ফকির জাদু টোনায় কিছু হবে না। ওর আরো ক্ষতি হবে।

মাতব্বর চোখ রাঙ্গিয়ে আমাকে বললেন, ‘আমার বাড়ীর তিন সীমানায় তোমার ছায়া যেন আর না দেখি। তুমি এই মুহূর্তে এই বাড়ি থেকে চলে যাও।

চারিদিকে যে কি ঘটছে তা বোঝার আগেই ঘটলো আর এক কান্ড। সরিপিসি সুদ্ধির বাঁধন খুলে দিতেই সাধুবাবা সুদ্ধিকে জাপটে ধরলো আর শিশ্যকেও বললো সুদ্ধিকে আবার বেঁধে ফেলতে। শিষ্য দরি গোছাতে গোছাতে সুদ্ধি সাধুবাবার হাত এক ঝাটকায় ছাড়িয়ে দৌড়ে পালালো।সাধুবাবা আর তার শিষ্য সুদ্ধির পেছেনে পেছনে দৌড় দিল সুদ্ধিকে ধরতে।সুদ্ধির মেয়েটা যে চিৎকার শুরু করছে আর থামছেই না। মনে হলো মেয়েটার বোধ হয় খুব খিদে পেয়েছে। মাতব্বর আমাকে বললেন, ‘এখনো দাঁড়িয়ে আছ যে?’

আমি বাড়ী চলে এলাম।




রাত সাড়ে দশটা তখন। শীতের সময় গ্রামে সাড়ে দশটা মানে অনেক রাত। সারা দিনের ধকল শেষে বিছানায় গেলেই রাজ্যের ঘুম চোখে জড়িয়ে আসে। কিন্তু সেদিন আমার আর ঘুম এলো না। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। এত রাতে কে এসেছে? আমি আঁতকে উঠলাম। কড়া নেড়েই যাচ্ছে কেউ। দরজা খুলে দেখি সরিপিসি। আমি তো অবাক। পিসির কাছে শুনলাম তখনো সুদ্ধিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।

গ্রামের অনেক ছেলে বুড়োই সুদ্ধিকে খুঁজার কাজে নেমেছে। সন্ধ্যার সময় দৌড়ে সুদ্ধি নাকি হরার মার বাগে ঢুকেছিল। যে বাগে দিনের বেলায়ও কেউ একা যাওয়ার সাহস পায় না, সেই বাগে ভর সন্ধ্যায় সুদ্ধি যাওয়াতে অনেকেই নিশ্চিত হলো আসলেই সুদ্ধিকে ভুতে ধরেছে। মাতব্বরের লোকেরা টর্চ, হারিকেন, লাঠিসোটা নিয়ে বাগে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পায় নি। সুদ্ধিকে না পেয়ে সরি পিসি আমাকে জানাতে এসেছিল। সুদ্ধি ফিরে এলো তিন দিন পর। তিনদিনে সুদ্ধির আরো অনেক পরিবর্তন হয়ে গেল।

সুদ্ধি বাড়ী ফিরে এলো বদ্ধ উন্মাদ হয়ে। সুদ্ধির জীবনের তিনদিনের রহস্য অজানাই রয়ে গেছে। এসব খবর সুদ্ধির শ্বশুরবাড়ী পৌঁছাতে খুব একটা সময় লাগলো না। সপ্তা খানেক পর সুদ্ধির শ্বশুরশাশুড়ী এসে সুদ্ধির মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেলেন। সেদিন সুদ্ধি বাড়ী ছিল না তাই সুদ্ধির সাথে তাদের আর দেখা হলো না। মাতব্বর কথা দিলেন সুদ্ধি সুস্থ হলে তিনি স্বামীর কাছে মেয়েকে পাঠিয়ে দিবেন। এদিকে বাড়ী ফিরে মেয়েকে না দেখে সুদ্ধি অঝোরে কাঁদল। তবে কেউ সুদ্ধিকে সান্তনা দিল না একমাত্র সরিপিসি ছাড়া।

সুদ্ধি আর সুস্থ হলো না। তার আর স্বামীর কাছে ফেরাও হলোও না। বনে-জঙ্গলে, রাস্তা-ঘাটে কাটতে লাগলো সুদ্ধির দিনরাত। দিনে দিনে সুদ্ধির পাগলামী বাড়তে লাগলো। তারপরও সুদ্ধির শ্বশুর এক বার এসেছিলেন সুদ্ধিকে নিতে তবে সুদ্ধির যে অবস্থা তিনি আর সুদ্ধিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন নি। শুনেছি অনেকদিন অপেক্ষার পর সুদ্ধির স্বামী আবার বিয়ে করে নতুন করে সংসার শুরু করেছেন।

আঙ্কেল সুদ্ধি কার সঙ্গে থাকে এখন?’

‘কারো সঙ্গে না। সুদ্ধি এখন একাই থাকে। তার নিজের বাড়ীতে, স্বাধীনভাবে থাকে।

‘সুদ্ধির বাবা মা?’

সুদ্ধি পাগল হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সুদ্ধির বাবা ষ্ট্রোক করে প্যারালাইসিস হয়ে বিছানা নিলেন। সারাদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। কথা বলতেন না শুধু ডান হাতটা নেড়ে নেড়ে কি যেন বলতে চাইতেন কিছুই বোঝা যেত না। চোখ দিয়ে অনবড়ত জল পড়তো। হয় তো নিজের চোখে মেয়ের এই অবস্থা দেখে কাঁদতেন হয় তো বা অনুতাপও হয়েছিল নিজের কৃতকর্মের জন্য। জীবনে পাপ তো আর কম করেন নি। প্রায় চার বছর বিছানায় কষ্ট পেয়েছেন তিনি। সুদ্ধির বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর সুদ্ধির মাও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সুদ্ধি হয়ে গেলে সম্পূর্ণ একা।

সুদ্ধির বড়ভাই জাপানে কাজ করতেন। অনেক টাকা পয়সার মালিক বনেছিলেন। একবার দেশে এসে দুটো বাস কিনলেন। আবার জাপান গেলে ভাইয়ের বউ বাসের ড্রাইভারের সঙ্গে পালিয়ে গেল। ব্যাঙ্কে থাকা টাকা পয়সা সব কিছুই বউয়ের নামে ছিল। মহিলা যাওয়ার সময় সব টাকা পয়সা আর বছরের মেয়েটাকেও সাথে করে নিয়ে গেল। বড় ভাই জাপান থেকে আর ফেরেনি। শুনেছি সেখানে জাপানী মেম বিয়ে করে সুখে আছেন। মেঝভাই বড় ভাইয়ের বাস দুটি দেখাশুনা করতেন। বেশ কয়েক বছর আগে হঠাৎ করেই মেঝভাই ক্যান্সারে মারা গেলেন। দুটি ছেলে নিয়ে কোন রকমে চলছে বৌটির দিন। বউটিই এক আধবেলা সুদ্ধিকে খেতে দেয়। আর যে লোকটি রাস্তায় সুদ্ধিকে পেটালো। সুদ্ধির ছোটভাই। সারাদিন মদ খেয়ে নেশা করে চুর হয়ে থাকে। সুদ্ধির বাবা তার কাঠের ব্যবসাটা ওকে দিয়ে গিয়েছিলেন। নেশা করে বাপের কাঠের ব্যবসা লাঠে উঠিয়েছে। কোথা থেকে অল্প বয়স্ক একটা মেয়েকে ভাগিয়ে এনেছিল ১২ বছর আগে। সংসারে এখনো কোন সন্তান হয় নি। বউ আর প্রতিবেশীদের সাথে ঝগড়া মারামারি করেই ওর দিন কাটে। সুদ্ধির বাবা তিন ছেলেকে যথেষ্ট পরিমানে সহায় সম্পত্তি দিয়েছিলেন। সবাই অভাবে, নয় তো স্বভাবে সব বিক্রি করে প্রায় পথে বসেছে। আর সুদ্ধির ঠাই হয়েছে ওর দাদার আমলের ছোট ঘরটিতে।

আচ্ছা আঙ্কেল সুদ্ধির ছোট ভাইটি কি প্রায়ই ওকে এভাবে মারে?’

হাতে যখন আলসেমী বোধ করে তখন মারে না। নয় তো সুদ্ধি কোন ভুলভাল করলেই ওকে এভাবে ছোট ভাইয়ের কাছে মার খেতে হয়। প্রথম প্রথম আমরা বাঁধা দেওয়া চেষ্টা করতাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বললাম না মারামাটি, কাটাকাটি আর অশান্তি করেই ওর দিন কাটে।

একটু থেমে রিপার বাবা বললেন, ‘কি জয়িতা মা পেলে কোন গল্প?’

হ্যাঁ আঙ্কেল অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। অনেকটা সময় দিলেন আমাকে’

কই রে রিপা মা, জয়িতা মাকে নিয়ে আমাদের গ্রামটি ঘুরে দেখা’ বলেই আবার জয়িতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তবে জান মা একটা বিষয় আজ খুব অবাক লাগলো।

ঠিক তখনই রিপা ঘরে ঢুকলো। আগ্রহের সাথে বাবাকে জিগ্যেস করলো, ‘অবাক হলে কি দেখে বাবা?’

সুদ্ধি রাস্তাঘাট, বনবাদার চোষে বেড়ায়, একা একা বকবক করে নয় তো গালিগালাজ করে তবে কোন দিন সে কাউকে আক্রমন করে নি। আজকে তোমাকে দেখে কেন সে এমন করলো বুঝতে পারছিনা।

রিপা বললো, ‘কেন বাবা তোমার মনে নেই দীনা আন্টির রেষ্টুরেন্ট ওপেনিংয়ের দিন সুদ্ধি কি করেছিল?

হ্যাঁ মনে আছে। তবে সুদ্ধির সেই আচরণের একটা কারণ থাকতে পারে।

সেটা আবার কি বাবা?’

জয়িতা বলল, ‘আঙ্কেল আমাকে একটু খুলে বলবেন কি, কি হয়েছিল সেদিন।‘

জয়িতা গ্রাম ঘুরতে এসে পাগলীকে নিয়ে পরলি তুই। তোদের এই লেখক লেখিকাদের এই এক নেশা।

সব লেখক লেখিকাদের এই নেশা কি না জানিনা তবে আমার নেশা আছে সেটা ঠিক। তুই আর একটু দাড়া প্লিজ।‘

‘শোন আমি বলছি কি হয়েছিল। আমি তো সবার সামনে ছিলাম যা ঘটেছিল আমার সামনেই ঘটেছিল। ওরে বাবা মনে পড়লে এখনো আমার ভয় লাগে।

কি হয়েছিল বলবি তো না কি?’

‘আমার এক আন্টি আছে দীনা আন্টি। নবাবগঞ্জে আন্টির একটা চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট আছে। দুই বছর আগে রেষ্টুরেন্টটির ওপেনিং হয়। দিন আন্টি বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী অমল সাহাকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন অপেনিং করার জন্য।

অমল সাহা তো আমার বাবার খুব কাছের বন্ধু। প্রায়ই আমাদের বাসায় আসেন।

শোন না, তারপর কি হলো। আমার হাতে ছিল ফিতা কাটার কাঁচি। তাই ওপেনিংয়ের পর লাঞ্চ করার জন্য নিমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে দীনা আন্টি আমাকেও নিয়ে বসালেন টেবিলে। যেই না খাওয়া শুরু হয়েছে কোথা থেকে যেন সুদ্ধি উড়ে এলো। এসেই দুইহাত দিয়ে টেবিলের সব খাবার দাবার উলটিয়ে ফেলে দিল। টেবিলে রাখা গ্লাস প্লেট অমল সাহাকে লক্ষ করে ছুঁড়তে লাগলো আর কি যে বাজে বকতে লাগলো, বাবা রে বাবা। আমি তো ভয়ে অস্থির। এদিকে প্রধান অতিথি অমল সাহা ভয়ে দৌড়। পরে বাবা আর দীনা আন্টি উনাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাশের এক আর এক রেষ্টুরেন্টে নিয়ে খাওয়ালেন। খাওয়া তো দূরে কথা তিনি ভয়ে ঢাকা চলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি তো বলেই দিলেন যে এই এলাকায় তিনি আর কোন দিন আসবেন না।

জয়িতা যেন কোন রহস্যের সমাধান করতে পেরেছে এমন ভঙ্গিতে বললো, ‘ এই কথা। এবার আমি বুঝতে পেরেছি কেন বাবা আমাকে শশীপুর আসতে দিতে চান নি।‘

তার মানে?’

বাবা নিশ্চয়ই অমল আঙ্কেলের কাছে দিনের ঘটনা শুনেছিলেন। তাই বাবাও ভয় পেয়ে আমাকে শশীপুর আসতে দিতে চান নি। তাছাড়া অমল আঙ্কেল যেভাবে রসিয়ে কষিয়ে গল্প বলেন। আমি নিশ্চিত বাবা এই সাধারন ঘটনাকেই বিরাট ভয়ঙ্কর মনে করছেন। আর তাই আমাকে এখানে আসতে দিতে চান নি।

রিপার বাবা বললেন, ‘অমল সাহা তাহলে তোমাদের পারিবারিক বন্ধু?’

হ্যাঁ আঙ্কেল, আপনি জানেন উনি খুবই মজার মানুষ। সাধারণ একটা হাসির ঘটনাকে উনি এমন ভঙ্গিতে বর্ণনা করেন একেক সময় হাসতে হাসতে আমাদের পেটে খিল ধরে যায়। আবার ছোট খাট ভয়ের গল্প উনি এমন ভয়ংক করে বলেন যে শুনে আমরা ভয়ে কাঠ হয়ে যাই। বাবা বলেন মজা করার জন্যই নাকি আঙ্কেল এভাবে বলেন।

রিপার বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘তবে অমল সাহার সঙ্গে সুদ্ধির ঐরকম করার একটা কারণ আছে বলে আমার মনে হয়।

অপরিচিত কাউকে দেখলেই সুদ্ধি এমন করে তাই না বাবা? অমল সাহা আর জয়িতা দুজনেই সুদ্ধির অপরিচিত আর সুদ্ধি দুজনকে দেখেই কেমন করলো দেখলে না বাবা?’

না তোমার কথাটা ঠিক না। এই রাস্তা দিয়ে সারা দিন অনেক অপরিচিত মানুষই তো যায়। কই সুদ্ধি তো তাদের সাথে এমন করে না। তাছাড়া অমল সাহা সুদ্ধির অপরিচিত নয়। আমার মনে হয়, অমল সাহা সুদ্ধিকে চিনতে না পারলেও সুদ্ধি ঠিকই অমল সাহাকে চিনতে পেরেছিল।

বাবা কি বলছো তুমি? সুদ্ধির মতো একটা পাগলি যে জীবনে টিভি দেখে না রেডিও শুনে না সে কি করে অমল সাহাকে চিনবে?’

এখন হয় তো সুদ্ধি টিভি দেখেনা রেডিও শুনে না। তবে এক সময় কিন্তু এগুলোর প্রতি সুদ্ধির প্রচন্ড ঝোঁক ছিল। আর সে সময় অমল সাহা ছিলেন উঠতি গায়ক। অনেক মেয়েদেরই স্বপ্নের নায়ক ছিলেন তিনি।

আঙ্কেল তার মানে অমল সাহার সঙ্গে সুদ্ধির কোন সম্পর্ক ……?’

আমি জানি না আমার অনুমান ঠিক কি-না, তবে অমল সাহা সুদ্ধির বিয়ের সময় ছেলের পক্ষের স্বাক্ষী ছিলেন। সুদ্ধির স্বামীর ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন অমল সাহা। দুই পরিবারের মধ্যে যাওয়া আসাও ছিল। আমার কেন জানি মনে হয় সুদ্ধি অমল সাহাকে চিনতে পেরেই সেই দিন ধরনের আচরণ করেছিল।

তাই যদি হয় তবে জয়িতার সঙ্গে আজ সুদ্ধি কেন এমন করলো?’

সেটা তো আমি বলতে পারবো না মা। সব সময় সব কিছুর কারণ জানা যায় না। আর আমি যেটা বললাম সেটা সম্পূর্ণ অনুমান করে। তাছাড়া সুদ্ধি অমল সাহাকে গ্লাস ছুড়েছিল আর জয়িতাকে মনে হলো সুদ্ধি আদর করছিল। তাই না জয়িতা?’ বলেই তিনি হাসার চেষ্টা করলেন।

ঠিক আছে এবার তোমরা যাও গ্রাম ঘুরে দেখ। তা না হলে আবার দুপুরের খাবার সময় হয়ে যাবে।

চল জয়িতা।

‘দাড়া ব্যাগটা নিয়ে নেইবলেই দুজনে বেড়িয়ে পড়লো। রিপাদের বাড়ীর চারটি বাড়ী পরেই সুদ্ধির ঘর। একেবারে রাস্তার পাড়ে। অনেক পুরোনো দিনের ঘর। ঘরটি নির্মাণের সময় হয় তো কেউ ভাবেই নি যে একদিন এই দিক দিয়ে পিচঢালা পাকা রাস্তা হবে। আর সুদ্ধির ঘরের বারান্দার অর্ধেকই চলে যাবে সরকারি রাস্তায়। রিপা সুদ্ধির ঘরটি দেখিয়ে বললো, ‘জয়িতা এই হচ্ছে তোর গল্পের নায়িকার রাজ প্রাসাদ।

তুই নায়িকা বলছিস কেন?’

আমি তো জানি তুই ঢাকায় ফিরেই সুদ্ধির গল্পটা লিখবি। কি ঠিক বলেছি না?’

হ্যাঁ তা লিখবো বৈ কি। গল্পটা আমার মনে ধরেছে।

তাহলে সেই গল্পের নায়িকাটা কে? সত্যি করে বলবি।

অবশ্যই সুদ্ধি।

তাহলে?’

তাই বলে নায়িকা কথাটা মেনে নিতে পারছিনা। নায়িকা কথাটা শুনলেই মনে হয় অল্পবয়স্ক মেয়ে যে কিনা নেচে গেয়ে কোন নায়কের মন ভোলাবে, নয় তো মারামারি করবে। সাথে প্রেমঘটিত কোন ব্যাপার থাকবে। কিন্তু সুদ্ধিকে নায়িকা বলতে আমি নারাজ। তাছাড়া আমি ভাবছি অসহায় মানসিকভাবে অসুস্থ একজন মহিলার জীবনের সত্য ঘটনা নিয়ে লেখাটা কি ঠিক হবে?’

কেন হবে না এক বার হবে। তুই লেখ আমি ছাড়পত্র দিববলেই রিপা হাসতে লাগলো। সঙ্গে জয়িতাও যোগ দিল।

রিপা চল না সুদ্ধির ঘরটা একটু ঘরে দেখে আসি।‘

কি বলছিস? বাসষ্ট্যান্ডে তোকে যেভাবে অভ্যর্থনা জানালো, এখন যদি তোকে ওর ঘরে দেখে ফেলে কি হবে বুঝতে পারছিস?’

পারছি। মনে হয় ঘরে নেই, দেখছিস না ঘরের দরজা বন্ধ। শোন তোকে ভেতরে যেতে হবে না। তুই বাইরে দাড়া আমি একটু ভেতরটা দেখে আসি। লিখতে যখন যাচ্ছি তখন ঘরের বর্ণনাটা বাস্তবই লিখতে চাই।


 


সুদ্ধির ঘরটা ছোট। দেয়ালের আস্তর খসে পড়েছে। খোলা বারান্দার অর্ধেকটাই রাস্তার সঙ্গে লাগোয়া। বারান্দায় হাতলভাঙ্গা নোংরা একটা প্লাষ্টিকের চেয়ার। চেয়ারের চারপাশে মাছি ভনভন করে ঊড়ছে। ঘরের দরজাটা অনেক পুরোনো, উপরে শেকল আঁটা। রিপা রাস্তার এক কোনে দাঁড়িয়ে রইলো আর জয়িতা ঘরের শেকল খোলা মাত্রই ভেতর থেকে ভটকা দুর্গন্ধ পেল। সে নাক চেপে বারান্দায় ফিরে এলো।

কি রে কি হলো, ফিরে এলি যে?’

দুর্গন্ধ, ঘরের ভেতর যাওয়া যাচ্ছে না।

চলে আয়।

‘সবুর কর আর একবার একটু চেষ্টা করে দেখি। এবার জয়িতা তার ওড়নাটা ভালভাবে নাকে মুখে পেচিয়ে নিল। আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকলো। ঘরের দুইপাশে ছোট ছোট দুটো জানালা দুটোই খোলা। সারা ঘরময় ময়লা জামাকাপড় ছড়ানো। মেঝেতে একটা মুড়ির বোয়াম খোলা পড়ে আছে। বোয়ামের ভেতরে দুটো টিকটিকি। জয়িতার উপস্থিতি টের পেয়ে দৌড়ে পালালো। ঘরে একটা ছোট খাট। বিছানা বলতে কিছু নেই ছেঁড়া একটা পাটি আর তেল চিটচিটে একটা বালিশ। খাটেও জামা কোপড়ের স্তুপ। জয়িতা ভাল করে সব লক্ষ্য করছে কারণ সে তার গল্পে বিস্তারিত লিখতে চায়। জয়িতা এবার খাটের নিচে উঁকি দিল। খাটের নিচে পরিত্যাক্ত কাঁচ আর প্লাষ্টিকের বোতলে ঠাসা। খাটের পাশে ছোট একটা সেলফ। হাট করে খোলা সেলফটির বাইরে ভেতরে মাকড়সার জালে জড়িয়ে আছে। সেলফের উপরে তাকে একটা প্লেটে পাউরুটির কিছুঅংশ খোলা পড়ে আছে। সেখানেও মাছি ভনভন করছে। পাশেই একটা হারিকেন, জন্মের পর থেকেই যেন হারিকেনটি পরিস্কার করা হয় নি।

জয়িতার দম বন্ধ হয়ে আসছিল তবুও সে সেলফের ভেতরটা দেখার জন্য কাছে গেল। সেখানেও নোংরা পলিথিনের স্তুপ। কিন্তু সেলফের দ্বিতীয় থাকে কয়েকটি পুরোনো কাঁসার থালাবাটি। তারপাশেই একটা পুরোনো কাগজের মতো কি যেন দেখতে পেল জয়িতা। তবে মাকরসার জালের কারণে ভেতরে হাত দেওয়ার সাহস পেল না। এদিকে ঘরের পুরোটাই দেখা হয়ে গেছে তাই জয়িতা ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াল। হঠাৎ কি মনে করে জয়িতা আবার সেলফের কাছে গেল। খাটের নিচ থেকে একটা প্লাষ্টিকের বোতল নিয়ে সেলফের ভেতরের মাকরসার জালগুলো ভেঙ্গে ফেললো। এবার জয়িতা কাগজটার দিকে হাত বাড়াল। না এটা কাগজ নয়, একটা ছবি। ধুলো আর ময়লায় ছবিটির বিষয়বস্তু বোঝার উপায় নেই। জয়িতা তার ঊড়নার এক অংশ দিয়ে লেমেনেটিং করা ছবিটি মুছলো।

জানালার কাছে ছবিটি মেলে ধরতেই জয়িতা অবাক। এটি তার বাবার ছবি। ঘোড়ায় চড়া সাদা পাঞ্চাবী পরা লোকটি তার বাবা। অনেকদিন আগেকার ছবি কিন্তু জয়িতা তার বাবাকে স্পষ্ট চিনতে পারছে। জয়িতার হাতপা যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। সে কিছুই আর ভাবতে পারছে না। কি করে তার বাবার ছবি সুদ্ধির ঘরে এলো? এদিকে রিপা জয়িতাকে ডেকে চলছে বাইরে যাওয়ার জন্য। রিপার ডাক যেন জয়িতার কানে পৌঁছাচ্ছে না। জয়িতার মাথা ঘুরতে লাগলো। চারদিক কেমন যেন অন্ধকার লাগছে তার। সে কি এখন পড়ে যাবে? জয়িতা বাম হাতে ছবিটি রেখে ডান হাতটি অন্যমনস্কোভাবে আবার সেলফের ভেতর ডুকালো। সেখানে আরো একটি ছবি পেল সে তবে এই ছবিটি লেমেনেটিং করা নয়। ছবিটির উপরের অংশ অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। তবে বোঝা যাচ্ছে দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে আর একজন চেয়ারে বসা এবং তার কোলে একটি ছোট বাচ্চা। পোষাক দেখে বোঝা যাচ্ছে ছবিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ দুজনের একজন নারী অন্যজন পুরুষ। এদের বুকের কাছ থেকে মাথা পর্যন্ত পুরোটাই প্রায় নষ্ট। মুখগুলো বোঝা যাচ্ছে না। তবে চেয়ারে বসা মহিলার মুখটা বোঝা যায় খুব সুন্দরী একজন মহিলা। মহিলার কোলেএকটা বাচ্চা। এই বাচ্চাটিও জয়িতার পরিচিত। এই বয়সী এই চেহারার বেশ কয়েকটি ছবি তাদের বাড়ীর দেয়ালে বাঁধানো আছে। আরো কিছু ছবি আছে তাদের এ্যালবামে। এটি তার ছোট বেলার ছবি। সে স্পষ্ট চিনতে পারছে কিন্তু যে মহিলার কোলে বাচ্চাটি, সে মহিলাকে জয়িতা কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ে না।

এই মহিলা কে? হঠাৎ জয়িতার মনে প্রশ্ন এলো, ইনি কি সুদ্ধি? জয়িতার মাথাটা যেন চক্কর দিল। সে আর কিছু ভাবতে পারছে না। একবার তার মনে হলো হয় তো সে স্বপ্ন দেখছে। সারা দিন সুদ্ধির গল্প শোনার জন্যই বোধ হয় এমন হচ্ছে। হয় তো এখন সে ঘুমিয়ে আছে আর ঘুম ভাঙ্গলেই দেখবে সব স্বপ্ন ছিল। নিজের অজান্তেই জয়িতার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো।

কি রে জয়িতা থাকবি নাকি সুদ্ধির বাড়ীতে? বের শিগগির, সুদ্ধি এলো বলে

জয়িতা ধরা গলায় বললো, ‘হ্যাঁ আসছি’

জয়িতা এখন কিভাবে বাইরে যাবে? সে যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা। তার মনে হচ্ছে সে দি তার নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে চিৎকার করে কাঁদতে পারতো?

আবারও রিপা জয়িতাকে তাড়া দিল। জয়িতা তারাতারি করে ছবি দুটো তার ব্যাগে ভরে নিল। ব্যাগে হাত দিতেই হঠাৎ লতাদির জন্য উপহার আনা শাড়িটি জয়িতার চোখে পড়লো। জয়িতা শাড়িটি বের করে সুদ্ধির তেল চিটচিটে বালিশের উপর যত্ন করে রাখলো। যেন সুদ্ধি ঘরে প্রবেশ করলেই তার চোখে পড়ে। চোখ মুছে জয়িতা ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো।

কি রে আমি তো ভেবেছি তুই সুদ্ধির ঘরদোর পরিস্কার করতে শুরু করেছিস।

য়িতা কথা বলতে চাইছে কিন্তু তার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না।

রিপা বললো, ‘কি হলো মুখ ভার করে আছিস যে।

দূর কি যে বলিস মুখ ভার করবো কেন। বদ্ধ ঘরে অনেকক্ষণ ছিলাম তো তাই এ রকম লাগছে।

দুজনেই হাঁটতে লাগলো। রিপা বললো, ‘জয়িতা তুই ঘরে ছিলি কি ভাবে? ইস…বাইরে থেকেই আমি

কি যে দুর্গন্ধ পাচ্ছিলাম।‘

জয়িতা কথা ঘুরালো, ‘লতাদির বাড়ি কি খুব দূরে?’

না না তো দেখা যাচ্ছে। তোকে দেখে দিদি অনেক খুশি হবে। কত দিন পর দেখা হবে। জানিস বিয়ের সময় দিদি তোর কথা অনেক করে বলছিল।

রিপার দিদি লতা ঢাকায় রিপাদের হোষ্টেলে থেকেই এবার বিএ পাশ করেছে। সেই সুবাদে লতাকে জয়িতা দিদি বলে ডাকে। আর লতাদিও জয়িতাকে রিপার মতোই ছোটবোন হিসেবে স্নেহ করে। লতাদির স্বামী শিশিরদাও একই গ্রামের ছেলে। শিশিরদা ঢাকায় একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি করেন। লতাদি যখন রিপাদের হোষ্টেলে থাকতো তখন মাঝে মাঝেই দেখা যেত শিশিরদা আর লতাদি হোষ্টেলের নীচে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। রিপা দুষ্টামী করে বলতো, ‘দিদি আজই আমি জেঠুকে ফোন করে বলবো তুমি শিশিরদার সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছো।

লতাদি রিপাকে আইসক্রিম খাওয়াবে বলে কথা দিতো। মাঝে মাঝে সত্যি শিশিরদা সবাইকে আইসক্রিম খাওয়া তো। সেই লতাদি আজ শিশিরদার বৌ।

লাতাদি ওদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। ওদের আসতে দেরি হয়েছে বলে অভিমানও করল। রিপা দিদির মান ভাঙ্গাতে বললো, ‘আর বলিস না দিদি, জয়িতা আমাদের গ্রামের একজনের প্রেমে পড়ে গেছে। আসার পথে তার ঘর বাড়ী সব কিছু পরিদর্শন করে তারপর এলো। তাই তো তোর এখানে আসতে দেরি হলো।

জয়িতা সেই ভাগ্যবান পুরুষটি কে?’

জয়িতা ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে পড়লো। নিজেকে সামলিয়ে সে নিয়ে সে বললো, ‘রিপা প্লিজ এসব কথা আর ভাল্লাগছেনা। এখন না হয় আমরা অন্য কথা বলি।

কি রে হঠাৎ তোর কি হলো?’

আমি দিদির সাথে দেখা করবো বলেই তো এখানে এসেছি তাই না। থাক না ওসব অপ্রোয়োজনীয় কথা।‘

ওকে সরি সরি। আমি আর কোন কথা বলবো না। এবার তুই দিদির সাথে কথা বল।

আগে লতাদিকে দেখলে জয়িতা যেমন উচ্ছসিত হতো আজ তার সে রকম হলো না। জয়িতা বুঝতে পারলো তার এই পরিবর্তন লতাদি রিপা দুজনেই লক্ষ করছে। তাই সহজ হওয়ার জন্য জয়িতা লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো, ‘দিদি আমি খুব দুঃখিত তোমার জন্য কোন গিফট আনিনি বলে। পরে আমি রিপার কাছে তোমার জন্য একটা গিফট পাঠিয়ে দেব। বলতো দিদি তোমার কি পছন্দ?’

আমার জন্য কোন গিফট পাঠাতে হবে না। তুমি যে মনে করে আমাকে দেখতে এসেছো তাতেই আমি খুব খুশি হয়েছি। তোমাদের শিশিরদা এতক্ষণ তোমাদের অপেক্ষায় থেকে মাত্র গেল স্নান করতে। এক্ষুই এসে পড়বে।

রিপা বললো, 'দিদি শিশিরদা কোথায় স্নান করতে গেছেন? পুকুরে? '

'হ্যাঁ, যাবি তোরা?'

রিপা বললো, 'জয়িতা যাবি পুকুরে স্নান করতে? খুব মজা হবে।'

'না আমি যাব না। তুই যা না।'

'কিরে তুই না বললি গ্রাম দেখবি, পুকুরে স্নান করবি।'

'বলেছিলাম তবে এখন আর ইচ্ছে করছে না।'

শিশিরদা স্নান করে ফিরে এলে ওরা অনেকক্ষণ কথা বললো। তবে কথা রিপা আর শিশিরদাই বলছিল। জয়িতার কোন কিছুই ভাল লাগছিল না। ওদের কথাবার্তায় জয়িতা মনোযোগ দিতে পারলোনা।

শশীপুর গ্রামে প্রায় প্রত্যেক বাড়ীতেই পুকুর আছে। বাড়ী এসে রিপা পুকুরে স্নান করতে নামলো আর জয়িতা পুকুর পাড়ে তাল গাছ তলায় বসে রইলো। জয়িতার মনে হাজার প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, যেমন তার বাবার আর তার ছবি সুদ্ধির ঘরে কেন? এই তিন জনের সম্পর্ক কি? তাহলে তার বাবা সংকর গমেজ কি সুদ্ধির স্বামী ছিলেন?

ঐ যে রিপার বাবা বললেন, সুদ্ধির স্বামীর ঘোড়ায় চড়া ছবি। রিপার বাবা কি এই ছবিটির কথাই বলছিলেন। না ঘোড়ায় চড়া অন্য কারো ছবি আছে যিনি আসলেই সুদ্ধির স্বামী তার বাবা নন। কিন্তু তার ছোট বেলার ছবি এখানে কেন? তবে কি তার বাবা সংকর গমেজ সুদ্ধির স্বামী আর সে সুদ্ধির সেই ছোট্ট মেয়ে? তা কি করে সম্ভব। তার তো মা আছে। তবে সে যাকে মা ডাকে সুমিতা গমেজ কি তার আসল মা নন? জয়িতা খুব কষ্ট হচ্ছিল সে কি সব আজে বাজে কথা ভাবছে।

আবার জয়িতার মনে হল, তাহলে কেন বাবা তাকে শশীপুর আসতে দিতে চাননি? এটাই কি তার কারণ? তার বাবার গোপন এক অতীত আছে যা তিনি জয়িতাকে জানতে দিতে চান না। জয়িতার মা কি এসব কথা জানেন? জয়িতা যদি সুমিতার মেয়ে না হয়ে থাকেন তবে নিশ্চয়ই তিনি জানেন তার স্বামীর অতীতের কথা। অনেক কিছুই যেন মিলে যাচ্ছে আবার অনেক কিছুই যেন মিলছে না। যেমন, সুদ্ধির স্বামীর বাড়ী চট্টগ্রামে কিন্তু জয়িতাদের বাড়ী আদৌ চট্টগ্রামে নয়। জয়িতা ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছে তার বাবা ছোটকাল থেকেই ঢাকায় থাকে। তাদের কোন গ্রামের বাড়ী নেই। তার মায়েরও কোন আত্মীয় স্বজন নেই। আচ্ছা এটাই বা হবে কেন?

মানুষের তো একটা শিকড় থাকে। তার বাবা মায়ের কোন শিকড় নেই। কেন? এর কি কোন কারণ আছে? রিপার বাবা বলছিলেন, সঙ্গিত শিল্পী অমল সাহা সুদ্ধির স্বামীর বন্ধু। অমল আঙ্কেল তো তার বাবারও বন্ধু। তাহলে কি সে যা ভাবছে তাই ঠিক?

জয়িতা নিজেই নিজের মনে বলতে লাগলো তার বাবা তো তাকে শশীপুর আসতে বারণ করেছিলেন। কেন সে বাবার কথা অমান্য করে লুকিয়ে শশীপুর এলো? কি জানতে এসেছিল সে? কোন গোপন বিষয়? হ্যাঁ, গোপন বিষয় তো অবশ্যই, তবে কেন সে এই গোপন বিষয়টিকে মেনে নিতে পারছে না। সে গোপন কিছু একটা জানতে এসেছিল জেনেছে তবে তার কষ্ট হচ্ছে কেন?

সুদ্ধি কি তার মা? এখন যদি সুদ্ধি এখানে এসে পরে তবে সে সুদ্ধিকে কি বলে সম্বোধন করবে? সে কি সুদ্ধিকে মা ডাকতে পারবে? কেন সুদ্ধি বাসষ্ট্যান্ডে তাকে দেখে জড়িয়ে ধরেছিল? জয়িতার স্পষ্ট মনে আছে সুদ্ধি তাকে জড়িয়ে ধরে বারবার বলছিল সে জানতো জয়িতা আসবে। তার মানে কি?

সুদ্ধি কি তাকে চিনতে পেরেছে? জয়িতা আসবে সুদ্ধি কিভাবে জানতো? কে তাকে খবর দিল? একেই কি বলে মায়ের মন? জয়িতা চোখ বন্ধ করে বলতে লাগলো,

'সুদ্ধি আমার মা। সে কাকতালিয়ভাবে জানতে পেরেছিল আজ আমি শশীপুর আসবো। আর আমাকে দেখতে সে বাসষ্ট্যান্ডে গিয়েছিল। অথচ আমি তাকে দেখে ভয় পেয়েছি। কেউ কি মাকে দেখে ভয় পায়?' 

'চল জয়িতা আমার স্নান শেষ। তুই তো পানিতে নামলি না। বেশ মজা হতো নামলে।' হঠাৎ রিপার কথায় জয়িতা আঁতকে উঠলো।





রীপার মা অনেক খাবারের আয়োজন করেছেন। কিন্তু জয়িতার কোন কিছুই পেটে ঢুকছেনা। তার মনে হচ্ছিল সুদ্ধি এখন কোথায় আছে, কি খাচ্ছে? সে আর চুপ থাকতে পারলো না। বললো, 'আঙ্কেল চিকিৎসা করালে কি উনি ভাল হবেন না?'

'কার কথা বলছো তুমি মা?'

'ঐ যে মহিলাটা, যিনি মানসিকভাবে অসুস্থ।'

'ও সুদ্ধির কথা বলছো?'

'হ্যাঁ উনার কথাই বলছি'

'কি রে জয়িতা তুই দেখি পাগলি থেকে মানসিক রোগী, সুদ্ধি থেকে একেবারে আপনি বলা শুরু করলি। বিষয়টা কি? উপন্যাসের নায়িকা বলে রেসপেক্ট করছিস?' বলেই রিপা হিহিহি করে হাসতে লাগলো।

জয়িতার খুব অসহ্য লাগছিল রিপার হাসি। জয়িতা আবারও কথাটা পুনরাবৃত্তি করলো।

রিপার বাবা বললো, 'দেখ মা শুরুতে সুদ্ধিকে ডাক্তার দেখালে হয় তো ভাল হতো। কিন্তু ওর তো সঠিক চিকিৎসা হয় নি। ওকে আসলে তাবিজ কবজ করেই পাগল বানানো হয়েছে। তাছাড়া কে নিবে ওকে ডাক্তারের কাছে?'

'ধরেন যদি কেউ নেয়'

'ওর আপন যারা আছে তারা কেউ ওকে ডাক্তারের কাছে নিবে না। প্রথমত ওদের সে রকম সামর্থ্য নেই আর দ্বিতীয়ত তারা চায় না সুদ্ধি সুস্থ হোক। ওরা চায় সুদ্ধি যেন তাড়াতাড়ি মরে যায়।'

'কেন?'

জয়িতা 'কেন' শব্দটা এত্ত উত্তেজিত হয়ে বললো যে খাবার টেবিলের সবাই জয়িতার দিকে বিষ্মিত হয়ে তাকালো। জয়িতা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললো, 'না মানে একজন নিরিহ মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির মৃত্যুতে কার কি লাভ?'

'সুদ্ধির ছোট ভাইকে তো দেখলে যখন তখন যেখানে সেখানে সুদ্ধির গায়ে হাত তোলে। লোকটা মোটেও ভাল না। সুদ্ধির সম্পত্তির উপর ওর নজর আছে। কয়েকবারই ও সুদ্ধিকে বাড়ী থেকে বের করে দিয়ে সুদ্ধির বাড়ীটি বিক্রি করতে চেয়েছিল। গ্রামের মুরুব্বিদের প্রতিরোধে সেটা আর হয়ে উঠে নি। আর সুদ্ধি যদি কখনো সুস্থ হয়ে উঠে তবে ঐ ভাইটিরই বেশী ক্ষতি হবে। জানো মা মাঝে মাঝেই সুদ্ধি আমাকে এসে নালিশ করে তার ঐ ছোট ভাই নাকি তাকে মেরে ফেলবে। সে নাকি ভয় পায়।'

'আঙ্কেল উনি কি সব সময় পাগলামি করেন?'\

'না না মাঝে মাঝে সুন্দর সুস্থ মানুষের মতো কথা বলে। যেদিন ওর মন ভাল থাকে সেদিন ও সকালে স্নান করে। ঘরদোর পরিস্কার করে, কারো কারে সাথে কথাও বলে।'

'আর সেই কথা বলা মানুষদের মধ্যে তোমার এই আঙ্কেল হচ্ছেন অন্যতম। সুদ্ধির কোন অভিযোগ থাকলে সে সব বলবে তোমার এই আঙ্কেলকে।' হেসে হেসে বললেন রিপার মা।

'সত্যি আঙ্কেল?' সুদ্ধি মাঝে মাঝে ভাল থাকে শুনে জয়িতা যেন একটা সান্তনা পেল।

রিপার মা বললেন, 'একদিন খুব ভোরে তোমার আঙ্কেল তখনো শুয়ে আছে সুদ্ধি এই এত্তগুলো ঢেড়স নিয়ে এসে হাজির। এসেই তোমার আঙ্কেলের নাম ধরে জোরে জোরে ডাকছে। আমি বাইরে বেড়িয়ে দেখি সুদ্ধি বড় একটা ছালার বস্তা হাতে দাঁড়িয়ে। আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম কিন্তু সে সুস্থ মানুষের মতো জিগ্যেস করলো, তোমার আঙ্কেল বাড়ী আছেন কিনা।

আমি বললাম, 'কেন ওকে কি দরকার?'

'দরকার আছে ডেকে দাও।'

আমি ভয়ে ভয়ে তোমার আঙ্কেলকে ডেকে দিলাম। তোমার আঙ্কেলকে দেখেই সুদ্ধি হাতের বস্তা দিয়ে বললো, 'এর মধ্যে ঢেড়স আছে। আমার বাগানে হয়েছে।' বলেই সুদ্ধি চলে গেল। প্রায় অর্ধেক বস্তা ঢেড়স। আমরা আশে পাশের ঘরে বিলিয়েছিলাম।

'ওনার সবজির বাগান আছে?'

'বাড়ীর পেছনে জায়গা আছে বেশ খানিকটা। মন মেজাজ ভাল থাকলে ওখানেই বাগান করে। তবে এতে ওকে সাহায্য করে সরিপিসি'

'আচ্ছা লক্ষী পিসিটা কে আঙ্কেল?'

'সরিপিসি এই গ্রামেরই একজন বিধবা মহিলা। আমরা যখন খুব ছোট তখন থেকেই দেখছি সরিপিসি সুদ্ধিদের বাড়ীতে থাকতেন। সুদ্ধির সাথে সরিপিসির খুব ভাব ছিল। এখন সুদ্ধির আত্মীয় বলতে কেবল ঐ সরিপিসিই আছেন।'

'জানিস জয়িতা সরিপিসি এই গ্রামের ছোট বড় সবার পিসি। বাবাও পিসি বলেন আবার আমিও পিসি বলি।' বলেই রিপা আবার হাসতে লাগলো।

'সরিপিসি কোথায় থাকেন?'

'সরিপিসি এখন তার এক ভাইপোর বাড়ীতে থাকেন। কাজকর্ম এখন আর তেমন করতে পারেন না। তবে সুদ্ধিকে দেখতে মাঝে মাঝে আসেন। সুদ্ধিও সকাল সন্ধ্যা সরিপিসির বাড়ীতে গিয়ে বসে থাকে। এখন সুদ্ধির আপন বলতে ঐ পিসিই আছেন।'

'সরিপিসি নিশ্চয়ই উনাকে স্নেহ করেন?'

সেই ছোটবেলা থেকে সুদ্ধি তো সরিপিসির কাছেই মানুষ। সুদ্ধির সন্তান হওয়ার খবর শুনে সুদ্ধির বাবা সরিপিসিকে সুদ্ধির শ্বশুরবাড়ীতে রেখে এসেছিলেন। সুদ্ধি পাগল হওয়ার পর ঐ পিসিই সুদ্ধির মেয়েকে দেখাশুনা করতেন।'

 সবার খাওয়া হয়ে গেছে তবে জয়িতা তেমন কিছু খেল না। খাবার টেবিল ছেড়ে সবাই বসার ঘরে গিয়ে বসলো। এখন জয়িতার মনে হচ্ছে সরিপিসির সাথে দেখা হলে অনেক প্রশ্নের উত্তর সে পাবে। কিন্তু সুদ্ধি সম্পর্কে বেশী আগ্রহ দেখানোটাকে কে কি ভাবে নেবে তাই সে ভাবছিল। তাছাড়া রিপার মুখে কোন রাখঢাক নেই। কার সামনে কি বলে বসবে। জয়িতার ভেতরটা দুমরে মুচরে যেতে লাগলো। আজ সে এক বাস্তব সত্যের মুখোমুখি।

সে কি করবে এখন? সে কি এই চরম সত্যকে অস্বীকার করবে নাকী দীর্ঘ দিনের লুকিয়ে থাকা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবে? কিন্তু সমাজে তার বাবার যে প্রতিষ্ঠা মান-সম্মান সেখানে সুদ্ধি যে বড়ই বেমানান। সেই বা সুদ্ধিকে তার নিজের জীবনে কোন স্থান দিতে পারবে? সে তো জেনেছে সুদ্ধির সাথে তার আর তার বাবার কোন এক সম্পর্ক রয়েছে। ছবিটিই তার প্রমান, কই সে তো রিপার বাবাকে স্পষ্ট করে জিগ্যেস করছে না। রিপার বাবা নিশ্চয়ই এর সঠিক উত্তর দিতে পারবেন। কিন্তু সুদ্ধির সাথে তাদের আসল সম্পর্ক রিপার বাবার সামনে প্রকাশিত হওয়ার ভয়েই তো জিগ্যেস করছে না। কিন্তু এত বড় একটা সত্যকে সে কিভাবে অস্বীকার করবে?

জয়িতা মনে মনে ঠিক করলো সে সুদ্ধিকে মানসিক হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করবে। ঢাকা ফিরে বিষয়টি নিয়ে বাবার সাথে আলোচনা করবে, নয় তো নিজেই যে কোন ভাবে সুদ্ধির জন্য কিছু একটা করবে। এতবড় একটা সত্যকে সে অবহেলা করতে পারবে না। জয়িতা আরো ঠিক করলো সে সুদ্ধির ঘর থেকে আনা ছবি দুটি আবার ফিরিয়ে দিয়ে আসবে। কে জানে এই ছবি দুটিই হয় তো সুদ্ধির জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সব কিছু হারিয়ে এই ছবি দুটি নিয়েই হয় তো সে বেঁচে আছে। ছবি দুটো এভাবে চুরি করে নেওয়া তার ঠিক হচ্ছে না।

বিকেলে রিপা আর জয়িতা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিল। এদিকে রিপার মা জয়িতা আর রিপার জন্য ব্যাগ ভর্তি করে নিজেদের গাছের কলা আর পেয়ারা দিয়ে দিলেন। জয়িতার এগুলো নেওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই। তবুও রিপার মাকে খুশি করতে জয়িতা নিয়ে নিল।

জয়িতার মনে আবার আরেক উদ্বেগ দেখা দিল। জয়িতা ভাবছে আবার কি বাসষ্ট্যান্ডে সুদ্ধির সাথে তার দেখা হবে? যদি হয়? সে কি করবে? যদি কেউ সুদ্ধিকে তার সামনে মারতে আসে সে কি পারবে এর প্রতিবাদ করতে? সুদ্ধিকে সুদ্ধির ভাই মারলে এ গ্রামের কেউ প্রতিবাদ করে না। সে প্রতিবাদ করলে কেউ যদি জিগ্যেস করে কেন সে প্রতিবাদ করছে? সুদ্ধির সাথে তার কি সম্পর্ক? সে তখন কি বলবে? তবে কেন জানি সুদ্ধিকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তার। জয়িতা আশায় আশায় বাসষ্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে লাগলো যদি দেখা হয় সুদ্ধির সাথে। রিপার বাবাও এসেছেন ওদের সাথে। বাসষ্ট্যান্ড যাওয়ার পথে সুদ্ধির বাড়ি। বাড়ীটির সামনে এসে জয়িতা বললো, 'রিপা একটু দাড়া, ঘরটাতে আবার যাবো।' জয়িতার কথা শুনে রিপার বাবা অবাক।

'বল কি মা, ঐ ঘরে সুস্থ মানুষের যাওয়ার মতো অবস্থা নেই।'

'কি যে বল বাবা, জয়িতা এর মধ্যে ঐ প্রাসাদে ঘুরে এসেছে একবার'

'আঙ্কেল একটু অপেক্ষা করেন আমি এখনি ফিরে আসবো।'

ওরা বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। রিপার বাবা যারপরনাই অবাক হলেন। রিপা এমনভাব করলো যেন সে জানতো জয়িতা সুদ্ধির ঘরে যাবে। রিপার বাবা বললেন, 'ব্যাপারটা কি?'

'কিছুই না বাবা ও গেছে সুদ্ধির ঘরের ছবি তুলতে। সকালে তুলেছিল হয় তো মনমত হয় নি তাই আবার গেছে।'
রিপার বাবা আর কথা বাড়ালেন না। এদিকে জয়িতা ভেজানো দোর ঠেলে ঘরে ঢুকলো। ঘরটি ঠিক আগের মতোই আছে। সুদ্ধির বালিশের উপর জয়িতার রাখা শাড়িটিও সেভাবেই আছে। তার মানে সুদ্ধি এখনো ঘরে ফিরেনি। জয়িতা ছবি দুটো ঠিক আগের জায়গায় রেখে দিল। এর পর সে রেখে আসা শাড়িটিতে হাত বুলালো। মনে মনে ভাবলো তার হাতের স্পর্শ করা শাড়িটি তার মা পড়বে। ঠিক তখনই জয়িতার চোখ দিয়ে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা পানি ঝড়লো। জয়িতা মৃদু স্বরে বললো, 'আবার দেখা হবে মা। আমি তোমাকে সুস্থ করে তুলবোই' বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। 

ওরা দাঁড়িয়ে আছে বাসের অপেক্ষায়। কিন্তু জয়িতা দৃষ্টি রাস্তার অন্য ধারে এই বুঝি সুদ্ধি এসে পড়বে। কিন্তু না সুদ্ধি এলো না। এসে থামলো একটা সিএনজি আর সিএনজি থেকে বেড়িয়ে এলো সুদ্ধির ছোট ভাই। জয়িতাকে দেখেই লোকটি দাঁত বের করে হাসতে লাগলো। লোকটিকে দেখে জয়িতার প্রচন্ড রাগ হলো। তার মনে হচ্ছিল গিয়ে লোকটিকে জোড়ে এক চড় মারতে। 

ঠিক তখনই বাস এসে গেল। রিপার বাবা তাড়া দিলেন। রিপা আর জয়িতা বাসে উঠলো। আর বাস দ্রুত চলতে শুরু করলো ঢাকার দিকে।






জয়িতার বাড়ী ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা বাজলো। জয়িতা সারাদিনে বাবা-মা কাউকেই ফোন করে নি। সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় যে ভয় কাজ করছিল এখন তার আর ভয় করছে না। কাজের বুয়া দরজা খুলে দিল। বসার ঘরে বাবা টিভিতে খবর দেখছেন। মা রান্নাঘরে। জয়িতা শুনতে পেল দুইভাই নিজেদের ঘরে উচ্চস্বরে পড়া মুখস্ত করছে। জয়িতা কাউকে কিছু না বলে সোজা নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগলো। বাবা পেছন ফিরে জয়িতাকে জিগ্যেস করলেন,

'কেমন হলো শিক্ষা সফর?'

'ভালই হয়েছে। আমার খুব ক্লান্ত লাগছে বাবা। তোমার সাথে পরে কথা বলবো'

'ঠিক আছে যাও ফ্রেস হয়ে খেয়ে বিশ্রাম নাও।'

মেয়ের আসার শব্দ পেয়ে সুমিতা রান্নাঘর থেকে মেয়ের ঘরে গেলেন।

'কি রে সারাদিনে একটা খবর নেই, তোর বাবা আর আমি তো খুব চিন্তায় ছিলাম।'

মায়ের দিকে না তাকিয়েই জয়িতা উত্তর দিল, 'খুব ব্যস্ত ছিলাম, সময় পাই নি মা।'

'সারাদিন কেমন কাটলো?'

'ভালই। মা জান, আজ অনেক অজানা বিষয় জানতে পারলাম।'

'শিক্ষা সফর তো জানার জন্যই।'

'মা আমি আজ আর কিছু খাব না। খুব ক্লান্ত লাগছে। এখন আমি স্নান করে ঘুমাবো। প্লিজ মা কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে।'

'কিছু খাবি না বললেই হবে নাকি। সবে বাজে সাতটা। সেই সকাল পর্যন্ত খালি পেটে থাকবি কিভাবে? আমি এক গ্লাস দুধ এনে দিচ্ছি। কিছু না খেলি দুধটুকু খেয়ে ঘুমো।' বলেই মা উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেলেন। জয়িতা অনেকটা সময় নিয়ে স্নান করলো। ঘরে এসে দেখে মা দুধ নিয়ে চেয়ারে বসে আছেন। জয়িতাকে দেখেই মা বললেন, 'আয় আমি তোর চুলটা শুকিয়ে দেই। ভেজা চুলে ঘুমাতে নেই।'
জয়িতা কোন কথা না বলে মায়ের সামনে টুলটা নিয়ে বসলো।

'মা তুমি আমাকে অনেক ভালবাস তাই না?'

'তোর কি কোন সন্দেহ আছে?'

'আছে।'

'দশটা না পাঁচটা না আমার একটা মাত্র মেয়ে আর তাকে আমি ভালবাসবো না'

'আচ্ছা মা তোমার যদি আরো একটা মেয়ে থাকতো তাহলেও কি তুমি আমায় এমনি করে ভালবাসতে?'

সুমিতা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। জয়িতা বললো, 'তোমার সাথে একটু মজা করলাম মা।'

'মায়ের কাছে প্রত্যেকটি সন্তানই আদরের। আর বড় সন্তানটি একটু বেশী আদরের। আর তোর বাবা তো জয়িতা বলতে পাগল।'

'তুমি?'

'চুল শুকিয়ে গেছে। দুধটা খেয়ে নে।'

'তুমি যাও মা আমি খেয়ে নেব।'

'না আমার সামনে খেয়ে নে। আমি জানি আমি চলে গেলেই তুই না খেয়ে ঘুমিয়ে পরবি।'

জয়িতা লক্ষী মেয়ের মতো দুধটা খেয়ে নিয়ে বললো, 'মা, বাবাকে বলো আমি খুব ক্লান্ত কাল সকালে বাবার সাথে কথা বলবো।'

মা বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই জয়িতা আবার বললো, 'মা আমার ব্যাগে কিছু পেয়ারা আর কলা আছে নিয়ে যাও তো'

'পেয়ারা-কলা তুই কিনেছিস?'

'হ্যাঁ' 
মা ব্যাগ থেকে ফলগুলো নিয়ে বললেন, 'বেশ ফ্রেস তো! তোর বাবা খুব খুশি হবে এগুলো পেয়ে। কতটাকা নিল রে সবগুলো?'

'ঠিক মনে নেই মা। প্লিজ যাওয়ার সময় দরজাটা ভিজিয়ে যেও'

মা দরজা ভিজিয়ে চলে গেলেন। সুমিতাকে জয়িতার ঘর থেকে আসতে দেখে বাবা বললেন,  'জয়িতা
খেতে আসবে না?'

'না ওর খুব ক্লান্ত লাগছে। ও ঘুমিয়ে পড়েছে। কাল সকালে তোমার সাথে কথা বলবে।'

'সারা রাত না খেয়ে থাকবে?'

'দুধ খেয়েছে।'

'ঠিক আছে কাল সকালেই কথা বলবো।'  তিনি টিভিতে খবর দেখতে লাগলেন।

জয়িতার ঘুম এলো না। সে সারা রাত জেগে জেগে শুধু সুদ্ধির কথাই ভাবলো। সারাটা দিন যেন তার স্বপ্নের মতো কাটলো। কিভাবে বাস থেকে নামার পরেই সুদ্ধির সাথে দেখা হলো, কিভাবে সুদ্ধির ভাই সুদ্ধিকে মারলো, কিভাবে জয়িতা সুদ্ধির ঘরে তার বাবার আর তার নিজের ছবি আবিস্কার করলো সব তার একে একে মনে পড়তে লাগলো আর দুচোখ বেয়ে জলের ধারা বয়ে যেতে লাগলো। সুদ্ধিকে নিজের মা হিসেবে আবিস্কার করার পর এই প্রথম জয়িতা মনপ্রাণ উজার করে কাঁদছে। জয়িতা তার এই সতের বছরের জীবনে কখনো এত কেঁদেছে কি না মনে করতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতে ভোররাতে সে ঘুমিয়ে পড়লো। উঠলো সকাল সাড়ে ন'টায়। ফ্রেস হয়ে বাইরে এসে দেখে বাবা অফিসে চলে গেছেন। দুই ভাইও স্কুলে গেছে। মা রান্না ঘরে। জয়িতাকে দেখেই বললেন, 'তুই আরাম করে ঘুমোচ্ছিলি তাই আর ডাকিনি।'

'ভালই করেছো মা না ডেকে'

'কি খাবি?'

'চা দাও।'

'বেলা হয়ে গেছে আগে কিছু খেয়ে নে।'

জয়িতা খাবার টেবিলে গিয়ে বসলো। মা চা-নাস্তা নিয়ে এলেন। বললেন, 'আজ তো কলেজ ছুটি, বাইরে কোথাও যাবি নাকি?'

'হ্যাঁ রিপাদের হোষ্টেলে একটু যেতে হবে।'

মা জয়িতার চোখ মুখ খেয়াল করে বললেন, 'জয়িতা চোখমুখ এমন ফোলা কেন? রাতে ঘুম হয় নি?'

'কিছু না মা। অনেক বেলা অবধি ঘুমিয়েছি তো তাই হয় তো'

জয়িতা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো, 'আচ্ছা মা, তোমার কোন মানসিক রোগের ডাক্তারের সাথে
পরিচয় আছে?

'মানসিক রোগের ডাক্তার!'

'হ্যাঁ মানসিক রোগের ডাক্তার, সাইকোলজিষ্ট'

'কেন, কার জন্য?'

'আমার জন্য'

মা উত্তেজিত হয়ে বললেন, 'কেন তোর আবার কি হয়েছে?'

'আমার কিচ্ছু হয় নি। এমনেই জিজ্ঞেস করলাম'

'জয়িতা এধরনের প্রশ্নের মানে কি?'

'কেন পাগলকে কি ভয় পাও?'

'পাগলকে কে না ভয় পায়?'

'আমি ভয় পাই না। জান মা, এক পাগলের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। আমি তাকে সুস্থ করতে চাই।'

জয়িতার মা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, 'সে কে? তোর সাথে তার কোথায় দেখা হয়েছে?'

'ভয় পেলে মনে হয়। আমি জানতাম না তুমি পাগলকে এতটা ভয় পাও।'

'এসব কথার মানে কি জয়িতা?'

জয়িতা মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, 'কোন মানে নেই। তোমার সাথে একটু দুষ্টামী করলাম মা ।
আচ্ছা আর করবো না। মা আমি এখন বাইরে যাব।'

'কিছু তো খেলি না।'

'ক্ষিধে নেই মা।'

'কাল রাতেও তো কিছু খাস নি। কি হয়েছে তোর?'

'চিন্তা করো না মা। আমার কিচ্ছু হয় নি'

বলেই জয়িতা নিজের ঘরে চলে গেল। প্রস্তুত হয়ে ফিরে এসে মাকে বললো, 'মা আমি আজ দুপুরে খাব না আর আমার আসতে দেরি হতে পারে'

'কলেজ তো ছুটি। দুপুরে তাহলে কোথায় খাবি? বাইরের ভাজাপোড়া খাবার বেশী খাস না যেন'

'ওকে মা মনে থাকবে'

জয়িতা মানসিক রোগের ডাক্তার খুঁজার উদ্দেশ্যে বের হলো। কিন্তু কার কাছে যাওয়া যায়? সে রিক্সা নিয়ে ধানমন্ডির রাস্তার সমস্ত সাইন বোর্ডগুলো খেয়াল করতে লাগলো। 'সাইকোলজিষ্ট……'

জয়িতা ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো সময় প্রায় বারোটা। রিপা রাখী ওরা সবাই নিশ্চয় হোষ্টেলে। বাইরে কোথাও গেলে তাকে জানাতো। তবে সে রিপাদের হোষ্টেলে যাবে না। মাকে সে মিথ্যে বলেছে। গতকাল থেকে জয়িতা মিথ্যে বলা শুরু করেছে। মনে মনে জয়িতা হাসলো মিথ্যে বলে সে এক চিরন্তন সত্যকে আবিস্কার করেছে। আর এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে আরো কত দিন কত মিথ্যে বলতে হয় কে জানে?
ঠিক তখনই জয়িতার ফোনটি বেজে উঠলো। রিপার ফোন।

'হ্যালো'

'হ্যালো জয়িতা আমরা সবাই নিউ মার্কেটে যাচ্ছি। তুই কি যাবি আমাদের সাথে?'

'না তোরা যা আমার খুব ক্লান্ত লাগছে'

'গেলে খুব মজা হতো চলে আয় না প্লিজ। আমরা অপেক্ষা করছি'

'আমার একটা কাজ আছে। তোরা যা'

'ও জয়িতা একটা খবর আছে'

'কি? বল'

'তোর গল্পের নায়িকা মারা গেছে'

জয়িতা যেন আৎকে উঠলো 'কি?'

'সুদ্ধি, সুদ্ধি মনে নেই, আমাদের গ্রামের সেই পাগলিটা। তুই যাকে নিয়ে গল্প লিখবি বলেছিলি। সেই পাগলীটি মারা গেছে'

জয়িতার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার জিগ্যেস করলো, 'কি বললি? ওনার কি হয়েছে?'

'পাগলি মারা গেছে।'

'কখন? কিভাবে? '

'আমি ঠিক জানিনা। বাবা একটু আগে ফোন করেছিল। তখনই আমাকে বললো'

জয়িতা ফোনটা কেটে দিল। রিক্সা ছেড়ে একটা সিএনজি নিয়ে সোজা চলে গেল গুলিস্থান।








জয়িতা যখন শশীপুর বাসষ্ট্যান্ডে পৌঁছাল তখন ঘড়িতে বাজে বেলা চারটা। সকাল থেকে তেমন কিছু জয়িতার পেটে পড়েনি। তবুও সে ক্ষুধা অনুভব করছেনা। সারা রাস্তা সে শুধু ভাবছিল, কাল যাকে সুস্থ সবল দেখে গেল কি হলো এক রাতের মধ্যে? কেউ খুনটুন করে নি তো? রিপার বাবা বলছিলেন, অনেকেই তার মৃত্যু কামনা করে। তেমন কি কেউ করলো। অনেক জল্পনা কল্পনা আর দুশ্চিন্তা নিয়ে জয়িতা হাঁটতে শুরু করলো। প্রথমেই পড়লো সুদ্ধির বাড়ী। দরজা ভেজানো। জয়িতা ভেতরে উঁকি দিল। ঠিক আগের মতোই আছে ঘরটা। শুধু মেঝের জামাকাপরগুলো ঠাই নিয়েছে ছোট্ট খাটটিতে। ঘর ভর্তি ধুপ আর আগরবাতির গন্ধ। জয়িতা আগরবাতির গন্ধ সহ্য করতে পারে না। সে বাইরে এলো। কি করা যায় এখন? নিশ্চয়ই তার মাকে গির্জায় নেওয়া হয়েছে। সে গির্জা চেনে না। গতকাল রিপা তাকে কয়েকবার বলেছিল  গির্জা দেখাতে নিয়ে যাবে। কিন্তু সে আগ্রহ দেখায় নি। নিয়তির কি খেলা, গতকাল যেখানে জোর করেও কেউ জয়িতাকে নিতে পারে নি আজ নিজে যেচে সেখানে যেতে চাইছে। আশেপাশে কাউকে দেখাও যাচ্ছে না যে গির্জার রাস্তাটা বলে দিবে। জয়িতা ভাবলো সে রিপাদের বাড়ীতে যাবে। সে রিপাদের বাড়ীর দিকে হাঁটতে লাগলো। রিপাদের বাড়ীতেও কেউ নেই। ঘরে তালা ঝোলানো। জয়িতা উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশেও কাউকে দেখতে পেল না। সে রাস্তায় নেমে এলো। একটি লোক আসছে দেখে জয়িতা জিগ্যেস করলো,

'আঙ্কেল আমি নিখিল রোজারিওর বাড়ীতে এসেছি কিন্তু কাউকেই বাড়ীতে দেখছিনা। আপনি কি
নিখিল রোজারিওকে চিনেন?'

'হ্যাঁ চিনি। সম্ভবত উনারা সবাই গির্জায় গেছেন''

'গির্জায়'

'হ্যাঁ আমাদের গ্রামের একজন মহিলা আজ সকালে মারা গেছেন। এখন গির্জায়  তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চলছে। হয় তো উনারা সেখানেই গেছেন।'

তার মাকে সুদ্ধি পাগলি না বলে একজন মহিলা সম্বোধন করায় লোকটিকে জয়িতার ভাল লেগে গেল।
জয়িতা আবার ভাবলো কি জানি মারা গেছে বলেই হয় তো পাগলি বলছে না। মৃত ব্যক্তির প্রতি সম্মান আর কি।
লোকটি বললেন, 'আমিও  গির্জায় যাচ্ছি তুমি চাইলে আমার সাথে আসতে পার।'

যেন এই কথাটার অপেক্ষাই জয়িতা করছিল। সে বললো, 'ঠিক আছে চলুন আমি আপনার সাথে যাব।'

সারারাস্তা লোকটি তার দেরিতে গির্জায় যাওয়ার কারণ বিস্তারিত বর্ণনা করতে লাগলো তবে জয়িতার কানে সেসব পৌঁছাল বলে মনে হলো না। গির্জায়  আসতে বেশী সময় লাগলো না। জয়িতা রিপার বাবা মায়ের খোঁজ করলো না। সে সোজা গির্জার ভেতরে প্রবেশ করলো।  প্রার্থনা অনুষ্ঠান এখনো শুরু হয় নি। জয়িতা কফিনের কাছে গিয়ে দেখলো সত্যি তার মা সুন্দরী হাত দুটো জোর করে শুয়ে আছেন। তবে তার মাকে আজ দেখতে আর সুদ্ধি পাগলির মতো লাগছেনা। আজ তার মায়ের মুখে কোন কালো ছোপ ছোপ দাগ নেই। চুল পরিপাটি করে বাঁধা। 
অবাক করা বিষয় হচ্ছে জয়িতার দেওয়া লাল শাড়িটি তাকে পরানো হয়েছে, মাথায় কাপড় দেওয়াতে খুব সুন্দর লাগছিল তার মাকে। গতকাল জয়িতা তার মাকে যে শাড়িটি উপহার দিয়েছিল আজ তার মা সেই শাড়িটি পড়ে আছে আর কখনো ঐ শাড়িটি খুলবেনা। ঐ শাড়িতে আছে জয়িতার ভালবাসা। মায়ের প্রতি তার স্বীকৃতি। কিন্তু তার মা কি জানতেন এই শাড়ীটি জয়িতা তাকে দিয়েছিল? জয়িতার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগলো। জয়িতা মায়ের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিল।  প্রার্থনা অনুষ্ঠান শুরু হলো। জয়িতা সামনেই একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলো যেখান থেকে তার মাকে স্পষ্ট দেখা যায়।

জয়িতার মায়ের কফিনের কাছে একজন বয়স্ক মহিলা বসে ছিলেন তিনিও এসে জয়িতার পাশে এসে বসলেন। সারাক্ষণ জয়িতার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো। প্রার্থনা অনুষ্ঠান শেষে তার মাকে কবরস্থানে নেওয়া হলো। সেখানকার অনুষ্ঠানও শেষ হলো। সুদ্ধির জন্য কেউ কাঁদলো না। শুধু নিরবে কাঁদল জয়িতা, সুদ্ধির একমাত্র মেয়ে। সুদ্ধির পাশে বসা মহিলাটিও নিরবে জয়িতার সাথে একটু
কাঁদল বলে মনে হলো। তাছাড়া একটা পাগলির জন্য কে কাঁদবে বরং সবাই খুশিই হলো গ্রামের আবর্জনা দূর হলো। এখন আর কারো চিৎকার চেচামেচিতে গ্রামের মানুষ বিরক্ত হবে না। কেউ আর গ্রামের সৌন্দর্য নষ্ট করবে না। 

শেষ কৃত্যানুষ্ঠান শেষে জয়িতা আবার গির্জার ভেতরে গিয়ে বসলো। মনে মনে ভাবলো কি আজব মানুষের জীবন। তার মা যখন জন্ম নিল সেই ছোট্ট শিশুটিকে এই শশীপুর গির্জায় নিয়ে আসা হয়েছিল। তার মা খ্রীষ্টান সমাজের একজন সদস্য হলো। তার মায়ের বিয়েও হয়েছিল এই গির্জায়আবার মৃত্যু পর এই গির্জায়ই তাকে আনা হলো, সমাহিত করা হল। তার মা তো আর দশটা মেয়ের মতোই বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিল। সবার স্বপ্ন সত্যি হল কেবল তার মায়ের স্বপ্নটা সত্যি হলো না। স্বামী সন্তান নিয়ে তার মায়ের ঘর করা হলো না। 

এই জন্য কে দায়ী? তার বাবা? তার দাদা? তার নানা? নাকি এই সভ্য সমাজ, সমাজ ব্যবস্থা? নাকি সবাই মিলে এই জন্য দায়ী। জয়িতা কার কাছে তার মায়ের জন্য বিচার চাইবে?  অঝোরে জল পড়তে লাগলো জয়িতার দুচোখ বেয়ে।

সবাই বাড়ী চলে গেছে। জয়িতা দোকানে গিয়ে মোমবাতি আর আগরবাতি কিনে মায়ের কবরে জ্বালালো। সেখানেই সে সিদ্ধান্ত নিল তার মায়ের ঘরে থাকা ছবি দুটো সে নিয়ে যাবে। এখানে এখন আর ছবি দুটোর কোন দরকার নেই । জয়িতা রওনা হলো তার মায়ের ঘরে যাবে বলে। এরই মধ্যে গির্জায় রিপার বাবার সাথে তার দেখা হয়েছে। রিপার বাবা অনেকটা অবাকই হয়েছেন জয়িতাকে দেখে তবে জয়িতা স্বাভাবিক ছিল। কে কি মনে করলো এখন এসব নিয়ে জয়িতা আর চিন্তা করে না।









সুদ্ধির ঘরটা আগের মতোই ভেজানো। জয়িতা ঘরে ঢুকে যেখানে সে গতকাল ছবিগুলো রেখেছিল সেখানে হাত বাড়াল। আশ্চর্য ছবিগুলো সেখানে নেই। জয়িতা আবারও ভাল করে খুঁজতে লাগলো কিন্তু না, সে ছবিগুলো পেল না। কোথায় যাবে, কে নেবে ছবিগুলো?

ঠিক তখনই কেউ একজন দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। জয়িতা চেয়ে দেখে সেই মহিলাটি যিনি গির্জায় তার পাশে বসেছিলেন। মহিলাটি ঘরে ঢুকেই বললেন, 'তুমি কি কিছু খুঁজছ?'

'আপনি?'

মহিলাটি ছবিগুলো জয়িতার সামনে মেলে ধরে বললেন, 'এই নাও, তুমি তো এইগুলো নিতেই এসেছো
তাই না?'

জয়িতা অবাক হলো। 'আপনি জানলেন কিভাবে?'
'
আমার সুদ্ধি আমাকে বলে গেছে, তুমি আসবে।'

জয়িতা ছবিগুলো হাতে নিল।

'তোমার নাম তো পরী তাই না।'

'আমার নাম জয়িতা'

'এখন তোমাকে সবাই জয়িতা ডাকে কিন্তু সুদ্ধি আদর করে তোমার নাম দিয়েছিল পরী। তুমি দেখতে ঠিক আমার সুদ্ধির মতোই সুন্দরী হয়েছো। ঠিক যেন পরী'

'আপনি কি সরিপিসি?'

'আমার নাম স্বরসতী রানী কিন্তু সবাই আমাকে ডাকে সরিপিসি বলে।'

''আমি আপনাকেই খুঁজছিলাম'

'সুদ্ধির শেষ ইচ্ছা ছিল তোমাকে শুধু একবার চোখে দেখার। ওর শেষ ইচ্ছা পূরণ হলো আর ও এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিল।'

'পিসি আমি আমার মা সম্পর্কে জানতে চাই'

'পাগলিকে মা বলছো যে লজ্জা লাগছে না?'
'
'না। আমার লজ্জা লাগছেনা। উনিই তো আমাকে এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন। আপনি আমাকে মায়ের সব কথা বলবেন কি?'

এ সময় জয়িতার ফোন বেজে উঠলো। জয়িতার মা ফোন করেছেন। জয়িতা ফোন রিসিভ করে মাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললো, 'মা আমি একটা জরুরী কাজে আটকা পড়েছি। আমার আসতে দেরী হবে চিন্তা করো না।' বলেই ফোনটা কেটে দিল।

তোমার মা বুঝি ফোন করেছিলেন?''

'পিসি মায়ের কথা বলবেন না?'

'বলবো, তোমাকে সব কথা বলবো কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে গেছে যে তুমি বাড়ী ফিরবে কিভাবে?'

'সে দেখা যাবে আপনি বলুন কিভাবে আমার মায়ের এই অবস্থা হলো?'

সরিপিসি চৌকির উপর রাখা কাপড়গুলো ঠেলে জায়গা করে বসলেন। জয়িতাও গিয়ে তার পাশে বসলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সরিপিসি শুরু করলেন, 'তোমার বাবা একটি মেয়েকে ভালবাসতেন। তোমার দাদুর ঘোর অমত ছিল সেই মেয়েকে বউ করার কারণ মেয়েটি ছিল গরিব ঘরের আর তোমার দাদুরা তো
ছিল বিরাট ধনী। রংয়ের বড় ব্যবস্যা ছিল তাদের। তোমার দাদু শখ করে ঘোড়া পালতেন। এক কথার মানুষ ছিলেন তোমার দাদু। এলাকায় তার সে কি দাপট ছিল। তার মুখের উপর কেউ কথা বলবে এমন লোক ছিল না। তোমার বাবা ছিলেন বাড়ীর বড় ছেলে। তাকে অনেকটা জোর করে সুদ্ধির সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন তোমার দাদু। তুমি যখন সুদ্ধির পেটে তখন তোমার নানা আমাকে তোমার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন চিটাগাংয়ে। আমি গিয়ে টের পেলাম তোমার বাবা খুবই অসুখী একজন মানুষ। সুদ্ধির সাথে সে যথা সম্ভব ভাল ব্যবহার করলেও কথা বলতেন মেপে মেপে। স্বামী হিসেবে কোন রকম দায়িত্বের অবহেলা করতেন না। তবে বাড়ীর আর কারো সাথে তিনি কথা বলতেন না। না তোমার দাদুর সাথে, না তোমার দাদীর সাথে। বিষয়টা আমার চোখে পড়ল। আমি বাড়ীর কাজের লোকদের সাথে ভাব জমালাম বিষয়টা জানার জন্য। জানই তো বাড়ীর কাজের লোকেরা অনেক গোপন খবর জানে যা বাড়ীর অনেক সদস্যরাও জানে না। আমি জানতে পারলাম তোমার বাবা যাকে ভালবাসেন তার সাথে খুব ছোটবেলা থেকেই ভাব-ভালবাসা। ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করার ভয় দেখিয়ে সুদ্ধিকে বিয়ে করার জন্য চাপ দেন তোমার দাদু। আমি এসব কথা সুদ্ধিকে জানতে দেই নি। কারণ তোমার বাবাই ছিল সুদ্ধির জীবনের প্রথম পুরুষ, প্রথম ভালবাসা। 

সুদ্ধির প্রতি কোন অমর্যাদা-অবহেলা না করলেও সুদ্ধিকে কোন দিন ভালবাসতে পারেন নি তোমার বাবা। তোমার বাবা যে অসুখী বিষয়টি সুদ্ধিও আস্ত আস্তে বুঝতে পারে। এর পর থেকেই সুদ্ধি কেমন জানি বিষ্মন্ন হয়ে যেতে থাকলো। আমি তোমার বাবাকে বললাম একজন ভাল ডাক্তার দেখাতে। তোমার বাবা বললেন আমি যেন সুদ্ধিকে নিয়ে শশীপুর চলে আসি। এ সময় বাবার বাড়ীতে থাকলে সুদ্ধি নাকি ভাল থাকবে। তবে তোমার দাদু এতে রাজী হলেন না। বাড়ীর প্রথম বংশধর নানার বাড়ীতে জন্ম নেবে সেটা তিনি ভাল চোখে দেখলেন না। নিজের মান-মর্যাদা বলে কথা। তিনি সুদ্ধিকে আসতে দিলেন না। তোমার বাবা সুদ্ধিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার বললেন সুদ্ধিকে হাসি খুশি রাখতে হবে সব সময়। কিন্তু কে সুদ্ধিকে হাসি খুশি রাখবে? তোমার বাবা তো নিজেই হাসতে ভুলে গিয়েছিলেন।সে আর কি হাসাবে। আমি অনেক চেষ্টা করতাম সুদ্ধিকে খুশি রাখতে। কিন্তু একটা অল্পবয়স্ক সন্তান সম্ভবা নারী কি চায় সেটা তো আর আমি দিতে পারতাম না। আর সেটারই বড় অভাব দেখা দিল সুদ্ধির জীবনে। এরই মধ্যে তোমার বাবা যে অন্য কোন মেয়েকে ভালবাসতেন আর সুদ্ধির সাথে বিয়েতে তোমার বাবার অমত ছিল সেই বিষয়টাও সুদ্ধি জেনে গেল। বিষয়টি সুদ্ধির মেনে নিতে কষ্ট হল। শুধু কষ্ট বললে ভুল হবে ভিষণ কষ্ট। সুদ্ধি আমাকে সব বলতো না। আমি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ওকে জিগ্যেস করতাম, বলতে পার ওকে আমি মিছে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করতাম।

এরপর তোমার জন্ম হল। আমার নানা গেলেন নাতনীসহ মেয়েকে আনতে। তোমার দাদু আসতে দিলেন না। পাছে তোমার মায়ের অনুপস্থিতিতে তোমার বাবা আবার ঐ মেয়ের পেছনে ছুটে এজন্য। তোমার মা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ল। খাওয়া নেই নাওয়া নেই। একদম চুপচাপ হয়ে গেল। যেই মেয়েটি হইচই করে সারা বাড়ী মাতিয়ে রাখতো সেই মেয়েটি আর প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলতো না। সুদ্ধির মানসিক এই পরিবর্তনের কারণে তোমার প্রতিও অবহেলা শুরু হল। মাঝে মাঝে এমন হতো যে, তুমি ক্ষুধায় কাঁদলেও তোমার মায়ের কানে যেন সে কাঁদলেও পৌঁছাতনা। তখন আমি তোমার দায়িত্ব নিলাম। তোমার যখন ছয় মাস আমি অনেকটা জোর করে তোমাকে আর তোমার মাকে শশীপুর নিয়ে এলাম। তোমার দাদু তো আমার উপর বেজায় রাগ করলেন। আমি ভাবলাম এখানে এলে তোমার নানা-নানীর আদর-যত্নে আর ডাক্তারের পরামর্শে আমার সুদ্ধি ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু হলো তার উল্টো। তোমার নানা তোমার মাকে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে নিয়ে গেলেন ফকিরের কাছে।

মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরা আমার মেয়েটা হয়ে গেল একেবারে বদ্ধ পাগল। মাঝে মাঝে সুদ্ধির এই অবস্থার জন্য আমার নিজেকেই দায়ী মনে হয়। মনে হয় আমি যদি জোর করে ওকে এখানে না নিয়ে আসতাম তবে মেয়েটার এই অবস্থা হতো না।'

এটুকু থেমে সরিপিসি চোখ মুছে আবার বললেন, 'তোমার বাবার একটুখানি ভালবাসার কাঙ্গাল ছিল সুদ্ধি। কিন্তু তোমার বাবারই বা দোষ দেব কি করে? ভালবাসা তো আর জোর করে হয় না।'

জয়িতা সরিপিসির হাত দুটো চেপে ধরলো। জয়িতার চোখ দিয়েও জল পড়তে লাগলো। অন্ধকার ঘরে দুজন মানুষ নিরবে কাঁদতে লাগলো। শশীপুরের কেউ জানলো না, কেউ দেখলো না সে কান্না, সে
কষ্ট। কতক্ষণ এভাবে চললো বলা যাবে না। তবে নিরবতা ভেঙ্গে সরিপিসি বললেন, 'অন্ধকার হয়ে
গেছে। তুমি বাড়ী যাবে না?'

'আমি আরো কিছু জানতে চাই পিসি।'

'এই ঘরে কোন আলো নেই। আলোর ব্যবস্থাও করা যাবে না।'

'আপনি কি আমাকে আপনার বাড়িতে নিয়ে যাবেন?'

'আমার আবার বাড়ী, আমি থাকি আমার এক ভাইপোর বাড়ীতে। তুমি যাবে আমার সাথে?'

'আমি আপনার সাথে গেলে কি কোন অসুবিধা হবে?'

'না না অসুবিধা হবে না কিন্তু তুমি বাড়ী ফিরবে না?'

'না, আমি আজ আপনার সাথে থাকবো।'

'আমাদের মতো গরিবের বাড়ীতে থাকতে তোমার অসুবিধা হবে।'

কথা বলতে বলতে দুজনে সুদ্ধির ঘর থেকে বেড়িয়ে সরিপিসির বাড়ির দিকে রওনা দিলো। জয়িতা
সরিপিসির হাত ধরে হাঁটতে লাগলো।





১০


জয়িতা সরিপিসির ঘরটা যেমন হবে ভেবেছিল সে রকম নয়। আধাপাকা দালান বাড়ীর উপরে টিনের চাল। দুটো ঘর, সামনে পেছনে বারান্দা, দুই বারান্দায় আবার একটা করে কেবিন ঘর। বড় দুই ঘরের একটাতে সরিপিসি থাকেন। সরিপিসির ঘরটা বেশ গোছানো। একটা খাট, একটা কাপড়ের আলনা, একটা টেবিল ও চেয়ার আছে। পিসি জয়িতাকে চেয়ারটাতে বসিয়ে বাইরে গেলেন। একটু পরই ফিরে এলেন সাথে একজন মহিলা। মহিলাটির হাতে সরবতের গ্লাস। জয়িতার হাতে গ্লাসটি দিয়ে মহিলাটি সহজভাবে জয়িতার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন যেন জয়িতা তার অনেক দিনের চেনা।

'মা তুমি নাকি আজ আমাদের বাড়ীতে থাকবে?'

জয়িতা লজ্জা পেল। অপরিচিত একটি বাড়ীতে যেচে থাকতে এসেছে সে। এ বাড়ীর কাউকেই সে চেনে না। এমনকি সরিপিসির সাথেও তার পরিচয় মাত্র কয়েক ঘন্টার। তবে সরিপিসিকে তার কেন জানি হাজার বছরের কাছের একজন মানুষ বলে মনে হয়েছে।

'দেখেছেনে পিসি মেয়ে আমাদের লজ্জা পেয়েছে। মা বলতো রাতে কি খাবে?'

'না না আমার জন্য কোন আয়োজন করতে হবে না।'

'না বললেই হলো? তুমি আমাদের পিসির আত্মীয়। তোমার জন্য তো আয়োজন করতেই হবে।'

জয়িতা চুপ করে রইলো। সরিপিসি মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, 'বউ মেয়েটি অনেক ক্লান্ত, তুমি বরং ওকে একটু হাতমুখ ধোয়ার জল দাও।'

'ঠিক আছে পিসি' বলেই মহিলাটি চলে গেল।

পিসি বললেন, 'আমার ভাইপোর বউ। খুব ভাল মেয়ে। আমার খুব যত্ন আত্নি করে।'

'পিসি উনি কি জানেন আমি কে?'

'তুমি কে এই কথা শশীপুরের কেউ জানে না। একজন শুধু জানতো আর সেতো আমাদের ছেড়ে চলেই গেছে। তবে এই বৌটি খুবই বুদ্ধিমতি। অনেক কিছুই আন্দাজ করতে পারে।'

মহিলাটি বাইরে থেকে উচ্চ স্বরে বললেন, 'পিসি মেহমানকে পাঠিয়ে দাও জল তৈরি আছে।'

'যাও দিদি হাতমুখটা ধুয়ে নাও'

জয়িতা হাতমুখ ধুতে বাইরে গেল। মহিলাটি ধোয়া ভাঁজকরা একটা তোয়ালে, সাবান আর এক সেট  সালোয়ার কামিজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জয়িতাকে বললো, 'নতুন সালোয়ার কামিজ। দেখ ভাঁজই খোলা হয় ‍নি। আমি এসব পড়ি না। কিন্তু তোমার মামা আমাকে গতবার পূজার সময় দিয়েছিলেন। এসব পড়তে আমার এখন লজ্জা লাগে।'

জয়িতা কোন কথা না বলে মুচকী হেসে মহিলাটির হাত থেকে জিনিসগুলো নিল। মহিলাটি আবার বললো, 'যথেষ্ট জল আছে চাইলে স্নানটাও সেরে ফেলতে পারবে।'

কেন জানি এ বাড়ীর সবাইকেই জয়িতার খুব কাছের মানুষ বলে মনে হতে লাগলো। জয়িতা বাথরুমে
গিয়ে ঠান্ডা পানি দিয়ে স্নান করলো। ঘরে এসে দেখলো সরিপিসি ভাত খাচ্ছেন।

'বয়স হয়েছে তো তাই সন্ধ্যা রাতেই ভাত খেয়ে নেই। আজ ভেবেছিলাম তোমার সাথেই খাব। কিন্তু
বউ অনেক রাতে খেতে মানা করলো। এতে নাকী শরীরের ক্ষতি হয়।'

'না না অসুবিধা নেই আপনি খেয়ে নিন।'

সরিপিসি দুধ কলা দিয়ে ভাত খেল। হাত মুছতে মুছতে বললো, 'আগে পান খেতাম। এই বউটি আমাকে
পান খেতে দেয় না। বলে এতে নাকী অসুখ বিসুখ বেশী হয়।' বলেই তিনি খাটে এসে বসলেন।

এই বাড়ীতে আর কে থাকে পিসি?'

'আমরা দুজন আর একজন ঝি আছে।'

'কোন ছেলেমেয়ে?'

'হ্যাঁ ভাইপোর এক ছেলে আছে। ঢাকা কলেজে পড়ে। আর ভাইপো তো থাকে সৌদি আরবে। তোমার
ফোনটা কিন্তু কয়েকবার বেজেছিল। তোমার বাবা মা হয়তো চিন্তা করছেন।'

জয়িতা দেখলো অনেকগুলো মিসড কল। সে তার বাবাকে ফোন দিল। জয়িতার কন্ঠে কোন ভয় বা
উৎকন্ঠা নেই। ফোন ধরেছেন বাবা।

'হ্যালো বাবা আমি আজ রাতে বাড়ী ফিরবো না।'

'কি? কি বলছো এসব? তুমি এখন কোথায়?'

জয়িতা শান্তস্বরে বললো, 'বাবা টেনশন করো না তো। আমি কাল সকালে বাড়ী এসে তোমাকে সব
বললো।'

'আমি জানতে চাচ্ছি তুমি এখন কোথায়? আর ফোন ধরছো না কেন?'

'বললাম তো খুব ব্যস্ত আছি।'

'আমি কি জানতে পারি তুমি এখন কোথায়?'

জয়িতা ফোন কেটে দিয়ে সুইচ অফ করে দিল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সরিপিসির হাত ধরে বললো,
'পিসি আমার মায়ের কথা শুনবো।'

'আচ্ছা পরী তুমি কিভাবে এত বছর পরে তোমার মায়ের খোঁজ পেল'

'আমি তো খুঁজে পাই নি। মা-ই আমাকে খুঁজে নিয়েছিল পিসি'

'তোমাকে দেখার পর আমার সুদ্ধি যে কি খুশি হয়েছিল। কেউ তার খুশি বুঝতে পারে নি। আমি শুধু
বুঝেছিলাম আমার সুদ্ধি অনেকদিন পর অনেক খুশি হয়েছে কিন্তু কেন সে এত্ত খুশি সেটা বুঝতে
পারিনি।'

'মা কি আপনার সাথে অনেক কথা বলতো পিসি?'

'অনেক কিছুই সে আমাকে বলতো কিন্তু সে তো গুছিয়ে কিছু বলতে পারতো না। বুঝে নিতে হতো।
শেষে তো ওর ভাষাটাও যেন কেমন হয়ে গেল। কাল ও অনেক কথা বলেছিল। কিছু একটা ঘটেছে
বুঝেছিলাম তবে তোমার সাথে যে ওর দেখা হয়েছে সেটা বুঝতে পারি নি।'

সরিপিরি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলতে শুরু করে-

সুদ্ধি প্রতিদিন ভোরে একবার করে আমার কাছে আসতো। এসেই বলতো, 'পিসি উঠছো নি।'

কোন কোন দিন নিজ থেকে চা খেতে চাইতো আবার কোন দিন ডাকলেও খেত না। তাছাড়াও সময় অসময় সুদ্ধি আমার বাড়ীতে আসতো। তবে বেশী আসতো কোন কারণে খুশি হলে কিংবা দুtখ পেলে।গতকাল প্রতিদিনের মতো ভোরে একবার এসেছিল। আবার এসেছিল সকাল এই ধরো দশটা হবে। সুদ্ধি এসেই বারান্দাতে বসলো। পিসি ও পিসি ডাকতে লাগলো। আমি ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। দেখলাম সুদ্ধি হাসছে। প্রাণ খুলে হাসছে।

'কি হয়েছে রে মা? হাসছিস কেন?'

'ও আইছে ও আইছে পিসি'

'কে আইছে?'

'ঐ যে মেয়ে'

'কার মেয়ে?'

'আমার মেয়ে' বলেই সে কি যে তার হাসি। আমি ভাবলাম পাগলি মানুষ কি বলে তার কি ঠিক আছে।
আমি পাত্তা দিলাম না। বললাম, 'সকালে খাইছস কিছু?'

'খামু না খামু না। আমি যামু গা'

'কই যাবি?'

'চইল্যা যামু'

'কই যাবি বলবি তো'

'আর আহুম না পিসি দেখছি তো। অনেক সুন্দর। যামু গা' বলেই হাসতে হাসতে চলে গেল।

জয়িতার চোখ দিয়ে আবার জল পড়তে লাগলো। সরিপিসি বললেন, আমি ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝলাম না। রাত এগারটার সময় আবার সুদ্ধি এসে হাজির। আমি তখন ঘুমিয়ে গেছি। বাইরে এসে আবারও পিসি পিসি করে ডাকছিল। আমাদের বাড়ীতে রাত বিরাত সুদ্ধির আসাটা নতুন নয়। রাতে কোন কারণে ঘুম না হলে সুদ্ধি রাতবিরাতে এই বাড়ীতে এসে পড়তো। এসে পিসি পিসি করে কতক্ষণ ডেকে বারান্দায় বসে থেকে চলে যেত। তবে গতকাল আর গেল না। প্রায় ঘন্টা খানেক ডাকাডাকি করলে বউ গিয়ে দরজা খুলে দিল। সুদ্ধি বউকে ঠেলে আমার ঘরে এসে আমাকে জাগিয়ে তুললো।

'উঠ পিসি শিগগির উঠ'

'এত রাতে তুই? কি হইছে?'

'পিসি যামু গা। পিসি নখ কাইটা দে। বড় হইছে। দে না।'

'আমি তো চোখে ভাল দেখি না। এত রাতে তুই আইছস নখ কাটতে?'

'বউরে ক তাইলে'

আমি সুদ্ধির সাথে রাগ করলাম। বললাম, 'এত রাতে তরে কেউ নখ কেটে দিব? এখন বাড়ীতে যা। কাল সকালে আসবি। আমি বউরে বলবো নে। সে তোরে সুন্দর করে নখ কেটে দিব। যা মা যা বাড়ী যা।'

'না পিসি দে অহন দে। কাল যামু গা।'

বউ দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছিল। আমি বউকে বললাম, 'ও বউ দেও তো ওর নখ গুলি কেটে। তা
না হলে আজ রাতে ও আর আমাদের ঘুমাতে দিবে না'

বউ একটা নেলকাটার এনে আমাকে দিয়ে বললো, 'পিসি আমার ভয় লাগে তুমি দেও।'

'আমি কি চোখে দেখি বউ?'

অনেক ভয়ে ভয়ে বউই দিল ওর নখ কেটে। এরপর সুদ্ধি পলিথিনের ব্যাগ থেকে একটা নতুন লাল শাড়ি বের করে আমাকে বললো, 'পিসি এইটা আমাকে পড়াইয়া দে'
আমি বললাম, 'এই এত রাতে তুই শাড়ি পড়ে কই যাবি? কোথায় পেয়েছিস এই শাড়ি?'

'ও দিছে। কইছিনা আইছে। দে পড়াইয়া দে পিসি'

বউ সুদ্ধিকে বললো, 'দিদি কাল সকালে আইসেন। আমি আপনেরে সুন্দর করে পড়াইয়া দিবোনে।'
এরপর সুদ্ধি ঐ ছবিদুটি আমার হাতে দিয়ে বললো, 'পিসি ওরে দিস'

আমি রাতে চোখে ভাল দেখি না। বললাম, 'কার ছবি?'

'পিসি ও আবার আসবো ওরে দিবি।'

'কার কথা কস তুই? কে আসবো এগুলা নিতে?'

সকালে সুদ্ধির চোখে মুখে যে খুশি দেখেছিলাম, রাতে আর সে খুশি দেখলাম না। সুদ্ধি খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো, 'আইবো নিরার। তুই দিবি। পিসি এহন একটা সাবান দে।'

'এই রাতের বেলায় সাবান দিয়ে কি করবি?'

'দে পিসি, স্নান করন লাগবো'

আমার মনটা ভিষন খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম সুদ্ধির মাথাটা একেবারেই গেছে। আগে যা-ও একটু
ভাল ছিল এখন তো দেখছি একেবারে বদ্ধ উন্মাদ। আমি বললাম, 'মা রে এই রাতে সাবান কই আছে কে জানে। কাল সকালে আসিস। আমি তোরে একটা বাসনা সাবান দিবোনে।'

ও রেগে গেল। বললো, 'অহন দে। সময় নাই'

'অহন যা তো তুই। বউ কিন্তু রাগ করবো।'

আমার কাছে আবদার করে না পেয়ে ও বউকে বললো, 'বউ রাগ করিস না, দে একটা সাবান দে।'

কোন কিছু সুদ্ধির মনের মতো না হলেই সে চিৎকার চেচামিচি করতো। এই রাত বিরাতে চেঁচাতে শুরু করলে গ্রামের সবাই ওর উপর ক্ষেপে যাবে। তাই বউ সুদ্ধিকে একটা সাবান দিল। সুদ্ধি সাবান আর শাড়িটি নিয়ে চলে গেল। তবে কেন জানি আমার সারা রাতে আর ঘুম এলো না। প্রত্যেকদিন ভোরে সুদ্ধি একবার করে আমাদের বাড়ীতে আসে আজ সকালে এলো না। ভাবলাম গতকাল অনেক রাতে ঘুমিয়েছে তাই হয় তো আসে নি। অনেক বেলা হলো তাও সুদ্ধি এলো না। গতকাল রাতে কি সব বলছিল কোথায় জানি যাবে। আবার হাতের নখ কাটলো, স্নান করবে বলে সাবান নিল, কোথায়ও যায় নি তো? হঠাৎ আমার ছবিগুলোর কথা মনে পড়লো। আমি বালিশের নিচে রাখা ছবিগুলো দেখলাম।  আমি তো অবাক এই ছবি এতদিন পর? কাল সুদ্ধি কাকে দেখেছিল? সুদ্ধি কাকে এই ছবিগুলো দিতে বললো? আমার কেমন জানি সন্দেহ হলো। তক্ষুনি আমি সুদ্ধিকে দেখতে ওর বাড়ী গেলাম। সুদ্ধির ঘরের দরজা ভেজানো। ভেতরে গিয়ে দেখি খাটে ঘুমিয়ে আছে। মনে মনে রাগ করলাম। কতদিন ওকে বলেছি রাতে শোয়ার আগে ঘরের দরজাটা বন্ধ রাখতে কিন্তু ও খোলা করেই ঘুমিয়েছে। কাছে গিয়ে দেখি লাল শাড়িটি সারা শরীরে জড়িয়ে আছে। আমি সুদ্ধি বলে ধাক্কা দিতেই ওর হাতটা নেতিয়ে পড়লো। আমি কয়েকবার ধাক্কা দিলাম সুদ্ধির কোন সারা শব্দ নেই। আমি বাইরে এসে পাশের দোকানদারকে ডাকলাম। উনিও এসে ডাকলেন সুদ্ধি উঠলো না। আমার আগেই আমার সুদ্ধি এই দুনিয়া থেকে চলে গেল।

 পিসি কাঁদতে লাগলেন। চোখ মুছে আবার শুরু করলেন-

'তোমাকে গির্জায় দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি সুদ্ধি কার আসার কথা বলেছিল'

'পিসি মায়ের কি কোন অসুখ ছিল?'

'কি জানি। মাঝে মাঝে বলতো মাথা ব্যাথা। আমি কতবার বলেছি চল তোকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই ও বলতো যাবে। তবে সেদিন আর এমুখো হতো না'

'তাহলে হঠাৎ মা কিভাবে মারা গেল পিসি?'

'ওর তো আসল মরণ হয়েছিল সেই সতের বছর আগেই। শুধু তোমাকে এক নজর দেখার জন্যই বেঁচে ছিল। ঐ যে বললাম গতকাল বারেবারে বলছিল ও চলে যাবে। ওর যা দেখার ও তাই দেখেছে। এখন ওর যেতে কোন অসুবিধা নেই। এসব বলার অর্থ কি দিদি ভাই?'

জয়িতা নিবরে কাঁদতে লাগলো।

সরিপিসি আবার শুরু করলেন, সুদ্ধি নখ কাটলো, স্নান করবে বলে সাবান নিয়ে গেল আমাকে বললো যেন তোমার দেওয়া শাড়িটি ওকে পড়িয়ে দেই। আবার তোমাকে ছবিগুলো দেওয়ার জন্য আমার হাতে দিয়ে গেল। এটা কি স্বেচ্ছা মরণ নয়? তোমাকে এক নজর দেখার জন্যই আমার সুদ্ধি বেঁচে ছিল। আমার পাগলী মেয়েটার সাধ পূরণ হয়েছ।'

পিসি, আমার ছ'মাস বয়সে মা যখন শশীপুর চলে এসে অসুস্থ হয় তখন চট্টগ্রাম থেকে কেউ কি মায়ের খবর নেয় নি?'

'না কেউ নেয় নি। তোমার মায়ের অসুস্থতার খবর তারা পেয়েছিলেন। একদিন তোমার দাদু আর দাদী এসে তোমাকে নিয়ে গেলেন তবে সুদ্ধির সাথে তাদের দেখা হলো না। তোমাকে হারিয়ে সুদ্ধি আরো বেশী অসহায় হয়ে পড়েছিল। একা একা কি যেন ভাবতো আর বিড়বিড় করে কি যেন বলতো। আস্তে আস্তে তো একেবারে বদ্ধ পাগলই হয়ে গেল।'

'আর আমার বাবা?'

তোমাকে নিয়ে যাওয়ার বছর খানেক পর তোমার আর তোমার বাবার খবর জানার জন্য মাতব্বর আমাকে পাঠিয়েছিলেন চট্টগ্রামে। আমি সরাসরি তোমার দাদুর বাড়ীতে যেতে পারি নি। কারণ
তোমার দাদুর অমতে আমি তোমাকে আর তোমার মাকে জোর করে শশীপুর নিয়ে এসেছিলাম সেই অপরাধে। তোমার দাদুর বাড়ীর এক কাজের মেয়ে ছিল কি যেন নাম মালতি, মালতি আমাকে মাসী ডাকতো। আমি যখন তোমার দাদুর বাড়ীতে থাকতাম তখন আমার সাথে খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল মেয়েটির। মালতির কাছে শুনলাম তোমার বাবা তোমার দাদুর অমতে সেই মেয়েটিকে বিয়ে করে বাড়ী ছেড়েছেন। তবে যাবার সময় তোমাকে সাথে নিয়ে গেছেন। তোমার দাদু তোমার বাবাকে নাকী ত্যাজ্য পুত্র করেছেন। অনেক কষ্ট হয়েছিল সেদিন। আমি ফিরে এলে সুদ্ধি বার বার তোমার আর তোমার বাবার কথা জিগ্যেস  করছিল। বলেছিলাম তুমি ভাল আছ তবে তোমার বাবার বিয়ের কথা তাকে আমি আর জানাই নি।

তবে আশ্চর্য কি জান দিদিভাই! তোমার মা অনেক কিছু অনুমান করতে পারতো। কেমন গম্ভীর হয়ে আমাকে বললো,

'পিসি জামাই বিয়ে করছে নারে?' 

আমি বললাম, 'কোন জামাই?'

'আমি জানি পিসি।'                    

আমি তো অবাক। সুদ্ধিকে কে জানালো এই খবর। আমি বললাম, 'কে বলেছে তোকে এসব?'
সুদ্ধি কোন কথা বললো না। কেমন গম্ভীর হয়ে কোথায় জানি চলে গেল। আমি তখন মাতব্বর বাড়ীতেই থাকতাম। সারা গ্রাম, বনে জঙ্গলে সুদ্ধিকে খুঁজলা কোথাও পেলাম না। বাড়ী ফিরে এলো দুই দিন পর। তখন আমি ভেবেছিলাম কেউ হয় তো ওকে বলেছে। তবে গতকাল যা ঘটলো তাতে আমি নিশ্চিত সুদ্ধি অনেক কিছু অনুমান করতে পারতো।

তুমি যে আসবে ও জানতো, তাই বাসষ্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। শাড়িটি যে তুমি দিয়েছিলে তাও জানতো। তুমি তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে আসবে সে তাও জানতো বলেই তোমাকে ছবিগুলো দেওয়ার জন্য আমাকে বলে গেল। কিভাবে এসব হলো দিদি ভাই? 

'আমিও অবাক হচ্ছি পিসি। কি করে মা আমাকে এতদিন পর দেখেও ঠিক চিনতে পেরেছিলেন।'

তখনই পিসির ভাইপোর বউ পরমা খাবার জন্য জয়িতাকে ডাকতে এল। 
 


১১


জয়িতা খাবার আয়োজন দেখে তো অবাক। পোলাও-কোরমা, ডিম, মাছ, মাংস, সালাদ সব কিছুরই আয়োজন হয়েছে। জয়িতার খুব খিদে পেয়েছিল। তবে খাবারের এত আয়োজন দেখে তার লজ্জা লাগছে।

'এত্ত কিছু কেন মামী?'

মামী বলায় পরমা খুশি হলেন। বললো, 'আমাদের বাড়ীতে তুমি এই প্রথম এসেছো'

'আপনি আমার জন্য এই রাতে এত্ত আয়োজন করেছেন আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না। তবে কিছু মনে করবেন না। আমি এসব খাব না। আজ আমার মা মারা গেছেন। আমি আজ নিরামিষ খাব।'

পরমা যেন হকচকিয়ে গেল। বললো, 'আমি  দুঃখিত মা। আমি জানতাম না যে তুমি সুদ্ধি দিদির জন্য আজ নিরামিষ খাবে?'

'না না ঠিক আছে। আপনারা খেয়ে নিন। আমি শুধু পোলাও আর সালাদ খাবো।'

'সুদ্ধি দিদি বেঁচে থাকতে কেন এলে না তুমি? দিদি কত খুশি হত'

জয়িতা দীর্শ্বাঘস ছেড়ে বললো, 'সেই সময়টুকু যে মা আমাকে দিল না।'

'আমি কি তোমাকে একটু ডাল করে দিব?'

'না না আর কিছু লাগবে না। আমি পোলাও আর সালাদ খেতে পারবো।'

সারাদিন পর জয়িতা পেট ভরে খেল। মনে মনে এই পরিবারটিকে জয়িতা ধন্যবাদ দিল। তার মায়ের অন্তত একটি ঠাই ছিল যেখানে সে একটু স্নেহ একটু ভালবাসা পেত। খাওয়া শেষ হলে জয়িতা সরিপিসির ঘরে এসে দেখলো পিসি ঘুমিয়ে পড়েছেন। জয়িতা বারান্দায় এলো। আজ জ্যোৎস্না রাত। আকাশে বড় একটা চাঁদ উঠেছে। মেঘও আছে। একটু পরপরই চাঁদটা মেঘের আড়ালে ডুবে যাচ্ছে আবার উঁকি দিচ্ছে। চাঁদ আর মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে সরিপিসির উঠোনটাও একবার উজ্জ্বল হয়ে উঠছে আবার অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে পরমা এসে জয়িতার কাঁধে হাত রাখল। জয়িতা পরমাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। এই প্রথম জয়িতা তার মায়ের কথা মনে করে জোরে চিৎকার করে কাঁদছে। পরমা কোন কথা বলল না। জয়িতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। অনেকক্ষণ এভাবেই কাটল। জয়িতা একটু শান্ত হলে পরমা বললো,

'অনেক রাত হয়েছে, তাছাড়া তুমি অনেক ক্লান্ত। যাও শুয়ে পড় গিয়ে।'

'মামী আপনি কি আর একটু সময় আমার সাথে এখানে থাকবেন?'

পরমা দু'টো চেয়ার টেনে নিয়ে একটাতে জয়িতাকে বসিয়ে অন্যটাতে নিজে বসলো। জয়িতা বললো, 

'পিসি মাকে খুব ভালবাসতেন তাই না?'

'হ্যাঁ তোমার মাকে পিসি নিজের মেয়ের মতো ভালবাসতেন। পিসির তো কোন ছেলেমেয়ে নেই। তোমার মাকে দিয়েই তিনি তার মাতৃত্বের সাধ মিটিয়েছিলেন। মানুষকে ভালবাসাই যেন পিসির র্ধম। জান, আমি পিসিকে যত দেখি ততই অবাক হই। আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় বাইশ বছর। তবে পিসির সাথে এই বাড়ীতে একসাথে থাকার সুযোগ হয়েছে মাত্র আট বছর। আর এই আট বছরে আমি প্রতিদিন পিসিকে নতুন নতুন ভাবে আবিস্কার করছি।'

পরমা চোখের জল মুছলেন। বললেন, 'আমাকে দেখে, আমার কথা শুনে তুমি মনে করছো মামী কত ভাল তাই না? আমাকে ভাল হতে শিখিয়েছেন এই পিসি। পিসি খুব ছোট বেলায় বিধবা হয়ে বাপের বাড়ী ফিরে এসেছিলেন। পিসিকে এ বাড়ীর, এই পাড়ার কেউই সহজভাবে মেনে নেয় নি। পিসির নাম ছিল স্বরসতি সবাই পিসিকে বলতো অলক্ষী, অপয়া, ডাইনি। অনেকে তো পিসির মুখও দেখতে চাই তো না। আমার শ্বশুর তখন কাজ কারতেন তোমার নানার কাঠের আড়তে। শাশুড়ি আর দুই ছেলে নিয়ে চার জনের সংসার। আমার শ্বশুরের আয়ে সংসার চলতো না। তার উপর আবার পিসি এসে জুটলেন। আমার শাশুড়ি মানে পিসির ভাইয়ের বৌ পিসিকে বাড়ীতে থাকতে দিলেন না। পিসির বয়স তখন মাত্র পনের বছর। আমার শ্বশুর অনেক বলে কয়ে মাতব্বর বাড়ীতে পিসির একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেন। তোমার মায়ের নাকী তখন জন্মই হয় নি। তোমার বড় মামা তখন অনেক ছোট। তোমার নানী খুব একটা গোছানো ছিলেন না। পিসি নিজের বাড়ীর মতো করে মাতব্বর বাড়ীর যাবতীয় ঘরকন্নার কাজ দেখাশুনা করতেন। এর পর তোমার মায়ের জন্ম হলো পিসির হাতে। পিসিই তোমার মায়ের দেখাশনা ভার নিলেন। স্বামী সন্তানহীনা ছোট্ট একটি মেয়ে পেয়ে গেল একজন খেলার সাথি, একজন সন্তান, একজন বন্ধু। এরপর তোমার মায়ের বিয়ের পরও পিসি নাকী অনেকদিন তোমার দাদার বাড়ীতে গিয়ে ছিলেন। তোমার নানা-নানী দুজনেই অনেকদিন রোগে ভুগে মারা গেছেন। পিসিই তাদের সেবা-যত্ন করেছেন। তোমার মামারা তো কেউ তোমার মায়ের খোঁজ-খবর রাখতো না। তাই পিসি মনে করতেন তোমার মায়ের সব দায়িত্ব তার একার। ছোটবেলায় তুমি যতদিন তোমার মায়ের কাছে ছিলে পিসিই তোমাকে আগলে রেখেছিলেন। তোমার মা অসুস্থ হয়ে যখন শশীপুর ফিরে এলো তখনও পিসি সারাক্ষণ তোমার মাকে চোখে চোখে রাখতেন। তারপরও তোমার মা মাঝে মাঝে কোথায় যেন হারিয়ে যেতেন। পিসি তখন পাগলের মতো তোমার মাকে খুঁজে বেড়োতেন।'

এই টুকু বলে পরমা থামলেন। জয়িতা এখন আর কাদছেনা। সে বললো, 'তারপর'

'তোমার নানার বাড়ীতে তোমার মায়ের সঙ্গেই পিসি তার জীবনের বেশীরভাগ সময় পার করেছেন। তাই আমাদের চাইতে তোমার মায়ের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা। পিসি মাতব্বর বাড়ী থেকে যে বেতন পেতেন সেই বেতন দিয়ে তিনি তার দুই ভাইপোকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। নিজের জন্য পিসি একটা কানাকড়িও রাখেন নি। পিসির নাকি লেখাপড়ার খুব শখ ছিল। নিজে যা পারেন নি, ভাইপোদের দিয়ে সেই আশা পূরণ করেছেন। তুমি শুনলে অবাক হবে, পিসির আরেক ভাইপো মানে আমার ভাসুর তিনি বরিশাল থাকেন। সেখানকার এক উপজেলার প্রশাসক তিনি। ভাশুরেরও লেখাপড়ার প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। তাই তো তিনি এখন অনেক বড় পদে চাকরি করেন। কিন্তু তোমার মামা মানে পিসির ছোট ভাইপো নাকী ছিল খুব অলস। লেখাপড়া তার খুব একটা ভাল লাগতো না। তাই কোন রকমে ম্যাট্রিক পাশ করেই তিনি বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। পিসির দুই ভাইপোই পিসিকে অনেক ভক্তি করেন। আমার ভাশুর পিসিকে তার কাছে নেওয়ার জন্য অনেক পিড়াপিড়ি করতেন। পিসি যেতেন না। বলতেন তিনি দূরে চলে গেলে সুদ্ধি দিদিকে কে দেখবে?

আমার ভাশুর শিক্ষিত মানুষ, তিনি জানতেন বুঝতেন পিসির মনের অবস্থা, সুদ্ধির প্রতি পিসির ভালবাসা। তাই তিনি জোর করতেন না। এরপর প্রায় আট বছর আগে পিসির শরীর অনেক খারাপ হলে জোর করে তোমার ছোটমামা পিসিকে আমাদের বাড়ীতে নিয়ে আসেন। পিসি অবশ্য আসতে চান নি। তোমাকে সত্যি করে বলি মা। এখানে আসার পর আমি মোটেও পিসিকে পছন্দ করতাম না। অনেক অবহেলা করেছি মানুষটির প্রতি আমি। কিন্তু পিসি একদিনের জন্যও আমাকে দূরে ঠেলে দেন নি। আমি যে পিসিকে পছন্দ করতাম না এ বিষয়টি তোমার মামা বুঝতে পেরেছিলেন। একদিন তিনি আমাকে ডেকে যখন পিসির জীবন বৃত্তান্ত বললেন। মানুষটির প্রতি আমার শ্রদ্ধ‍া বেড়ে গেল। নিজের কথা চিন্তা না করে যে মানুষটি সারা জীবন অন্যকে দিয়েই গেলেন সে মানুষটি কতই না মহৎ। এখন নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয় পিসির সেবা করতে পেরে।'

'পিসি সত্যিই খুব মহৎ। আমার জীবনেরও পিসির অনেক অবদান'

পরমা চোখের জল মুছে বললেন, 'তুমি যদি কিছু মনে না কর তবে তোমায় একটা কথা বলি?'

জয়িতা মুখে কোন কথা না বলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো 

'আমার মনে হয়, ছোটবেলায় সুদ্ধি দিদির কাছ থেকে তোমাকে নিয়ে গিয়ে ভালই হয়েছিল।'

'হয় তো'

'নয় তো তোমার প্রতি অবহেলা করা হতো'

'আমার মা অবহেলিত হলো কেন মামী?'

'আমার কাছে এর কোন উত্তর নেই মা।'

এরপর পরমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, 'অনেক রাত হয়েছে। চল তোমার শোবার ঘরটি দেখিয়ে দেই।'

জয়িতাকে যে ঘরে রাতে থাকতে দেওয়া হলো সে ঘরটি সম্ভবত পরমার ছেলের ঘর। খুব পরিপাটি
একটি ঘর। জয়িতা বিছানায় গিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।




১২


পরের দিন সকালে জয়িতা আবারও গির্জায় গেল। মায়ের কবরে মোমবাতি আগরবাতি জ্বালালো। অনেকক্ষণ প্রার্থনা করলো। এরপর বাসে চড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বাসে উঠেই জয়িতা তার ফোন অন করলো। অনেকগুলো মিসড কল, ম্যাসেস। জয়িতা কোনটারই উত্তর দিল না। বাস শশীপুরের বন-জঙ্গল, নদী-পথ ছাড়িয়ে ঢাকার দিকে ছুটছে আর জয়িতার স্মৃতিপটে ভেসে উঠছে গত দু'দিনে তার জীবনে ঘটে যাওয়া নানা দৃশ্য। সতের বছর ধরে জয়িতার দেখা জগৎটা এই দুই দিনেই কেমন যেন বদলে গেছে। যাদের নিয়ে তার পৃথিবীটা আবদ্ধ ছিল এর সাথে আরো অনেক কিছু যোগ হলো আবার কিছু বিয়োগ হলো। মানুষ, পরিবার, সমাজ, সংস্কার, আত্মীয়তা সব কিছু সম্পর্কে তার নতুন অনেক অভিজ্ঞতা হলো। দুই দিনেই যেন সে অনেকটা বড় হয়ে গেছে, অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। 

জয়িতা মনে মনে ভাবে, আসলে মানুষ অনেক কিছু চাইলেই করতে পারে না। সে তার মাকে সুস্থ করতে চেয়েছিল কিন্তু পারে নি। এখানে না পারার ক্ষেত্রে তার কোন হাত ছিল না। আবার সে তার বাবার কাছে মাকে নিয়ে যেতে পারে নি। মা বেঁচে থাকলেও তা পারতো না। সেখানে সমাজ বলে একটা শব্দ আছে। যে সমাজে তার মা বড়ই বেমানান। 

মায়ের যে সব নিকট আত্মীয় ছিল তারাও তার মায়ের প্রতি বিন্দুমাত্র করুনা দেখায় নি। অথচ সরিপিসি যার সাথে কোন রক্তের সম্পর্ক ছিল না, ধর্মের সম্পর্ক ছিলমে সেই সরিপিসি মাকে দিয়েছিলেন মায়ের স্নেহ-ভালবাসা। সমাজে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত লোকেরা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন আবার দরিদ্র নিরক্ষর লোকেরাই মানব সেবার ইতিহাস সৃষ্টি করে। বড়ই আজব এই পৃথিবীর মানুষ।

সে কি তার বাবাকে তার মায়ের কথা বলতে পারতো? যদি বলতো তাদের সংসার নামক সুন্দর সাজানো বাগানে হয় তো বড় কোন ঝড় বয়ে যেত। সেটা কি সে নিজেও মেনে নিতে পারতো? সে তার বাবাকে ভালবাসে, বুঝতে শেখার পর থেকে সে যাকে মা বলে জানে তাকেও সে খুব ভালবাসে। তবে শশীপুরের সুন্দরীর স্থান কোথায় হতো? তার মা সুন্দরী আগে থেকেই অনেক কিছু অনুমান করতে পারতেন আর এসব অনুমান করেই কি তিনি স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বেছে নিলেন? শশীপুরের সুন্দরী চাননি তাকে নিয়ে জয়িতার জীবনে বা সংকর গমেজের পরিবারে কোন ধরনের ঝড় বয়ে যাক তাই তিনি সব দুঃখ-কষ্ট, মান-অভিমান নিয়ে এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছেন। এতে করে কার কি লাভ হলো ঠিক বলা যাবে না তবে আর যাই হোক জয়িতার বাবার জীবন থেকে একটা কালো অধ্যায়ের সমাপ্ত তো হলো।

জয়িতার বাবা-মা সারা রাত জেগে ছিলেন। এই বুঝি মেয়ের ফোন আসবে ভেবে ফোনের দিকে অপলক চেয়ে থেকেছেন দুজনেই। সকালে দুইভাই স্কুলে গেলেও সংকর গমেজ আজ অফিসে যাননি। সকাল থেকেই তিনি বসার ঘরে পায়চারি করছেন। এমন পরিস্থিতিতে কখনো পরেন নি তিনি। কি হলো জয়িতার? একদিকে যেমন মেয়ের কোন বিপদ হলো ভেবে তিনি ভয় পাচ্ছিলেন অন্য দিকে তিনি জয়িতার উপর খুবই বিরক্ত হচ্ছিলেন। কেন না গতকাল জয়িতা যে ইচ্ছে করেই ফোনটা বন্ধ করেছিল সেটা তিনি ভাল ভাবেই অনুমান করতে পারছিলেন। কি এমন জরুরি কাজ জয়িতার যে সে ফোনের সুইচটা পর্যন্ত অফ করে রাখে? আগে তো জয়িতা কখনো এমন করে নি। হঠাৎ করে তার কি হলো! মা বাবাকে না বলে সে বাইরে রাত কাটায়। সে কোথায় যেতে পারে? এই ঢাকা শহরে, এমন কি সারা বাংলাদেশে, সারা পৃথিবীতে তার কোন আত্মীয় নেই যেখানে জয়িতা রাত কাটাতে পারে।

জয়িতা রিপাদের হোষ্টেলেও যায় নি। সেখানেও খুঁজ নেওয়া হয়েছে। সংকর গমেজ একবার থানায় যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু জয়িতার মা যেতে দেন নি। আজ সকালটা দেখেই থানায় যাবেন বলে সদ্ধান্ত নিয়েছেন। জয়িতার বাবা মা কলিং বেলের শব্দ শোনার জন্য কান খাড়া করে রইলেন। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দ হলো। জয়িতার বাবাই দরজা খুললেন। ঘড়িতে তখন সময় সকাল দশটা। জয়িতাকে দেখে তার বাবা রেগে আগুণ হয়ে প্রশ্ন করলেন,

'কোথায় ছিলে রাতে?'

বাবার এরুপ অগ্নিমূর্তি জয়িতা তার জীবনে আগে কখনো দেখেনি। তবে জয়িতা একটুও ভয় পেল না। শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিল, 'এক আত্মীয়ের বাড়ীতে'

'আত্মীয়? কোন আত্মীয়? আমাদের বলে গেলে না কেন?'

'বললে হয় তো যেতে দিতে না তাই। তাছাড়া বলার সময় পাই নি।'

জয়িতার বাবা হঠাৎ মেয়ের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। 'কি এমন জরুরি কাজ তোমার যে বলার সময় পর্যন্ত পাও নি?'

জয়িতা খুব ব্যাথা পেল তবে কাদলনা না। বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। জয়িতার মা এগিয়ে এসে বললেন, 'মেয়ের গায়ে হাত তুললে কেন? জয়িতা তুই ঘরে যা।'

স্বামীর দিকে তাকিয়ে সুমিতা বললেন, 'তুমি শান্ত হয়ে বস, আমি ওর সাথে কথা বলবো।'

জয়িতার বাবা সেদিকে খেয়াল না করে মেয়ের দিকে কঠোর চোখে তাকিয়ে বললেন, 'বললে না কি এমন জরুরি কাজ ছিল তোমার? তুমি আমাদেরকে না জানিয়ে কেন রাতে বাইরে ছিলে? তোমাকে কি আমরা এই শিক্ষা দিয়েছি?'

'আমার এক আত্মীয় মারা গেছে বাবা। তার শেষ কৃত্যানুষ্ঠানে গিয়েছিলাম।'

'তোমার আবার আলাদা করে আত্মীয় কে? আমাদের বললে কি আমরা তোমার সাথে যেতাম না? আর আমাদের না জানিয়ে সেখানে তোমাকে রাতে থাকতে হবে কেন?'

জয়িতা বাবার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ব্যাগ থেকে ছবিগুলো বের করে বাবার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, 'বাবা ইনি মারা গেছেন। আমি উনাকেই কবর দিতে গিয়েছিলাম।'

জয়িতার বাবা ছবিগুলো হাতে নিয়ে দেখতে লাগলেন। ছবিগুলোর দিকে তাকিয়েই তার মাথাটা যেন একটা চক্কর দিয়ে উঠলো। ছবিগুলো থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তিনি মেয়ের দিকে তাকালেন। জয়িতা ততক্ষণে বড়বড় পা ফেলে নিজের ঘরে চলে যেতে শুরু করেছে।


অপেক্ষা উপন্যাসটি পড়তে ক্লিক করুন অপেক্ষা 

No comments

Theme images by Deejpilot. Powered by Blogger.