সুন্দরী উপন্যাস
১ |
চারতলা বাড়ির চতুর্থ তলায় জয়িতারা থাকে। বাবা-মা আর দুই ভাই নিয়ে জয়িতাদের সুখের সংসার। জয়িতার বাবা সংকর গমেজ জয়িতাকে খুব ভালবাসেন। আর জয়িতার সারা জগৎই যেন বাবাকে ঘিরে। সংকর গমেজ ঢাকা শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। বাপদাদার কোন অবদান নেই তার এই প্রতিষ্ঠার পেছনে। সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় তিনি এই অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন। ছেলেমেয়েদেরও তিনি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য উৎসাহিত করেন। জয়িতার মা সুমিতা একজন গৃহিণী। সংকর গমেজের জীবনের সকল সফলতার একমাত্র প্রেরণা যাকে বলে যোগ্য সহধর্মিণী।
জয়িতা হলিক্রস কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ভাইদের মধ্যে একজন ক্লাস এইটে আর অন্যজন সিক্সে পড়ে। তিন ভাইবোনের মধ্যে জয়িতা সবচেয়ে বেশি চঞ্চল। বলতে গেলে এই বাড়ির প্রানই হচ্ছে জয়িতা।
রাতে খাবার টেবিলে রিপার বোনের বিয়ের কথাটা তুলতেই সবাই কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। দুই ভাই বলল, 'দিদি আমাদের নিবে না?'
মা বললেন, 'না চারদিনের জন্য কোথাও যাওয়া চলবে না। একদিনের ছুটি আমি না হয় মঞ্জুর করতে পারব কিন্তু চারদিনের জন্য হবে না।' বলেই সুমিতা স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'তুমি কি বল?'
জয়িতা বাবার দিকে চেয়ে অনুনয়ের স্বরে বলল, 'বাবা!'
জয়িতার বাবা একটু গম্ভীর প্রকৃতির। সারাদিন ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও স্ত্রী-সন্তাদের ব্যপারে তিনি খুবই সচেতন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, 'তা যাচ্ছ কোথায় সেটা তো বলবে? ধারেকাছে হলে না হয় ভেবে দেখা যাবে।' বলেই তিনি মুচকি হাসতে লাগলেন। বাবার হাসি দেখে জয়িতা মনে মনে নিশ্চিন্ত হল সবাই মুখে যাই বলুক না কেন তাকে যেতে দিবে। জয়িতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলল, 'বাবা শশীপুর।'
'শশীপুর?' আচমকাই যেন সংকর গমেজের ঠোঁটদুটি নড়ে উঠল। শশীপুর শব্দটা শোনামাত্র সংকর গমেজের হাসিটা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। চেহারায় রাজ্যের বিস্ময় একে বললেন, 'কোন শশীপুর?'
'ঢাকার একদম কাছে নবাবগঞ্জের শশীপুর। বেশি দূরে নয় মাত্র দুই ঘণ্টার রাস্তা। বাবা যেতে দিবে তো বল না বাবা?'
নবাবগঞ্জের শশীপুর শোনার পর আর কোন কথা জয়িতার বাবার কানে পৌছালোনা। তিনি গভীর দুশ্চিন্তা নিয়ে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে নিজের ঘরে গেলেন। জয়িতার মা থালাবাসন গুছাতে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি স্বামীর এই পরিবর্তন খেয়াল করলেন না তবে বিষয়টি জয়িতার নজর এড়ালনা। সে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, 'মা তুমি বললে বাবা নিশ্চয় যেতে দিবে। একবার বলে দেখ না।'
'আচ্ছা বলব। তবে তোকে ছাড়া চারদিন থাকতে আমারও কিন্তু খুব কষ্ট হবে।'
'মা এখনই কিন্তু বলবে'
'ঠিক আছে বলবো' বলে তিনি শোবার ঘরে চলে গেলেন।
সুমিতা শোবার ঘরে গিয়ে দেখে জয়িতার বাবা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। সুমিতা বললেন, 'মেয়েকে কিছু না বলে চলে এলে যে?'
'জয়িতাকে বল এতদুর যেতে হবে না। '
'সমস্যাটা কি শুধু দূরত্বের জন্য?'
জয়িতার বাবা কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে কি যেন ভাবতে লাগলেন। স্বামীর কোন উত্তর না পেয়ে সুমিতা আবার বললেন, 'মাত্র দুই ঘণ্টার পথ। ওর সব বান্ধবীরা যাচ্ছে। ও যেতে না পারলে খুব কষ্ট পাবে। মেয়ে কিন্তু তোমার অনুমতির অপেক্ষায় আছে। কি বল? আমি কি ওকে যেতে বলব?'
'না' সংকর গমেজ এমন কঠিন স্বরে না শব্দটি উচ্চারণ করলেন যে সুমিতা অবাক হয়ে স্বামীর দিকে চেয়ে রইলেন। সংকর গমেজ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আরও কঠিন স্বরে বললেন, 'পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে আমি আমার মেয়েকে যেতে দিব, শুধুমাত্র শশীপুর ছাড়া।'
'মেয়ে নিশ্চয়ই কারণটা জানতে চাইবে'
'এ ব্যপারে আমি আর একটি কথাও বলতে চাইছি না সুমিতা।'
সুমিতা কিছুক্ষন বসে থেকে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। এদিকে জয়িতা মায়ের পেছনে পেছনে গিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ভেতরের সব কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল। মা ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই সে নিজের ঘরে চলে গেল।
জয়িতার কানে শুধু একটি কথাই প্রতিধ্বনি হতে লাগল, 'আমি আমার মেয়েকে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে যেতে দিব শুধুমাত্র শশীপুর ছাড়া।'
কিন্তু কেন? কেন বাবা তাকে শশীপুর যেতে দিতে চাইছেন না? কি আছে সেখানে? বাবা কি এর আগে কখনো শশীপুর গিয়েছে? জয়িতার মনে নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল।
সুমিতা জয়িতার ঘরে গিয়ে দেখে জয়িতা পড়ার টেবিলে বসে মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। মেয়ের মাথায় হাত রেখে সুমিতা বললেন, 'চারদিন তোকে ছাড়া তোর বাবা থাকতে পারবে না।'
'মা বিষয়টা কি শুধুই চারদিনের না কি অন্য কিছু?'
সুমিতা হকচকিয়ে বললেন, 'অন্য কিছু আবার কি হবে?' বলেই তিনি মেয়ের গুছানো ঘর গুছাতে শুরু করলেন। জয়িতা চেয়ার থেকে উঠে মায়ের হাত দুটি ধরে বলল, 'মা তুমি কি সত্যি কিছু জান না কেন বাবা আমাকে শশীপুর যেতে দিতে চায় না?'
সুমিতা হাসির চেষ্টা করে বললেন, 'আমি আবার কি জানব? '
'ঠিক আছে বাবা যখন চাইছে না আমি শশীপুর যাব না'
'তোর কি খুব খারাপ লাগছে?'
'একটু লাগছে, তবে...।
'তবে কি?'
জয়িতা কিছু না বলে রিপাকে ফোন দিল, 'হ্যালো রিপা শুক্রবার বাবা বাড়িতে একটা বিরাট পার্টির আয়জন করেছে। সারপ্রাইস পার্টি। ছোট ভাইয়ের জন্মদিন। কাউকেই এখনও কিছু জানানো হয়নি। বাবা বলেছে দুটো অনুষ্ঠানই গুরুত্বপূর্ণ। আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমি কোনটাতে যাব? আমি ভাবছি ছোট ভাইটার জন্মদিন আর আমি না থাকলে ও খুব কষ্ট পাবে রে। সো..............বুঝতেই পারছিস। রাগ করিস না। প্লিজ রি......।'
মেয়ের কথা শুনে সুমিতা অবাক হয়ে গেল। জয়িতা অনেক বড় হয়ে গেছে। কি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা সে তার বাবাকে ছোট করতে চাইছে না। সন্তানের কাছে এর চেয়ে বেশি তো বাবা মা কিছু আশা করে না। সুমিতা মনে মনে খুশি হলেন তাহলে মা হিসেবে তিনি জয়িতাকে সুশিক্ষা দিতে পেরেছেন।
জয়িতা ফোন রেখে মাকে জরিয়ে ধরে বলল, 'নো প্রব্লেম মা, রিপাকে ম্যানেজ করা গেছে।'
সুমিতা মেয়ের মাথায় হাত রেখে মুচকি হাসলেন। এরপর ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। জয়িতা লক্ষ করল মা যেন আঁচলে চোখ মুছলেন।
জয়িতার সারারাত ঘুম হল না। শশীপুর শব্দটা জয়িতার বুকে পাথরের মত চেপে রইল কিন্তু মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই যে জয়িতা কোনকিছু নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত।
নিষেধের বেড়াজাল ছিন্ন করার ধর্মই যেন এই বসয়ের। শশীপুর যাওয়ার জন্য জয়িতা মরিয়া হয়ে উঠল। মনে মনে পরিকল্পনা করতে লাগল কিভাবে যাওয়া যায় শশীপুর।
২
বিয়ে বাড়িতে মহা ধুমধাম করে চারদিন পর রিপা তার বান্ধবীদের নিয়ে ঢাকায় ফিরে এল। পরেরদিন কলেজে জয়িতার সাথে বান্ধবীদের দেখা হলে তারা বিয়েবাড়ির গল্পে মেতে রইল। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু সময় পেল মোবাইলে ছবি দেখল, কোন ছবিতে কাকে কেমন দেখাচ্ছে, কেমন হলে আর একটু ভাল হত এসব নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা চলল। জয়িতার কোন গ্রামের বাড়ি নেই, গ্রামে গিয়ে তার কখনো থাকা হয়নি। ছুটিছাটা হলে সংকর গমেজ তার পুরো পরিবার নিয়ে চলে যান দেশের বিভিন্ন পর্যটন এলাকায়। বেশ কয়েকবার তারা দেশের বাইরেও বেড়াতে গিয়েছে। একবার থাইল্যান্ড, একবার নেপাল আর ভারত যাওয়া হয়েছে কয়েকবার।
জয়িতা শশীপুর সম্পর্কে রিপাকে নানান প্রশ্ন করতে লাগল তবে সে যা জানতে চায় তেমন কোন ক্লু পেল না। আসলে জয়িতা কি জানতে চায় তা তার নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়। শশীপুর ঘিরে জয়িতার আগ্রহ দেখে রিপা বলল, 'তুই তো গেলি না। গেলে গ্রাম আর গ্রামের বিয়েতে যে কি আনন্দ হয় উপভোগ করতে পারতি। মন খারাপ করিস না তোকে খুব শিগগিরই আমাদের গ্রামে নিয়ে যাব।' জয়িতা রিপার কথায় খুশি হল। সে মুখফুটে যা বলতে পারছিল না রিপা যেন তাই-ই বলে দিল।
বিকেলে জয়িতা রিপাদের হোস্টেলে গেল। বাইরে ঝুম বৃষ্টি থাকায় রিপা আর তার বান্ধবীরা ঘুমাচ্ছিল। জয়িতা রিপার সাথে দেখা করতে চায় বলে ভেতরে খবর পাঠাল।
রিপা জয়িতাকে দেখে অবাক, 'এই বৃষ্টির মধ্যে তুই?'
'তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে'
'আয় রুমে আয়'
'না রুমে যাব না। আমি তোর সাথে একা কথা বলতে চাই।'
'কি এমন জরুরি কথা? কলেজে তো কিছুই বললি না।'
'কলেজে তোকে আর একা পেলাম কোথায়?'
'চল তাহলে বারান্দায় গিয়ে বসি।' বলেই রিপা জয়িতার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে বসাল। ছোট একটা বারান্দা খুবই ছিমছাম। লোহার একটা গোল টেবিল সাথে তিনটা চেয়ার আর রেলিঙে ছোটছোট ফুলের টব ঝুলানো। এমনিতে বারান্দাটা হোস্টেলের মেয়েদের পদচারনায় মুখরিত থাকে আজ বৃষ্টির কারনে সবাই ঘুমাচ্ছে।
'চা খাবি তো জয়িতা?'
'না কিচ্ছু খাব না তুই বস'
রিপা চেয়ার টেনে জয়িতার সামনে বসল। জয়িতা রিপার হাত দুটো ধরে বলল, 'আমি তোদের বাড়ি যেতে চাই'
'আমাদের বাড়ি? কি ব্যাপার বলত?'
'না মানে লতাদি আমাকে এত স্নেহ করেন। তার বিয়েতে যেতে পারলাম না তাই ভাবলাম হঠাৎ একদিন গিয়ে লতাদিকে সারপ্রাইস দেই। তাছাড়া রাখি সুমি ওদের মুখে তোদের গ্রামের প্রশংসা শুনে আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে। তোদের গ্রামটা ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করছে।'
'ওরা আবার গ্রাম ঘুরে দেখার সময় পেল কই? সারাক্ষনই তো বিয়ে বাড়ি নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তবে জানিস সত্যি ওরা খুব মজা করেছে। আর ওরা ছিল বলে আমাদের অনেক হেল্প হয়েছে। '
জয়িতা গম্ভীর মুখে বলল, 'কবে নিয়ে যাবি আমাকে তোদের গ্রামে সেটা বল?'
'বোস ওদের ডেকে তুলি। একটা প্ল্যান করি, তারপর চল চারজন বেড়িয়ে পড়ি।
'না ওরা না শুধু তুই আর আমি যাব।'
'ব্যাপারটা কি বলত জয়িতা? তোকে কেমন যেন গোমড়া দেখাচ্ছে। '
জয়িতা হাসার চেষ্টা করে বলল, 'কিচ্ছু হয় নি, এবার বল কবে নিয়ে যাবি আমায় তোদের শস্য-শ্যামল-সবুজ গ্রামে? '
রিপা মাথা চুলকে বলল, 'আগামী শুক্রবার?'
'ঠিক আছে তাহলে আজ উঠি, বৃষ্টি আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে।'
জয়িতা বৃষ্টির মধ্যেই উঠে পড়ল। অন্য সময় বৃষ্টি ভীষণ পছন্দ করে তবে আজ তার কিছুই ভাল লাগছে না। আজ সোমবার শুক্রবার আসতে আরও চারদিন বাকি। সবচেয়ে বড় কথা বাবা-মাকে মিথ্যে বলতে হবে। জয়িতা কখনও মিথ্যে বলে না। তবে কিভাবে জয়িতা বাড়ি থেকে বের হবে সেটাই চিন্তা করতে লাগল।
হোস্টেল থেকে ফেরার সময় লতাদির জন্য একটা শাড়ি কিনে এনেছে জয়িতা। লাল আর সবুজের মিশ্রনে একটা তাঁতের শাড়ি। নতুন বৌদের নাকি লাল শাড়ি পরলে খুব সুন্দর মানায়। শাড়িটি খুব যত্ন করে প্যাকেট করল সে। এদিকে মা খাবার ঘর থেকে ডাকছে। জয়িতার খিধে নেই। তবুও সে খেতে গেল কারন তার ভেতরে যে কিছু একটা চলছে তা সে কাউকে বুঝতে দিতে চায় না। সে স্বাভাবিকভাবে খাবার টেবিলে গিয়ে বসল। চরম বিরক্তির সাথে বলল, 'দূর আগামি শুক্রবার যেতে হবে রাজেন্দ্রপুর শিক্ষা সফরে।' জয়িতা এমনভাবে বলল যেন তার যেতে একটুও ইচ্ছে নেই।
সংকর গমেজ বললেন, 'শিক্ষা সফর তো লেখাপড়ারই একটা অংশ মা'
ছোটভাই বলল, 'দিদি তুমি না গতবার রাজেন্দ্রপুর গেলে? এবার ওই একই জায়গায় যাচ্ছ নাকি?'
জয়িতা ঘাবড়ে গেল, সত্যি তো! ইস কেন যে তার মুখ দিয়ে রাজেন্দ্রপুর বের হল? সামলে নিয়ে সে বলল, 'সেই জন্যই তো যেতে ইচ্ছে করছে না। একই জায়গায় বারবার দেখার কি আছে বল তো বাবা?'
জয়িতার বাবা বেশ উৎসাহ পেলেন। বললেন, 'একই জায়গায় তুমি যতবার যাবে, প্রত্যেকবার তুমি সেখানে নতুন কিছু না কিছু আবিষ্কার করবে। ভাববে কই আগেরবার তো ওই জিনিসটা দেখা হয় নি।' বলেই তিনি হা হা করে হাসতে লাগলেন। সংকর গমেজ প্রান খুলে হাসলেন। মেয়ে যে শশীপুরের ব্যপারটা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে এই বিষয়ে তিনি যেন নিশ্চিন্ত। মনে মনে সন্তোষ প্রকাশ করলেন, মেয়ে তার বড়ই লক্ষ্মী একবার না করতেই দ্বিতীয়বার রা করেনি।
সংকর গমেজ আবার বলতে শুরু করলেন, 'গতবার শিক্ষাসফর থেকে এসে তুমি যে এসাইনমেন্ট করেছিলে এবার দেখবে একই জায়গায় গিয়ে তোমার এসাইনমেন্ট হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যাও মা খুশি মনে যাও'
জয়িতার মাথা থেকে যেন বড় একটা বোঝা নেমে গেল। সারাদিনের জন্য বাইরে যাওয়ার অনুমতি মেলায় সে খুশি হল তবে মিথ্যে বলায় তার ভেতরটা খচখচ করতে লাগল। জয়িতা ভাবল রাজেন্দ্রপুর বলে ভালই হয়েছে নয়তো ফিরে এসে ভাইদের হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন হয়ে যাবে।
শুক্রবার খুব ভোরে জয়িতা ঘুম থেকে উঠল। ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ নিয়ে তার রুম থেকে বেড়িয়ে দেখে খাবার টেবিলে বাবা। শুক্রবার বাবা সাধারনত একটু দের করেই ঘুম থেকে উঠেন। আজ বাবাকে টেবিলে দেখে জয়িতা ভড়কে গেল। তার মনে হল বাবা হয় তো সব জেনে ফেলেছে।
জয়িতা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, 'বাবা আজ এত সকালে উঠেছ যে?'
'যাবার আগে ভাল করে নাস্তা করে যাও।'
ইচ্ছে না থাকলেও জয়িতা টেবিলে বসল। আজ সে কোনরকম ঝামেলা করতে চায় না। যতটুকু সম্ভব সবাইকে মানিয়ে ঘর থেকে বের হতে হবে। বাবা চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন, 'তাড়াতাড়ি খেয়ে নিচে এসো আমি গাড়ি বের করছি।'
জয়িতা ভড়কে গিয়ে বলল, 'তুমি কোথায় যাবে?'
'তোমাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে আসি'
জয়িতার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সে বলল, 'না বাবা আমি রিক্সা নিয়েই যেতে পারব। তাছাড়া আজ তোমার ছুটিরদিন তুমি গিয়ে ঘুমাও বাবা।'
'সেজন্যই যাচ্ছি। আজ ছুটিরদিন এত সকালে রিক্সা পাবে না। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।'
জয়িতা অস্বস্তিতে পড়ল। আজ শুক্রবার কলেজের গেইট বন্ধ থাকবে। বাবা কলেজে গেলেই বুঝে ফেলবেন জয়িতা মিথ্যে বলেছে। তখন কি উত্তর দিবে জয়িতা? কিন্তু উপায় নেই বাবা ইতিমধ্যেই গাড়ির চাবি নিয়ে নিচে নামতে শুরু করেছেন। জয়িতাও বাবার পেছনে পেছনে এসে গাড়িতে গিয়ে বসল।
পুরো রাস্তা ফাঁকা। বাবা মেয়েকে অনেক উপদেশ দিতে লাগলেন। জয়িতা কোন কথা বলল না হাঁ হু ছাড়া। তার টেনশন হচ্ছিল কলেজের গেইট বন্ধ থাকবে সে বাবাকে কি উত্তর দিবে? হঠাৎ বুদ্ধি করে জয়িতা বলল, 'বাবা রাখি, রিপা, কনা আমার জন্য তেজগাঁও কলেজের সামনে অপেক্ষা করবে। আমাকে তুমি ওখানে নামিয়ে দাও।'
'ঠিক আছে আমরা বরং ওদের সেখান থেকে তুলে নিয়ে যাব।'
জয়িতা ভাবল কোন রকম তেজগাঁও কলেজের সামনে নেমে যেতে পারলেই হল। ধানমন্ডি থেকে ইন্দিরা রোড আসতে ১০ মিনিটও সময় লাগলো না। তেজগাঁও কলেজের কাছে আসতেই দেখে রিপা দাঁড়িয়ে আছে। জয়িতার বাবা বললেন, ‘ঐ দেখ তোমার বান্ধবী। ওকে গাড়ীতে উঠে আসতে বল।‘
‘বাবা রিপা একা এসেছে। সুমি রাখীর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তুমি বরং আমাকে এখানে নামিয়ে দাও। ওরা কখন আসবে কে জানে।‘
জয়িতার বাবা এতে রাজী হলেন। এতক্ষণ জয়িতার মুখে কালো দুশ্চিন্তার যে ছায়া ছিল তা যেন ক্ষণিকের মধ্যেই পরিবর্তন হয়ে আনন্দেরঝিলিক দেখা গেল। সে উৎসাহীত হয়ে বললো, ‘বাবা তুমি সাবধানে যেও কিন্তু।‘
‘ঠিক
আছে তুমিও সাবধানে থেকো। আর সময় পেলে
ফোন দিও আমরা চিন্তায়
থাকবো।‘
গাড়ি
থেকে নেমে জয়িতা হাত
নেড়ে বাবাকে বিদায় জানাল। জয়িতার বাবা চলে গেলেন।
ঠিক তখনই পেছন থেকে রিপার
বললো, ‘চল বেড়িয়ে পড়া
যাক।‘
জয়িতা আর রিপা সিএনজি নিয়ে সোজা গুলিস্থান চলে গেল। সেখান থেকে বাসে করে সোজা শশীপুর।
৩
ঢাকা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নবাবগঞ্জ উপজেলা। সদর উপজেলা থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার এগুলেই খ্রিষ্টান বসতি চোখে পড়বে। ইছামতি নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা খ্রিষ্টান গ্রামগুলোর একটি শশীপুর। আধুনিক প্রযুক্তি, সভ্যতা এবং উন্নয়নের আশীর্বাদে পরিপুষ্ট হলেও সবুজের সমারোহ আর অপরুপ সৌন্দর্যের চাদরে ছাওয়া শশীপুর গ্রাম।
রিপার বাবা নিখিল রোজারিও শশীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মেয়ের আসার খবর তিনি আগেই পেয়েছিলেন তাই সকাল ১০টার আগেই বাসষ্ট্যান্ডে এসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। বাসষ্ট্যান্ড থেকে রিপাদের বাড়ি হাঁটা পথ। যথা সময়ে বাস এসে থামলো। আগে রিপা বাস থেকে নামলো। জয়িতা বাস থেকে নামতেই হঠাৎ কোত্থেকে একটা পাগলি এসে জয়িতাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে লাগলো, ‘আমি কইছি না ও আসবো, ও আইছে। দেখ দেখ সবাই দেখ ও আইছে। আমি জানতাম।‘
জয়িতা এরকম পরিস্থিতিতে একদম ভড়কে গেল। রিপার বাবা তার হাতের ছাতা উঁচিয়ে পাগলিকে বলতে লাগলেন, ‘এ্যাই সুদ্ধি ছাড় ছাড় নইলে দিব এক বারি। ছাড় বলছি ছাড়।‘
ঠিক সেই মুহূর্তে রাস্তায় দাঁড়ানো সিএনজি থেকে এক লোক নেমে এসে পাগলিকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিল। পাগলি ছিটকে পড়লো ফুটপাতের এক কোনায় গর্তে। লোকটি সেখানে গিয়ে পাগলিকে এলোপাথারি লাথি মারতে লাগলো। এ ঘটনায় রাস্তায় ছোটখাট একটা জটলা তৈরি হল। পাগলি চুপ করে মাথা ঢেকে উপুর হয়ে রইলো যেন সে খুব লজ্জা পেয়েছে।
রোগা পাতলা পাগলির গায়ে শাড়ি নেই। শুধু পেটিকোট আর ব্লাউস পড়া। চুলগুলো খাওয়া খাওয়া করে কাটা। হাতপায়ের নখগুলো বড়বড় যেন মাত্রই মাটি খুঁড়ে বেড়িয়ে এসেছে। পাগলি জামাকাপড় শরীর সবটাই নোংরা ময়লা। মুখে আবার কালো কালো ছোপ ছোপ দেখলে মনে হয় কালি মেখেছে। সিএনজি ড্রাইভার পাগলিকে লাথি মারছে আর বলছে, ‘হারামজাদি তুই মানুষের গায়ে হাত দেস। তোর হাত দুইটা আজ আমি না ভাঙ্গছি। ওঠ ওঠ যা এহান থিক্যা।‘ বলেই লোকটি আরো কয়েকটি লাথি মারলো। পাগলিকে দেখে জয়িতার খুব মায়া হলো। পাগলির দিকে তাকিয়ে সে ভাবতে লাগলো আহা তার জন্যই আজ এই পরিস্থিতি হলো। রিপার বাবা লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘তুমি কিছু মনে করো না মা। চল আমরা বরং যাই।‘
‘জয়িতা
চলে আয়।‘ বলেই রিপা
বাবার সাথে হাঁটতে শুরু করলো।
জয়িতাও তাদের পেছনে পেছনে হাঁটছে। কিছুদূর এগোতেই পেছনে আবার শোরগোল শোনা
গেল। ওরা তাকিয়ে দেখে পাগলিটি দৌড়ে
ওদের দিকেই আসছে আর পাগলির
পেছনে সেই সিএনজি ড্রাইভার। চোখের পলকেই পাগলিটি দৌড়ে জয়িতার সামনে
এসে দাঁড়াল। ঠিক একই ভঙ্গিতে
জয়িতাকে জড়িয়ে ধরলো। জয়িতার মাথায় গালে হাত বুলাতে লাগলো
তবে মুখে কোন কথা
বললো না। জয়িতা ভয়
পাচ্ছে কিন্তু চিৎকার করছে না। পাছে পাগলি
ওর গলা টিপে ধরে
এই ভয়ে। রিপাও ভয়ে
দূরে সরে গেল। রিপার
বাবা আবার ছাতা উঁচিয়ে পাগলিকে
সরে যেতে বলছেন। কিন্তু
পাগলি জয়িতাকে যেন আদর করছে। এমন সময় সিএনজি
ড়্রাইভার তার পায়ের স্পঞ্চের
স্যান্ডেল খুলে পাগলির গালে ঠাসঠাস করে
মারতে লাগলো। রিপা জয়িতার হাত
ধরে টানতে টানতে জোরে জোরে হাঁটতে শুরু
করলো। জয়িতা শুনতে পেল পাগলি চিৎকার
করে কাঁদছে আর বলছে, ‘ওকে আর একটু
দেখবো, আর একটু দেখবো।
একটু দেখতে দে।‘
রিপার মা জলখাবার প্রস্তুত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রিপা তার মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘জান মা জয়িতার গ্রাম দেখার অনেক শখ। ওদের কোন গ্রামের বাড়ী নেই। ছোট বেলা থেকেই ও শহরে মানুষ হয়েছে। দিদির বিয়েতে আসতে পারে নি বলে ব্যস্ত হয়ে আজই চলে এসেছে। এদিকে সুদ্ধির ঘটনায় জয়িতা এতটাই হকচকিয়ে গেল যে সে কেন শশীপুর এসেছে তা যেন সে ভুলেই গেল। তার সমস্ত চিন্তা জুড়ে রইলো শুধু সেই পাগলি। ইস কিভাবেই না লোকটি পাগলিকে মারছিল। রিপার মা কয়েকটি পেয়ারা এনে বললেন, ‘নাও মা এগুলো খেয়ে দেখ। এগুলো আমাদের গাছের পেয়ারা। শহরে কি তোমরা এমন ফ্রেস ফল পাবে?’
রিপার বাবা হাতমুখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকলেন। একটুকরো পেয়ারা নিয়ে বললেন, ‘বুঝলে মনি সুদ্ধির উৎপাত আবার বেড়েছে। আজ যা করলো তুমি না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবে না।‘
বলবে না বলবে না করেও হঠাৎ জয়িতা জিজ্ঞেস করলো, ‘সুদ্ধি কে আঙ্কেল?’
‘সুদ্ধি হচ্ছে এই শশীপুর গ্রামের আবর্জনা। এই যে তুমি আমাদের এই শশীপুরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসেছো, কিন্তু এসে কি দেখলে? দেখলে একটা আবর্জনা যে কি-না গ্রামের সৌন্দর্য নষ্ট করছে, পরিবেশ নষ্ট করছে।‘
রিপার মা মনি বললো, ‘তুমি এভাবে বলছো কেন?’
‘আসলে কথায় আছে না ধর্মের কল বাতাসে নড়ে কথাটা একদম ঠিক বুঝলে? ঐ সুদ্ধি হচ্ছে তার জলন্ত প্রমান। এই সব হচ্ছে ওর বাপের পাপের ফল।‘
‘আচ্ছা আঙ্কেল উনার বাবার পাপের শাস্তি উনি পাবেন কেন?’
‘যদি তাই না-হয় তবে সুদ্ধির মত একটি নিস্পাপ মেয়ের জীবন তো এমন হবার কথা না মা।‘
রিপা বললো, ‘আচ্ছা বাবা ওর নাম সুদ্ধি কে রাখলো? কেমন অদ্ভুত নাম তাই না?’
‘অদ্ভুদ
তো বটেই, তবে ওর আসল
নাম সুদ্ধি নয় সুন্দরী। আর
এই অদ্ভুদ নামটি রেখেছিল সুন্দরীর দাদী। আমরা তো মানুষের
নাম বিকৃতি করতে ওস্তাদ। কেউ
উচ্চারণ করতে না পেরে বিকৃতি
করে আবার কেউ ইচ্ছে
করেই নাম বিকৃতি করে।‘
‘বাবা সুদ্ধি বলো আর সুন্দরীই বলো আমি কিন্তু এমন নাম আর কোথাও শুনিনি, জয়িতা তুই শুনেছিস?'
‘না আমিও শুনিনি। এই নাম ছাড়া উনার আর কোন নাম নেই।?’
‘বাবা তোমাকে তো বলা হয় নি, জয়িতা কিন্তু খুব বড় মাপের একজন লেখিকা। বেশ কয়েকটি পত্রিকা আর ম্যাগাজিনে ওর লেখা ছাপা হয়েছে। ও যেখানেই যায় সেখানেই লেখার জন্য গল্প খুঁজে বেড়ায়। এই যে ও সুদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইছে, কয়েকদিন পর দেখবে কোন এক পত্রিকায় ওর এই পাগলীর গল্প ছাপা হয়েছে।‘ বলেই রিপা হি হি করে হাসতে লাগলো।
জয়িতা যেন লজ্জা পেল বললো, ‘না আঙ্কেল এই একটু আধটু চেষ্টা করি আর কি।‘
‘হ্যাঁ লেখালেখি খুব ভাল অভ্যাস। চেষ্টা চালিয়ে যাও।‘
‘আঙ্কেল আপনার যদি অসুবিধা না থাকে আমি সুদ্ধির বিষয়ে শুনতে চাই।‘
রিপার
বাবা চশমা খুলে টেবিলে
রেখে চোখ বন্ধ করলেন।
যেন তিনি স্মৃতি হাতরাচ্ছেন। এদিকে সুদ্ধির
ব্যাপারে রিপার কোন আগ্রহ আছে
বলে মনে হলো না।
তবে সে জয়িতার পাশে বসে পা
নাচিয়ে নাচিয়ে চানাচুর খেতে লাগলো অন্যমনঙ্কভাবে।
নিখিল রোজারিও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুরু করলেন-
বুঝলে
মা প্রায় ২৫ বছর আগের
কথা। সুদ্ধি তখন সবে শৈশব
পেরিয়ে কৈশরে পা দিয়েছে। আজ যে সুদ্ধিকে
দেখলে সে সুদ্ধি এরকম
ছিল না। উপচে পড়া
রুপ ছিল সুদ্ধির। সুদ্ধির সেই রুপের আগুনে
পুড়েনি এমন কোন ছেলে
এই শশীপুরে ছিল না। আমরা সুদ্ধিকে
এক নজর দেখার জন্য
স্কুল ফাঁকি দিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে
থাকতাম। মনে হতো বিধাতা যেন
প্রচুর সময় নিয়ে অত্যন্ত
নিখুঁতভাবে সুদ্ধিকে তৈরি করেছেন। যেমন চোখ, তেমনি
নাক, তেমনি তার ঢেউ খেলানো
চুল, যেন অবিকল প্রতিমা। আমরা
যে সুদ্ধিকে এক নজর দেখার
জন্য পাগল ছিলাম সুদ্ধি
যেন তা খেয়ালই করতো না। আমাদের
পাত্তাই দিত না সে।
লেখাপড়ায়ও সুদ্ধি ছিল খুব তুখোড়। অপরুপ
রুপের কারণেই সুদ্ধির দাদী শখ করে
নাতনীর নাম রেখেছিলেন সুন্দরী। তবে ওর
ভাল নাম হলো মেরিনা।
সুন্দর একটি নাম। কিন্তু
এই সুদ্ধির অন্তরালে কখন যে মেরিনা
আর সুন্দরী নাম দুটি হারিয়ে
গেছে।‘
একটু থেমে তিনি আবার শুরু করলেন, ‘জান আমরা ছয় বন্ধু ছিলাম, খুবই ঘনিষ্ট। এই সুদ্ধিকে এক নজর দেখার জন্য আমরা কারণে অকারণে সুদ্ধিদের বাড়ীর আশেপাশে ঘুরতাম। আর সুদ্ধির বাবা পচু মাতব্বার আমাদের উদ্দেশ্য আঁচ করতে পারতেন। তবে তিনি ঐ সুযোগে আমাদের দিয়ে বিনা পয়সায় কত কাজ যে করিয়ে নিতেন তার হিসেব নেই। কাজ করতে আমাদের যেন কোন ক্লান্তি লাগতো না। আশায় থাকতাম যদি একটু সুদ্ধির দেখা পাই। ভাবতাম এই হয়তো সুদ্ধি এসে দোতলার বারান্দায় দাঁড়াবে। আমাদের দিকে এক পলক তাকাবে। কোন কোন দিন সুদ্ধির দেখা পেতাম তবে বেশীরভাগ সময়ই তার দেখা পেতাম না। রিপার বাবা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লেন।
‘কি রে জয়িতা পাগলের গল্পে মগ্ন হলে চলবে? তুই না আমাদের গ্রাম ঘুরে দেখবি?’
‘একটু দাঁড়া প্লিজ।‘
'কি যেন বলছিলাম? ও হ্যাঁ, সুদ্ধির বাবা ছিলেন আমাদের গ্রামের মাতব্বর। তোমরা টেলিভিশনে যেমন দুষ্টু মাতব্বরের চরিত্র দেখ, সুদ্ধির বাবা ছিলেন ঠিক তেমন একজন লোক। এমন কোন খারাপ কাজ ছিলনা যা তিনি করতেন না। প্রকাশ্যে তিনি কাঠের ব্যবসা করতেন। আর পাছে ঘুষ নিয়ে অন্যায়ের পক্ষে বিচার করা, গরিব নিরীহ মানুষদের ঠকানো, মদের ব্যবসা করা সব কিছুই তিনি করতেন। ঐ যে বললাম আমাদের দিয়ে বীনা পয়সায় কাজ করিয়ে নিতেন।‘ বলেই তিনি হো হো করে হাসতে লাগলেন।জয়িতার হাসি পাচ্ছে না সে পুরো গল্প শোনার জন্য উৎসুক হয়ে রইলো।
রিপার
বাবা আবার শুরু করলেন, ‘সুদ্ধির বাবার
আরো একটা বদ অভ্যাস
ছিল। তিনি নিয়মিত ফকির
বাড়ীতে যাতায়াত করতেন, যাদু টোনা করতেন।
গ্রামে তার বিপক্ষে কেউ
কথা বললেই দেখা যেত কিছুদিন পর কোন কারণ
ছাড়াই ঐ ব্যক্তি ভিষণ
অসুস্থ হয়ে পড়তেন। বীনা
কারণে অসুস্থ হয়ে অনেকেই মারা
যেতেন। সবাই বলে সুদ্ধির
বাপের কুনজরে পড়ে যাদু টোনার কারণেই নাকী তাদের মৃত্যু
হয়েছে। জয় পাড়ায় সুদ্ধিদের
কিছু জমি ছিল। সেখানেই পাশের
জমির মালিকের সাথে মাতব্বরের জমিজমা
নিয়ে বিরোধ হয়েছিল। শুনেছি জমি নাকী আসলেই
মাতব্বরের ছিল না। এ
নিয়ে অনেক মামলা মোকাদ্দমা
হলো। মামলার রায় হওয়ার কিছুদিন
আগে জমির যে আসল
মালিক তিনি পাগল হয়ে
গেলেন। মামলা আর চললো না,
রায় গেল মাতব্বরের পক্ষে।
সবই শোনা কথা তবে
গ্রামের সবাই সুদ্ধির বাবাকে খুব ভয় পেতেন।
আর এজন্য কেউ সাহস করে
সুদ্ধিকে ভালবাসার কথা কিংবা বিয়ের
কথা বলতো না। সুদ্ধি বড়
হতে লাগলো। ওর রুপের আলো
যেন আরো ছড়াতে লাগলো।
হঠাৎ একদিন শুনলাম সুদ্ধির বিয়ে ঠিক হয়েছে।
তবে সেই ভাগ্যবান রাজপুত্রটি
এই গ্রামের কেউ নন। তিনি অনেক দূরদেশের
রাজপুত্র। সুদ্ধির বাবা তার প্রথম
জীবনে জাহাজে কাজ করতেন। সেখানেই না কি তার
সাথে পরিচয় হয়েছিল চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর। ঐ
ব্যবসায়ীর বড় ছেলে কি যেন
তার নাম------‘ বলেই রিপার বাবা
মাথা চুলকাতে লাগলেন।
‘নামটা
মনে পড়ছে না তবে
তিনি বিশাল বড়লোক। রঙয়ের বিরাট ব্যবসা তাদের। বাড়ীতে নাকি কয়েকটি ঘোড়াও
আছে। বিয়ে উপলক্ষে সুদ্ধিদের বাড়ীতে রঙ করানো হলো।
পাছে গ্রামের লোকেরা বলতে লাগলো জামাইয়ের কোম্পানীর রঙ তো তাই
প্রয়োজনের তুলনায় কিপটে মাতব্বর একটু বেশীই ঢালছেন। মজার কথা কি
জান? বিনে পয়সার কাজ
জেনেও মাতব্বর বাড়ীর পুরো রঙয়ের কাজ
আমরা ছয় বন্ধু মিলেই
করলাম। দুঃখ পেলেও হাসি
মুখে কাজ করলাম পাছে সুদ্ধিকে একটু
দেখতে পাই। তখন এই
শশীপুরে কেবলমাত্র একটিই দালান বাড়ী তাও আবার
দোতলা, বুঝতেই পারছো ব্যপারস্যপার। আমরা জানতাম গরিবের পেটে লাথি মেরে
মাতব্বর ঐ দালান বাড়ী,
ধন সম্পদ করেছিলেন। এদিকে শোনা গেল সুদ্ধির
বর নাকী ঘোড়ায় চড়ে
বিয়ে করতে আসবেন। কিন্তু
শেষে তিনি ঘোড়ায় চলে এলেন না।
চট্টগ্রাম থেকে শশীপুর অনেক
দূরের পথ। তাই ঘোড়া
আনা সম্ভব নয়। তবে বিয়ের
আগে সুদ্ধির হবু স্বামীর ঘোড়ায়
চড়া একটা ছবি শশীপুরে ভাইরাল
হয়ে গেল। যাকেই পান
মাতব্বর তাকেই ছবিটি দেখান। অনেকে ছবি দেখার উদ্দেশ্যে নানা উছিলায় মাতব্বর
বাড়ী যেতেন। আমিও কয়েকবার ছবিটি
দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। ইয়া লম্বা চওড়া
একটা লোক সাদা পাঞ্জাবী
পড়ে ঘোড়ায় বসে আছেন। মোটা গোঁফটাও যেন লোকটিকে
খুব মানিয়েছিল। পাছে হাত লেগে
ছবিটি নষ্ট হয়ে যায় তাই
মাতব্বর ছবিটিকে লেমেনেটিং করিয়ে এনেছিলেন। শশীপুর গ্রামের প্রত্যেকটি যুবকের মনে বেদনার সুর
ছড়িয়ে সুদ্ধির বিয়ে হয়ে গেল।
আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম।
তবে সবাই বললো বেশ
মানিয়েছিল দুজনকে। যেন সোনায় সোহাগা। মাতব্বর তার একমাত্র মেয়ের
উপযুক্ত জামাই পেয়ে আশে পাশের
গ্রামের হাজারো মানুষকে তিনদিন ধরে খাওয়ালেন। সুদ্ধি চলে
গেল শ্বশুরবাড়ী। একদিনেই গ্রামের জৌলুস কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
তখন দোকানে, বাসষ্ট্যান্ডে, কিংবা মাতব্বর বাড়ী গেলে কোথাও
কোন উৎসাহ হতো না। গ্রামটা খালি খালি লাগতো।
কি যেন গ্রাম থেকে
হারিয়ে গেছে। আমরা সব বন্ধুরা
বিষন্ন মনে কয়েকদিন কাটালাম।
বিয়ের
একমাস পর সুদ্ধি গ্রামে
ফিরে এলো। গ্রামের প্রত্যেকটি
যুবকের মনে আবারও আনন্দের ঢেউ খেলে গেল।
আবারো গ্রাম মুখরিত হলো। আমরা জানতাম
সুদ্ধি এখন অন্যের বউ তবুও যাকে
ভাললাগে তাকে দেখে আনন্দ
পাওয়া তো অন্যায় নয়। তাই
না? আমরা আবারও কারণে
অকারণে ঐ রাস্তা ধরে
যাওয়া আসা শুরু করলাম। বিয়ের
পর সুদ্ধির রুপ যেন আরো
খুলেছিল। আর সে যে
কতটা সুখী হয়েছিল তা ওকে
দেখেই আন্দাজ করা যেত। সুদ্ধি
গ্রামে রইলো সপ্তাহ খানেক।
এর মধ্যে সুদ্ধির স্বামী সুদ্ধিকে নিতে এলেন। বিয়ের
সময় লোকটিকে দূর থেকে দেখেছিলাম।
এবার কাছ থেকে দেখে মনে
হলো সত্যি তিনি শুধু ধন
সম্পদের দিক থেকেই বড়
নন। খুব বড় মনের মানুষ
তিনি। সুদ্ধি তার স্বামীর সাথে
চট্টগ্রাম চলে গেল। আমরাও
আস্তে আস্তে সুদ্ধিকে ভুলে গিয়ে নিজেদের
সংসার জীবন শুরু করলাম।
প্রায়
বছর খানেক পর শুনলাম সুদ্ধির
একটি মেয়ে হয়েছে। এই
খবর শুনে মাতব্বর চট্টগ্রাম গিয়ে নাতনীকে
দেখে এলেন। নাতনী নাকী সুদ্ধির মতোই
দেখতে সুন্দরী হয়েছে। একেবারে পরী। মাতব্বরের ইচ্ছা
ছিল মেয়ে নাতনীকে শশীপুর
নিয়ে আসার। কিন্তু এত দূরের পথ।
তার মধ্যে সুদ্ধির শ্বশুরবাড়ীর নিয়ম পরিবারে সন্তান
জন্মালে এক বছরের মধ্যে তারা কোন ধরণের
যাত্রা করে না। মেয়ে
নাতনী আনতে পারলেন না বলে সুদ্ধির
বাবা খুব আপসোস করলেন।
এদিকে আমাদের ঘরেও রিপা এলো আমরা
ভুলে গেলাম সুদ্ধির কথা। মাস ছয়
পর হঠাৎ সুদ্ধি তার মেয়েকে নিয়ে
এসে হাজির। শুনলাম সুদ্ধির শরীর খুব একটা
ভাল না। ডাক্তার সুদ্ধিকে
আবহাওয়া পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন।
সুদ্ধির আসার সপ্তাহ পার
হলেও আমরা সুদ্ধিকে একদিনের জন্যও
দেখিনি। মাঝে মাঝে রাস্তা
দিয়ে যাওয়ার সময় ওর বাচ্চার
কান্নার আওয়াজ শুনতাম।
একদিন
সন্ধ্যায় হঠাৎ রাস্তায় খুব
চেচামেচির শব্দ। বাইরে বেড়িয়ে দেখি সুদ্ধিদের বাড়ীর
সামনে ছোটখাট একটা জটলা। বাড়ীর
সামনে সিএনজি, পাশেই একটা বাচ্চা খুব
চিৎকার করছে। এগিয়ে গেলাম। ভাবলাম হয় তো সুদ্ধির মেয়েটার
অসুখ তাই এই ভর
সন্ধ্যায় ডাক্তারের কাছে যাবে।‘
বাবার কথার মাঝখানে রিপা হঠাৎ বলে উঠলো, ‘গল্পটা এখনো ধরতে পারিস নি জয়িতা? তুই কেমন লেখিকা বলতো? পরের টুকু আমি জানি। কি এক অজানা অসুখে সুদ্ধির মেয়েটা মারা গেল আর সুদ্ধি হলো পাগল। তাই না বাবা?’
‘না গল্পটা এমন নয়’ বলেই দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লেন নিখিল রোজারিও।
‘এমনই তো হবার কথা তাই না বাবা?’
‘যেটা জানো না সেটা নিয়ে মজা করা আমি পছন্দ করি না।‘
‘সরি বাবা’
‘আঙ্কেল এরপর কি হলো?’
‘জানো আমি সেদিন সুদ্ধিকে দেখে অবাক হয়েছিলাম। আমি তো ওকে চিনতেই পারি নি। সুদ্ধির বাবা মা জোর করে কাউকে সিএনজিতে তোলার চেষ্টা করছিলেন। রোগা পাতলা একজন মহিলা কামিনি ফুল গাছের ডাল শক্ত করে ধরে আছে। সে সিএনজিতে উঠবে না। ওর কোমড় পর্যন্ত খোলা চুলগুলো ওর মা বাঁধার চেষ্টা করছেন। কাছেই সরি পিসির কোলে সুন্দর ফুটফুটে একটি বাচ্চা একদম পরীর মতো। বুঝতে অসুবিধা হলো না এটি সুদ্ধির মেয়ে। আমি সরিপিসিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পিসি মহিলাটি কে?’
‘ও আমাদের সুদ্ধি।‘
‘সুদ্ধি?’ আমি যেন হোঁচট খেলাম। ‘একি আমাদের সেই স্বপ্নের সুদ্ধি?’
সুদ্ধিকে আমার চিনতে অনেকটা সময় লাগলো। একি চেহারা হয়েছে ওর? একদম অচেনা একজন মহিলা। রোগা পাতলা শুকিয়ে একদম কাঠ। সুদ্ধির চুলগুলো খোলা ছিল কিন্তু চুলে ছিল না সেই স্নিগ্ধতা, সুদ্ধি শাড়ি পড়ে ছিল কিন্তু তার দেহে ছিলনা কোন মাধুর্য। সন্ধ্যার আলো আঁধারে সুদ্ধির সুন্দর মুখ খানি দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু সেই মুখে নেই কোন লাবণ্য। সুদ্ধির সেই মায়াময় চোখে নেই চঞ্চলতা যেন তার চোখ জুড়ে শুধুই ভয়। কাকে ভয় পাচ্ছে সুদ্ধি? আমি সুদ্ধির বাবাকে জিগ্যেস করলাম, ‘আঙ্কেল কি হয়েছে?’
মাতব্বর আমার কথায় বিরক্ত হলেন। আমি আবারও জিগ্যেস করলাম, 'আঙ্কেল সুদ্ধির কি হয়েছে?'
এ সময় সুদ্ধি তার বাবার ধরে রাখা হাত একটা ঝাটকা মেরে ছাড়িয়ে দিল দৌড়। আঙ্কেল সুদ্ধির পেছন পেছন দৌড়াতে শুরু করলেন। সুদ্ধির মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সুদ্ধির শরীরটা ভাল না ও কে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। কিন্তু ও তো যেতেই চাইছে না।‘
আমি বললাম, ‘আমি কি আপনাদের কোন সাহায্য করতে পারি?’
আমার কথা যেন শুনতেই পান নি এমন ভাব করে তিনি সরিপিসির কোল থেকে সুদ্ধির মেয়েকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। আর সুদ্ধির মেয়েটি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলো। ঐ টুকুন একটা মেয়ে একবারে আমার রিপার বয়সী। মেয়েটার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল’ বলেই তিনি চোখ মুছলেন
জয়িতা ধরা গলায় বললো, ‘আঙ্কেল তার পর?’
‘আমি সাতপাঁচ না ভেবেই মাতব্বর বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলাম। সুদ্ধি উঠানে পা ছড়িয়ে বসে চিৎকার করে বলছে, ‘আমি ফকির বাড়ি যাব না। আমি ফকির বাড়ি যাব না।‘ রোগা পাতলা সুদ্ধির এই আকুতি শুনে ভেতরটা কেমন জানি মোচর দিয়ে উঠলো। সুদ্ধির বাবা সরিপিসির কানে কানে কি যেন বলে দোতলায় চলে গেলেন। সরি পিসি এসে সুদ্ধিকে জোর করে টেনে তুলতে চেষ্টা করতে লাগলেন। সুদ্ধি গোঁ মেরে বসে রইলো। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। যার সাথে কোন দিন কথা হয়নি অথচ সে ছিল আমার স্বপ্নের রানী এই অবস্থায় তাকে কি বলা যায়। পাশেই সুদ্ধির মায়ের কোলে মেয়েটি কাঁদছে। হঠাৎই আমি বলে বসলাম, ‘সুদ্ধি ওঠ তোমার মেয়েটা যে কাঁদছে। মেয়ের কথা শুনে সুদ্ধি উঠে মায়ের কোল থেকে মেয়েকে নিতে চাইল কিন্তু সুদ্ধির মা দিতে চাইছেন না। আমি বললাম, ‘আন্টি বাচ্চাটিকে ওর কোলে দিন।‘ সুদ্ধির মা আর বাঁধা দিলেন না। সুদ্ধি তার মেয়েটিকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। সুদ্ধির পেছনে পেছনে সুদ্ধির মা আর সরিপিসিও চলে গেলেন। দোতলার বারান্দা থেকে মাতব্বর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তুমি এবার যেতে পার।‘ এরপর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার আর কোন মানেই হয় না। আমি চলে আসলাম। রিপার বাবা কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন।
বাবাকে চুপ থাকতে দেখে রিপা বলল, ‘জয়িতা তুই পাগলির গল্প শোন আমি রান্না ঘরে মায়ের কাছে যাচ্ছি।‘
জয়িতা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। রিপার কথায় শুধু মাথা নেড়েসায় দিল। গল্পের বাকীটু শোনার জন্য নিখিল রোজারিও দিকে জয়িতা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইল।
‘এর দিন দুয়েক পর, হ্যাঁ দিনটি ছিল মঙ্গলবার। আমি সবেমাত্র হাট থেকে বাড়ি ফিরেছি। কলপারে হাতমুখ ধুতে গিয়ে শুনি আবারও সুদ্ধিদের বাড়িতে চিৎকার চেচামেচি। আমি হাতমুখ না ধুয়েই রাস্তায় নেমে গেলাম। দেখি সরিপিসি দৌড়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমাকে দেখেই হাত উঁচিয়ে ডাকলেন, ‘নিখিল শিগগির আয়।‘
'কি হয়েছে পিসি?’
‘ওরা যে সুদ্ধিকে মেরে ফেললো’
‘কে? কে মেরে ফেললো সুদ্ধিকে?’
‘বাড়ীতে ফকির এসেছে। সুদ্ধিকে নাকি ভুতে ধরেছে।‘
‘বল কি পিসি?’
‘আয় বাবা আয় শিগগিরি আয়।‘ বলেই ফিরে আবার আমার আগে আগে মাতব্বর বাড়ী চলে গেল। আমিও পিসির পিছু পিছু বাড়ীতে ঢুকলাম।
‘গিয়ে কি দেখলেন আঙ্কেল?’
‘সুদ্ধির বর্তমান জীবন যাত্রায় এখন এই শশীপুরের সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সেই সব কথা আসলে ভূলেই গিয়েছিলাম। আজ আবার সব যেন চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে’ বলেই তিনি চোখ মুছলেন। জয়িতা রিপার বাবার দিকে এক দৃষ্টে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে পরের টুকু শুনবে বলে।
‘যা দেখলাম তা দেখে নিজের চোখকেও আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। উঠোনে সুদ্ধির দুই হাত এক গাছের সঙ্গে বেঁধে এক সাধুবাবা বড় এক লাঠি দিয়ে সুদ্ধিকে বেধর পেটাচ্ছেন। সাধুবাবার পরণে গেরুয়া রঙের লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। মাথায় আধা পাকা চুলগুলো জটালো। তিনি সুদ্ধিকে পেটাচ্ছেন আর জোরে জোরে বলছেন, ‘বল তুই কে?’
‘সুদ্ধি চিৎকার করে কাঁদছে। সুদ্ধির বাবা মা সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। কেউ কিছু বলছেন না। সুদ্ধির মেয়েটা তার এক ভাই-বউয়ের কোলে কেঁদেই চলছে। শুধুমাত্র সরিপিসি সাধুকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সাধুবাবা সরিপিসিকে বাম হাত দিয়ে ঠেলে সরাতে চেষ্টা করছেন।
সাধুবাবা বললেন, ‘মাতব্বর সাব ওর কান্দে খুব বড়ডা চাপছে। সময় লাগবো।‘
‘যা যা করতে হয় আপনি করেন।‘
সাধুবাবার সাথে অল্প বয়স্ক একজন শিষ্য। তিনি আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করছিলেন। সাধুবাবা সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মরিচ পোড়নোর ব্যবস্থা কর।‘
ভর সন্ধ্যায় কি যে এক পরিবেশ তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না মা। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ করে বলেই ফেললাম, ‘এসব কি হচ্ছে? ছাড়ুন মেয়েটাকে ছাড়ুন।‘ আমার কথা শুনে সাধু বাবা আমার দিকে ফিরে তাকালেন। সুদ্ধির বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘মাতব্বর সাব বাইরের লোকজন আইলো ক্যামনে?’
সুদ্ধির বাবা আমার দিকে বড়বড় চোখ করে তাকালেন। আমি সুদ্ধির বাবাকে ভয় পেলাম না। এগিয়ে গিয়ে সাধুবাবার লাঠিটি টেনে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলাম। সরিপিসিকে বললাম সুদ্ধির হাত খুলে দিতে। পিসি সুদ্ধির হাত খুলতে লাগলো। সাধুবাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কাজটা ভাল হইতেছেনা।ওরে ভুতে পাইছে। ভূত ছাড়ান লাগবো। আপনে এহান থেকে যান।‘
'ওকে কোনো ভুতে ধরে নি। ও মানসিকভাবে অসুস্থ। ওকে ডাক্তার দেখাতে হবে।‘
‘ডাক্তার?’ সাধুবাবা বিদ্রুপের স্বরে বললেন, ‘কোন দিন শুনছেন ডাক্তাররা ভুত ছাড়াইছে? ভুত ছাড়ানের বিদ্যা ডাক্তাররা জানেন না।‘
আমি মাতব্বর সাহেবের কাছে গিয়ে বললাম, ‘আঙ্কেল সুদ্ধি মানসিকভাবে অসুস্থ ওকে ডাক্তার দেখান।ও ভাল হয়ে যাবে। এসব ফকির জাদু টোনায় কিছু হবে না। ওর আরো ক্ষতি হবে।‘
মাতব্বর চোখ রাঙ্গিয়ে আমাকে বললেন, ‘আমার বাড়ীর তিন সীমানায় তোমার ছায়া যেন আর না দেখি। তুমি এই মুহূর্তে এই বাড়ি থেকে চলে যাও।‘
চারিদিকে যে কি ঘটছে তা বোঝার আগেই ঘটলো আর এক কান্ড। সরিপিসি সুদ্ধির বাঁধন খুলে দিতেই সাধুবাবা সুদ্ধিকে জাপটে ধরলো আর শিশ্যকেও বললো সুদ্ধিকে আবার বেঁধে ফেলতে। শিষ্য দরি গোছাতে গোছাতে সুদ্ধি সাধুবাবার হাত এক ঝাটকায় ছাড়িয়ে দৌড়ে পালালো।সাধুবাবা আর তার শিষ্য সুদ্ধির পেছেনে পেছনে দৌড় দিল সুদ্ধিকে ধরতে।সুদ্ধির মেয়েটা যে চিৎকার শুরু করছে আর থামছেই না। মনে হলো মেয়েটার বোধ হয় খুব খিদে পেয়েছে। মাতব্বর আমাকে বললেন, ‘এখনো দাঁড়িয়ে আছ যে?’
আমি বাড়ী চলে এলাম।
৪
রাত
সাড়ে দশটা তখন। শীতের
সময় গ্রামে সাড়ে দশটা মানে
অনেক রাত। সারা দিনের
ধকল শেষে বিছানায় গেলেই রাজ্যের ঘুম চোখে জড়িয়ে
আসে। কিন্তু সেদিন আমার আর ঘুম এলো না।
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ
হলো। এত রাতে কে
এসেছে? আমি আঁতকে উঠলাম। কড়া নেড়েই যাচ্ছে
কেউ। দরজা খুলে দেখি
সরিপিসি। আমি তো অবাক। পিসির
কাছে শুনলাম তখনো সুদ্ধিকে কোথাও
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।
গ্রামের অনেক ছেলে বুড়োই সুদ্ধিকে খুঁজার কাজে নেমেছে। সন্ধ্যার সময় দৌড়ে সুদ্ধি নাকি হরার মার বাগে ঢুকেছিল। যে বাগে দিনের বেলায়ও কেউ একা যাওয়ার সাহস পায় না, সেই বাগে ভর সন্ধ্যায় সুদ্ধি যাওয়াতে অনেকেই নিশ্চিত হলো আসলেই সুদ্ধিকে ভুতে ধরেছে। মাতব্বরের লোকেরা টর্চ, হারিকেন, লাঠিসোটা নিয়ে বাগে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পায় নি। সুদ্ধিকে না পেয়ে সরি পিসি আমাকে জানাতে এসেছিল। সুদ্ধি ফিরে এলো তিন দিন পর। ঐ তিনদিনে সুদ্ধির আরো অনেক পরিবর্তন হয়ে গেল।
সুদ্ধি বাড়ী ফিরে এলো বদ্ধ উন্মাদ হয়ে। সুদ্ধির জীবনের ঐ তিনদিনের রহস্য অজানাই রয়ে গেছে। এসব খবর সুদ্ধির শ্বশুরবাড়ী পৌঁছাতে খুব একটা সময় লাগলো না। সপ্তা খানেক পর সুদ্ধির শ্বশুরশাশুড়ী এসে সুদ্ধির মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেলেন। সেদিন সুদ্ধি বাড়ী ছিল না তাই সুদ্ধির সাথে তাদের আর দেখা হলো না। মাতব্বর কথা দিলেন সুদ্ধি সুস্থ হলে তিনি স্বামীর কাছে মেয়েকে পাঠিয়ে দিবেন। এদিকে বাড়ী ফিরে মেয়েকে না দেখে সুদ্ধি অঝোরে কাঁদল। তবে কেউ সুদ্ধিকে সান্তনা দিল না একমাত্র সরিপিসি ছাড়া।
সুদ্ধি আর সুস্থ হলো না। তার আর স্বামীর কাছে ফেরাও হলোও না। বনে-জঙ্গলে, রাস্তা-ঘাটে কাটতে লাগলো সুদ্ধির দিনরাত। দিনে দিনে সুদ্ধির পাগলামী বাড়তে লাগলো। তারপরও সুদ্ধির শ্বশুর এক বার এসেছিলেন সুদ্ধিকে নিতে তবে সুদ্ধির যে অবস্থা তিনি আর সুদ্ধিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন নি। শুনেছি অনেকদিন অপেক্ষার পর সুদ্ধির স্বামী আবার বিয়ে করে নতুন করে সংসার শুরু করেছেন।
‘আঙ্কেল সুদ্ধি কার সঙ্গে থাকে এখন?’
‘কারো সঙ্গে না। সুদ্ধি এখন একাই থাকে। তার নিজের বাড়ীতে, স্বাধীনভাবে থাকে।‘
‘সুদ্ধির বাবা মা?’
‘সুদ্ধি
পাগল হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সুদ্ধির বাবা ষ্ট্রোক করে
প্যারালাইসিস হয়ে বিছানা নিলেন। সারাদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। কথা
বলতেন না শুধু ডান
হাতটা নেড়ে নেড়ে কি
যেন বলতে চাইতেন কিছুই
বোঝা যেত না। চোখ দিয়ে
অনবড়ত জল পড়তো। হয়
তো নিজের চোখে মেয়ের এই
অবস্থা দেখে কাঁদতেন হয় তো বা
অনুতাপও হয়েছিল নিজের কৃতকর্মের জন্য। জীবনে পাপ তো আর
কম করেন নি। প্রায়
চার বছর বিছানায় কষ্ট
পেয়েছেন তিনি। সুদ্ধির বাবা মারা যাওয়ার
কিছুদিন পর সুদ্ধির মাও
চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
সুদ্ধি হয়ে গেলে সম্পূর্ণ
একা।
সুদ্ধির বড়ভাই জাপানে কাজ করতেন। অনেক টাকা পয়সার মালিক বনেছিলেন। একবার দেশে এসে দুটো বাস কিনলেন। আবার জাপান গেলে ভাইয়ের বউ বাসের ড্রাইভারের সঙ্গে পালিয়ে গেল। ব্যাঙ্কে থাকা টাকা পয়সা সব কিছুই বউয়ের নামে ছিল। মহিলা যাওয়ার সময় সব টাকা পয়সা আর ৭ বছরের মেয়েটাকেও সাথে করে নিয়ে গেল। বড় ভাই জাপান থেকে আর ফেরেনি। শুনেছি সেখানে জাপানী মেম বিয়ে করে সুখে আছেন। মেঝভাই বড় ভাইয়ের বাস দুটি দেখাশুনা করতেন। বেশ কয়েক বছর আগে হঠাৎ করেই মেঝভাই ক্যান্সারে মারা গেলেন। দুটি ছেলে নিয়ে কোন রকমে চলছে বৌটির দিন। ঐ বউটিই এক আধবেলা সুদ্ধিকে খেতে দেয়। আর ঐ যে লোকটি রাস্তায় সুদ্ধিকে পেটালো। ও সুদ্ধির ছোটভাই। সারাদিন মদ খেয়ে নেশা করে চুর হয়ে থাকে। সুদ্ধির বাবা তার কাঠের ব্যবসাটা ওকে দিয়ে গিয়েছিলেন। নেশা করে বাপের কাঠের ব্যবসা লাঠে উঠিয়েছে। কোথা থেকে অল্প বয়স্ক একটা মেয়েকে ভাগিয়ে এনেছিল ১২ বছর আগে। সংসারে এখনো কোন সন্তান হয় নি। বউ আর প্রতিবেশীদের সাথে ঝগড়া মারামারি করেই ওর দিন কাটে। সুদ্ধির বাবা তিন ছেলেকে যথেষ্ট পরিমানে সহায় সম্পত্তি দিয়েছিলেন। সবাই অভাবে, নয় তো স্বভাবে সব বিক্রি করে প্রায় পথে বসেছে। আর সুদ্ধির ঠাই হয়েছে ওর দাদার আমলের ছোট ঘরটিতে।
‘আচ্ছা আঙ্কেল সুদ্ধির ঐ ছোট ভাইটি কি প্রায়ই ওকে এভাবে মারে?’
‘ও হাতে যখন আলসেমী বোধ করে তখন মারে না। নয় তো সুদ্ধি কোন ভুলভাল করলেই ওকে এভাবে ছোট ভাইয়ের কাছে মার খেতে হয়। প্রথম প্রথম আমরা বাঁধা দেওয়া চেষ্টা করতাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বললাম না মারামাটি, কাটাকাটি আর অশান্তি করেই ওর দিন কাটে।
একটু থেমে রিপার বাবা বললেন, ‘কি জয়িতা মা পেলে কোন গল্প?’
‘হ্যাঁ আঙ্কেল অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। অনেকটা সময় দিলেন আমাকে’
‘কই রে রিপা মা, জয়িতা মাকে নিয়ে আমাদের গ্রামটি ঘুরে দেখা’ বলেই আবার জয়িতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তবে জান মা একটা বিষয় আজ খুব অবাক লাগলো।‘
ঠিক তখনই রিপা ঘরে ঢুকলো। আগ্রহের সাথে বাবাকে জিগ্যেস করলো, ‘অবাক হলে কি দেখে বাবা?’
‘সুদ্ধি রাস্তাঘাট, বনবাদার চোষে বেড়ায়, একা একা বকবক করে নয় তো গালিগালাজ করে তবে কোন দিন সে কাউকে আক্রমন করে নি। আজকে তোমাকে দেখে কেন সে এমন করলো বুঝতে পারছিনা।‘
রিপা বললো, ‘কেন বাবা তোমার মনে নেই দীনা আন্টির রেষ্টুরেন্ট ওপেনিংয়ের দিন সুদ্ধি কি করেছিল?
‘হ্যাঁ মনে আছে। তবে সুদ্ধির সেই আচরণের একটা কারণ থাকতে পারে।‘
‘সেটা আবার কি বাবা?’
জয়িতা বলল, ‘আঙ্কেল আমাকে একটু খুলে বলবেন কি, কি হয়েছিল সেদিন।‘
‘জয়িতা গ্রাম ঘুরতে এসে পাগলীকে নিয়ে পরলি তুই। তোদের এই লেখক লেখিকাদের এই এক নেশা।‘
‘সব লেখক লেখিকাদের এই নেশা কি না জানিনা তবে আমার নেশা আছে সেটা ঠিক। তুই আর একটু দাড়া প্লিজ।‘
‘শোন আমি বলছি কি হয়েছিল। আমি তো সবার সামনে ছিলাম যা ঘটেছিল আমার সামনেই ঘটেছিল। ওরে বাবা মনে পড়লে এখনো আমার ভয় লাগে।‘
‘কি হয়েছিল বলবি তো না কি?’
‘আমার এক আন্টি আছে দীনা আন্টি। নবাবগঞ্জে আন্টির একটা চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট আছে। দুই বছর আগে রেষ্টুরেন্টটির ওপেনিং হয়। ঐ দিন আন্টি বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী অমল সাহাকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন অপেনিং করার জন্য।‘
‘অমল সাহা তো আমার বাবার খুব কাছের বন্ধু। প্রায়ই আমাদের বাসায় আসেন।‘
‘শোন না, তারপর কি হলো। আমার হাতে ছিল ফিতা কাটার কাঁচি। তাই ওপেনিংয়ের পর লাঞ্চ করার জন্য নিমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে দীনা আন্টি আমাকেও নিয়ে বসালেন টেবিলে। যেই না খাওয়া শুরু হয়েছে কোথা থেকে যেন সুদ্ধি উড়ে এলো। এসেই দুইহাত দিয়ে টেবিলের সব খাবার দাবার উলটিয়ে ফেলে দিল। টেবিলে রাখা গ্লাস প্লেট অমল সাহাকে লক্ষ করে ছুঁড়তে লাগলো আর কি যে বাজে বকতে লাগলো, বাবা রে বাবা। আমি তো ভয়ে অস্থির। এদিকে প্রধান অতিথি অমল সাহা ভয়ে দৌড়। পরে বাবা আর দীনা আন্টি উনাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাশের এক আর এক রেষ্টুরেন্টে নিয়ে খাওয়ালেন। খাওয়া তো দূরে কথা তিনি ভয়ে ঢাকা চলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি তো বলেই দিলেন যে এই এলাকায় তিনি আর কোন দিন আসবেন না।‘
জয়িতা যেন কোন রহস্যের সমাধান করতে পেরেছে এমন ভঙ্গিতে বললো, ‘ও এই কথা। এবার আমি বুঝতে পেরেছি কেন বাবা আমাকে শশীপুর আসতে দিতে চান নি।‘
‘তার মানে?’
‘বাবা নিশ্চয়ই অমল আঙ্কেলের কাছে ঐ দিনের ঘটনা শুনেছিলেন। তাই বাবাও ভয় পেয়ে আমাকে শশীপুর আসতে দিতে চান নি। তাছাড়া অমল আঙ্কেল যেভাবে রসিয়ে কষিয়ে গল্প বলেন। আমি নিশ্চিত বাবা এই সাধারন ঘটনাকেই বিরাট ভয়ঙ্কর মনে করছেন। আর তাই আমাকে এখানে আসতে দিতে চান নি।‘
রিপার বাবা বললেন, ‘অমল সাহা তাহলে তোমাদের পারিবারিক বন্ধু?’
‘হ্যাঁ আঙ্কেল, আপনি জানেন উনি খুবই মজার মানুষ। সাধারণ একটা হাসির ঘটনাকে উনি এমন ভঙ্গিতে বর্ণনা করেন একেক সময় হাসতে হাসতে আমাদের পেটে খিল ধরে যায়। আবার ছোট খাট ভয়ের গল্প উনি এমন ভয়ংক করে বলেন যে শুনে আমরা ভয়ে কাঠ হয়ে যাই। বাবা বলেন মজা করার জন্যই নাকি আঙ্কেল এভাবে বলেন।‘
রিপার বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘তবে অমল সাহার সঙ্গে সুদ্ধির ঐরকম করার একটা কারণ আছে বলে আমার মনে হয়।‘
‘অপরিচিত কাউকে দেখলেই সুদ্ধি এমন করে তাই না বাবা? অমল সাহা আর জয়িতা দুজনেই সুদ্ধির অপরিচিত আর সুদ্ধি দুজনকে দেখেই কেমন করলো দেখলে না বাবা?’
‘না তোমার কথাটা ঠিক না। এই রাস্তা দিয়ে সারা দিন অনেক অপরিচিত মানুষই তো যায়। কই সুদ্ধি তো তাদের সাথে এমন করে না। তাছাড়া অমল সাহা সুদ্ধির অপরিচিত নয়। আমার মনে হয়, অমল সাহা সুদ্ধিকে চিনতে না পারলেও সুদ্ধি ঠিকই অমল সাহাকে চিনতে পেরেছিল।‘
‘বাবা কি বলছো তুমি? সুদ্ধির মতো একটা পাগলি যে জীবনে টিভি দেখে না রেডিও শুনে না সে কি করে অমল সাহাকে চিনবে?’
‘এখন হয় তো সুদ্ধি টিভি দেখেনা রেডিও শুনে না। তবে এক সময় কিন্তু এগুলোর প্রতি সুদ্ধির প্রচন্ড ঝোঁক ছিল। আর সে সময় অমল সাহা ছিলেন উঠতি গায়ক। অনেক মেয়েদেরই স্বপ্নের নায়ক ছিলেন তিনি।‘
‘আঙ্কেল তার মানে অমল সাহার সঙ্গে সুদ্ধির কোন সম্পর্ক ……?’
‘আমি জানি না আমার অনুমান ঠিক কি-না, তবে অমল সাহা সুদ্ধির বিয়ের সময় ছেলের পক্ষের স্বাক্ষী ছিলেন। সুদ্ধির স্বামীর ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন অমল সাহা। দুই পরিবারের মধ্যে যাওয়া আসাও ছিল। আমার কেন জানি মনে হয় সুদ্ধি অমল সাহাকে চিনতে পেরেই সেই দিন ঐ ধরনের আচরণ করেছিল।‘
‘তাই যদি হয় তবে জয়িতার সঙ্গে আজ সুদ্ধি কেন এমন করলো?’
‘সেটা তো আমি বলতে পারবো না মা। সব সময় সব কিছুর কারণ জানা যায় না। আর আমি যেটা বললাম সেটা সম্পূর্ণ অনুমান করে। তাছাড়া সুদ্ধি অমল সাহাকে গ্লাস ছুড়েছিল আর জয়িতাকে মনে হলো সুদ্ধি আদর করছিল। তাই না জয়িতা?’ বলেই তিনি হাসার চেষ্টা করলেন।
‘ঠিক আছে এবার তোমরা যাও গ্রাম ঘুরে দেখ। তা না হলে আবার দুপুরের খাবার সময় হয়ে যাবে।‘
‘চল জয়িতা।‘
‘দাড়া ব্যাগটা নিয়ে নেই’ বলেই দুজনে বেড়িয়ে পড়লো। রিপাদের বাড়ীর চারটি বাড়ী পরেই সুদ্ধির ঘর। একেবারে রাস্তার পাড়ে। অনেক পুরোনো দিনের ঘর। ঘরটি নির্মাণের সময় হয় তো কেউ ভাবেই নি যে একদিন এই দিক দিয়ে পিচঢালা পাকা রাস্তা হবে। আর সুদ্ধির ঘরের বারান্দার অর্ধেকই চলে যাবে সরকারি রাস্তায়। রিপা সুদ্ধির ঘরটি দেখিয়ে বললো, ‘জয়িতা এই হচ্ছে তোর গল্পের নায়িকার রাজ প্রাসাদ।‘
‘তুই নায়িকা বলছিস কেন?’
‘আমি তো জানি তুই ঢাকায় ফিরেই সুদ্ধির গল্পটা লিখবি। কি ঠিক বলেছি না?’
‘হ্যাঁ তা লিখবো বৈ কি। গল্পটা আমার মনে ধরেছে।‘
‘তাহলে সেই গল্পের নায়িকাটা কে? সত্যি করে বলবি।‘
‘অবশ্যই সুদ্ধি।‘
‘তাহলে?’
‘তাই
বলে নায়িকা কথাটা মেনে নিতে পারছিনা।
নায়িকা কথাটা শুনলেই মনে হয় অল্পবয়স্ক
মেয়ে যে কিনা নেচে
গেয়ে কোন নায়কের মন
ভোলাবে, নয় তো মারামারি
করবে। সাথে প্রেমঘটিত কোন ব্যাপার থাকবে।
কিন্তু সুদ্ধিকে নায়িকা বলতে আমি নারাজ। তাছাড়া
আমি ভাবছি অসহায় মানসিকভাবে অসুস্থ একজন মহিলার জীবনের
সত্য ঘটনা নিয়ে লেখাটা কি
ঠিক হবে?’
‘কেন হবে না এক’শ বার হবে। তুই লেখ আমি ছাড়পত্র দিব’ বলেই রিপা হাসতে লাগলো। সঙ্গে জয়িতাও যোগ দিল।
‘রিপা চল না সুদ্ধির ঘরটা একটু ঘরে দেখে আসি।‘
‘কি বলছিস? বাসষ্ট্যান্ডে তোকে ও যেভাবে অভ্যর্থনা জানালো, এখন যদি তোকে ওর ঘরে দেখে ফেলে কি হবে বুঝতে পারছিস?’
‘পারছি। মনে হয় ও ঘরে নেই, দেখছিস না ঘরের দরজা বন্ধ। শোন তোকে ভেতরে যেতে হবে না। তুই বাইরে দাড়া আমি একটু ভেতরটা দেখে আসি। লিখতে যখন যাচ্ছি তখন ঘরের বর্ণনাটা বাস্তবই লিখতে চাই।‘
সুদ্ধির ঘরটা ছোট। দেয়ালের আস্তর খসে পড়েছে। খোলা বারান্দার অর্ধেকটাই রাস্তার সঙ্গে লাগোয়া। বারান্দায় হাতলভাঙ্গা নোংরা একটা প্লাষ্টিকের চেয়ার। চেয়ারের চারপাশে মাছি ভনভন করে ঊড়ছে। ঘরের দরজাটা অনেক পুরোনো, উপরে শেকল আঁটা। রিপা রাস্তার এক কোনে দাঁড়িয়ে রইলো আর জয়িতা ঘরের শেকল খোলা মাত্রই ভেতর থেকে ভটকা দুর্গন্ধ পেল। সে নাক চেপে বারান্দায় ফিরে এলো।
‘কি রে কি হলো, ফিরে এলি যে?’
‘দুর্গন্ধ, ঘরের ভেতর যাওয়া যাচ্ছে না।‘
‘চলে আয়।‘
‘সবুর
কর আর একবার একটু চেষ্টা করে
দেখি। এবার জয়িতা তার
ওড়নাটা ভালভাবে নাকে মুখে পেচিয়ে নিল।
আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকলো। ঘরের
দুইপাশে ছোট ছোট দুটো
জানালা দুটোই খোলা। সারা ঘরময় ময়লা
জামাকাপড় ছড়ানো। মেঝেতে একটা মুড়ির বোয়াম খোলা
পড়ে আছে। বোয়ামের ভেতরে
দুটো টিকটিকি। জয়িতার উপস্থিতি টের পেয়ে দৌড়ে পালালো। ঘরে
একটা ছোট খাট। বিছানা
বলতে কিছু নেই ছেঁড়া
একটা পাটি আর তেল চিটচিটে
একটা বালিশ। খাটেও জামা কোপড়ের স্তুপ।
জয়িতা ভাল করে সব লক্ষ্য
করছে কারণ সে তার
গল্পে বিস্তারিত লিখতে চায়। জয়িতা এবার
খাটের নিচে উঁকি দিল। খাটের নিচে পরিত্যাক্ত কাঁচ
আর প্লাষ্টিকের বোতলে ঠাসা। খাটের পাশে ছোট একটা
সেলফ। হাট করে খোলা
সেলফটির বাইরে ভেতরে মাকড়সার জালে জড়িয়ে আছে। সেলফের উপরে
তাকে একটা প্লেটে পাউরুটির
কিছুঅংশ খোলা পড়ে আছে।
সেখানেও মাছি ভনভন করছে।
পাশেই একটা হারিকেন, জন্মের
পর থেকেই যেন হারিকেনটি পরিস্কার
করা হয় নি।
জয়িতার
দম বন্ধ হয়ে আসছিল
তবুও সে সেলফের ভেতরটা দেখার জন্য কাছে গেল।
সেখানেও নোংরা পলিথিনের স্তুপ। কিন্তু সেলফের দ্বিতীয় থাকে কয়েকটি পুরোনো
কাঁসার থালাবাটি। তারপাশেই একটা পুরোনো কাগজের
মতো কি যেন দেখতে
পেল জয়িতা। তবে মাকরসার জালের কারণে
ভেতরে হাত দেওয়ার সাহস
পেল না। এদিকে ঘরের
পুরোটাই দেখা হয়ে গেছে তাই
জয়িতা ঘর থেকে বের
হওয়ার জন্য পা বাড়াল।
হঠাৎ কি মনে করে
জয়িতা আবার সেলফের কাছে গেল। খাটের
নিচ থেকে একটা প্লাষ্টিকের
বোতল নিয়ে সেলফের ভেতরের মাকরসার জালগুলো ভেঙ্গে ফেললো। এবার জয়িতা কাগজটার
দিকে হাত বাড়াল। না এটা কাগজ
নয়, একটা ছবি। ধুলো আর
ময়লায় ছবিটির বিষয়বস্তু বোঝার উপায় নেই। জয়িতা তার
ঊড়নার এক অংশ দিয়ে
লেমেনেটিং করা ছবিটি মুছলো।
জানালার
কাছে ছবিটি মেলে ধরতেই জয়িতা
অবাক। এটি তার বাবার
ছবি। ঘোড়ায় চড়া সাদা পাঞ্চাবী পরা লোকটি তার বাবা। অনেকদিন
আগেকার ছবি কিন্তু জয়িতা
তার বাবাকে স্পষ্ট চিনতে পারছে। জয়িতার হাতপা যেন
অবশ হয়ে যাচ্ছে। সে
কিছুই আর ভাবতে পারছে না। কি করে
তার বাবার ছবি সুদ্ধির ঘরে
এলো? এদিকে রিপা জয়িতাকে ডেকে চলছে
বাইরে যাওয়ার জন্য। রিপার ডাক যেন জয়িতার
কানে পৌঁছাচ্ছে না। জয়িতার মাথা
ঘুরতে লাগলো। চারদিক কেমন যেন অন্ধকার
লাগছে তার। সে কি
এখন পড়ে যাবে? জয়িতা বাম হাতে ছবিটি
রেখে ডান হাতটি অন্যমনস্কোভাবে আবার সেলফের ভেতর ডুকালো। সেখানে
আরো একটি ছবি পেল
সে তবে এই ছবিটি
লেমেনেটিং করা নয়। ছবিটির উপরের
অংশ অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
তবে বোঝা যাচ্ছে দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে আর একজন চেয়ারে
বসা এবং তার কোলে
একটি ছোট বাচ্চা। পোষাক দেখে বোঝা যাচ্ছে
ছবিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ দুজনের একজন নারী অন্যজন পুরুষ।
এদের বুকের কাছ থেকে মাথা
পর্যন্ত পুরোটাই প্রায় নষ্ট। মুখগুলো বোঝা যাচ্ছে না। তবে চেয়ারে
বসা মহিলার মুখটা বোঝা যায় খুব
সুন্দরী একজন মহিলা। মহিলার কোলে একটা বাচ্চা। এই
বাচ্চাটিও জয়িতার পরিচিত। এই বয়সী এই
চেহারার বেশ কয়েকটি ছবি তাদের বাড়ীর
দেয়ালে বাঁধানো আছে। আরো কিছু ছবি
আছে তাদের এ্যালবামে। এটি তার ছোট
বেলার ছবি। সে স্পষ্ট
চিনতে পারছে কিন্তু যে মহিলার কোলে বাচ্চাটি, সে
মহিলাকে জয়িতা কখনো দেখেছে বলে
মনে পড়ে না।
এই মহিলা কে? হঠাৎ জয়িতার মনে প্রশ্ন এলো, ইনি কি সুদ্ধি? জয়িতার মাথাটা যেন চক্কর দিল। সে আর কিছু ভাবতে পারছে না। একবার তার মনে হলো হয় তো সে স্বপ্ন দেখছে। সারা দিন সুদ্ধির গল্প শোনার জন্যই বোধ হয় এমন হচ্ছে। হয় তো এখন সে ঘুমিয়ে আছে আর ঘুম ভাঙ্গলেই দেখবে সব স্বপ্ন ছিল। নিজের অজান্তেই জয়িতার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো।
‘কি রে জয়িতা থাকবি নাকি সুদ্ধির বাড়ীতে? বের হ শিগগির, সুদ্ধি এলো বলে’
জয়িতা ধরা গলায় বললো, ‘হ্যাঁ আসছি’
জয়িতা এখন কিভাবে বাইরে যাবে? সে যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা। তার মনে হচ্ছে সে যদি তার নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে চিৎকার করে কাঁদতে পারতো?
আবারও রিপা জয়িতাকে তাড়া দিল। জয়িতা তারাতারি করে ছবি দুটো তার ব্যাগে ভরে নিল। ব্যাগে হাত দিতেই হঠাৎ লতাদির জন্য উপহার আনা শাড়িটি জয়িতার চোখে পড়লো। জয়িতা শাড়িটি বের করে সুদ্ধির তেল চিটচিটে বালিশের উপর যত্ন করে রাখলো। যেন সুদ্ধি ঘরে প্রবেশ করলেই তার চোখে পড়ে। চোখ মুছে জয়িতা ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো।
‘কি রে আমি তো ভেবেছি তুই সুদ্ধির ঘরদোর পরিস্কার করতে শুরু করেছিস।
জয়িতা কথা বলতে চাইছে কিন্তু তার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না।
রিপা বললো, ‘কি হলো মুখ ভার করে আছিস যে।‘
‘দূর কি যে বলিস মুখ ভার করবো কেন। বদ্ধ ঘরে অনেকক্ষণ ছিলাম তো তাই এ রকম লাগছে।‘
দুজনেই হাঁটতে লাগলো। রিপা বললো, ‘জয়িতা তুই ঐ ঘরে ছিলি কি ভাবে? ইস…বাইরে থেকেই আমি
কি যে দুর্গন্ধ পাচ্ছিলাম।‘
জয়িতা কথা ঘুরালো, ‘লতাদির বাড়ি কি খুব দূরে?’
‘না না ঐ তো দেখা যাচ্ছে। তোকে দেখে দিদি অনেক খুশি হবে। কত দিন পর দেখা হবে। জানিস বিয়ের সময় দিদি তোর কথা অনেক করে বলছিল।‘
রিপার
দিদি লতা ঢাকায় রিপাদের
হোষ্টেলে থেকেই এবার বিএ পাশ
করেছে। সেই সুবাদে লতাকে জয়িতা দিদি বলে ডাকে।
আর লতাদিও জয়িতাকে রিপার মতোই ছোটবোন হিসেবে
স্নেহ করে। লতাদির স্বামী
শিশিরদাও একই গ্রামের ছেলে।
শিশিরদা ঢাকায় একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে
চাকরি করেন। লতাদি যখন রিপাদের হোষ্টেলে
থাকতো তখন মাঝে মাঝেই দেখা
যেত শিশিরদা আর লতাদি হোষ্টেলের
নীচে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। রিপা দুষ্টামী করে
বলতো, ‘দিদি আজই আমি
জেঠুকে ফোন করে বলবো তুমি
শিশিরদার সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে
প্রেম করছো।‘
লতাদি
রিপাকে আইসক্রিম খাওয়াবে বলে কথা দিতো।
মাঝে মাঝে সত্যি শিশিরদা
সবাইকে আইসক্রিম খাওয়া তো। সেই লতাদি
আজ শিশিরদার বৌ।
লাতাদি ওদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। ওদের আসতে দেরি হয়েছে বলে অভিমানও করল। রিপা দিদির মান ভাঙ্গাতে বললো, ‘আর বলিস না দিদি, জয়িতা আমাদের গ্রামের একজনের প্রেমে পড়ে গেছে। আসার পথে তার ঘর বাড়ী সব কিছু পরিদর্শন করে তারপর এলো। তাই তো তোর এখানে আসতে দেরি হলো।‘
‘জয়িতা সেই ভাগ্যবান পুরুষটি কে?’
জয়িতা ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে পড়লো। নিজেকে সামলিয়ে সে নিয়ে সে বললো, ‘রিপা প্লিজ এসব কথা আর ভাল্লাগছেনা। এখন না হয় আমরা অন্য কথা বলি।‘
‘কি রে হঠাৎ তোর কি হলো?’
‘আমি দিদির সাথে দেখা করবো বলেই তো এখানে এসেছি তাই না। থাক না ওসব অপ্রোয়োজনীয় কথা।‘
‘ওকে সরি সরি। আমি আর কোন কথা বলবো না। এবার তুই দিদির সাথে কথা বল।‘
আগে লতাদিকে দেখলে জয়িতা যেমন উচ্ছসিত হতো আজ তার সে রকম হলো না। জয়িতা বুঝতে পারলো তার এই পরিবর্তন লতাদি রিপা দুজনেই লক্ষ করছে। তাই সহজ হওয়ার জন্য জয়িতা লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো, ‘দিদি আমি খুব দুঃখিত তোমার জন্য কোন গিফট আনিনি বলে। পরে আমি রিপার কাছে তোমার জন্য একটা গিফট পাঠিয়ে দেব। বলতো দিদি তোমার কি পছন্দ?’
‘আমার জন্য কোন গিফট পাঠাতে হবে না। তুমি যে মনে করে আমাকে দেখতে এসেছো তাতেই আমি খুব খুশি হয়েছি। তোমাদের শিশিরদা এতক্ষণ তোমাদের অপেক্ষায় থেকে মাত্র গেল স্নান করতে। এক্ষুই এসে পড়বে।‘
রিপা বললো, 'দিদি শিশিরদা কোথায় স্নান করতে গেছেন? পুকুরে? '
'হ্যাঁ, যাবি তোরা?'
রিপা বললো, 'জয়িতা যাবি পুকুরে স্নান করতে? খুব মজা হবে।'
'না আমি যাব না। তুই যা না।'
'কিরে তুই না বললি গ্রাম দেখবি, পুকুরে স্নান করবি।'
'বলেছিলাম তবে এখন আর ইচ্ছে করছে না।'
শিশিরদা স্নান করে ফিরে এলে ওরা অনেকক্ষণ কথা বললো। তবে কথা রিপা আর শিশিরদাই বলছিল। জয়িতার কোন কিছুই ভাল লাগছিল না। ওদের কথাবার্তায় জয়িতা মনোযোগ দিতে পারলোনা।
শশীপুর গ্রামে প্রায় প্রত্যেক বাড়ীতেই পুকুর আছে। বাড়ী এসে রিপা পুকুরে স্নান করতে নামলো আর জয়িতা পুকুর পাড়ে তাল গাছ তলায় বসে রইলো। জয়িতার মনে হাজার প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, যেমন তার বাবার আর তার ছবি সুদ্ধির ঘরে কেন? এই তিন জনের সম্পর্ক কি? তাহলে তার বাবা সংকর গমেজ কি সুদ্ধির স্বামী ছিলেন?
ঐ যে রিপার বাবা বললেন, সুদ্ধির স্বামীর ঘোড়ায় চড়া ছবি। রিপার বাবা কি এই ছবিটির কথাই বলছিলেন। না ঘোড়ায় চড়া অন্য কারো ছবি আছে যিনি আসলেই সুদ্ধির স্বামী তার বাবা নন। কিন্তু তার ছোট বেলার ছবি এখানে কেন? তবে কি তার বাবা সংকর গমেজ সুদ্ধির স্বামী আর সে সুদ্ধির সেই ছোট্ট মেয়ে? তা কি করে সম্ভব। তার তো মা আছে। তবে সে যাকে মা ডাকে সুমিতা গমেজ কি তার আসল মা নন? জয়িতা খুব কষ্ট হচ্ছিল সে কি সব আজে বাজে কথা ভাবছে।
আবার জয়িতার মনে হল, তাহলে কেন বাবা তাকে শশীপুর আসতে দিতে চাননি? এটাই কি তার কারণ? তার বাবার গোপন এক অতীত আছে যা তিনি জয়িতাকে জানতে দিতে চান না। জয়িতার মা কি এসব কথা জানেন? জয়িতা যদি সুমিতার মেয়ে না হয়ে থাকেন তবে নিশ্চয়ই তিনি জানেন তার স্বামীর অতীতের কথা। অনেক কিছুই যেন মিলে যাচ্ছে আবার অনেক কিছুই যেন মিলছে না। যেমন, সুদ্ধির স্বামীর বাড়ী চট্টগ্রামে কিন্তু জয়িতাদের বাড়ী আদৌ চট্টগ্রামে নয়। জয়িতা ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছে তার বাবা ছোটকাল থেকেই ঢাকায় থাকে। তাদের কোন গ্রামের বাড়ী নেই। তার মায়েরও কোন আত্মীয় স্বজন নেই। আচ্ছা এটাই বা হবে কেন?
মানুষের তো একটা শিকড় থাকে। তার বাবা মায়ের কোন শিকড় নেই। কেন? এর কি কোন কারণ আছে? রিপার বাবা বলছিলেন, সঙ্গিত শিল্পী অমল সাহা সুদ্ধির স্বামীর বন্ধু। অমল আঙ্কেল তো তার বাবারও বন্ধু। তাহলে কি সে যা ভাবছে তাই ঠিক?
জয়িতা নিজেই নিজের মনে বলতে লাগলো তার বাবা তো তাকে শশীপুর আসতে বারণ করেছিলেন। কেন সে বাবার কথা অমান্য করে লুকিয়ে শশীপুর এলো? কি জানতে এসেছিল সে? কোন গোপন বিষয়? হ্যাঁ, গোপন বিষয় তো অবশ্যই, তবে কেন সে এই গোপন বিষয়টিকে মেনে নিতে পারছে না। সে গোপন কিছু একটা জানতে এসেছিল জেনেছে তবে তার কষ্ট হচ্ছে কেন?
সুদ্ধি কি তার মা? এখন যদি সুদ্ধি এখানে এসে পরে তবে সে সুদ্ধিকে কি বলে সম্বোধন করবে? সে কি সুদ্ধিকে মা ডাকতে পারবে? কেন সুদ্ধি বাসষ্ট্যান্ডে তাকে দেখে জড়িয়ে ধরেছিল? জয়িতার স্পষ্ট মনে আছে সুদ্ধি তাকে জড়িয়ে ধরে বারবার বলছিল সে জানতো জয়িতা আসবে। তার মানে কি?
সুদ্ধি কি তাকে চিনতে পেরেছে? জয়িতা আসবে সুদ্ধি কিভাবে জানতো? কে তাকে খবর দিল? একেই কি বলে মায়ের মন? জয়িতা চোখ বন্ধ করে বলতে লাগলো,
'সুদ্ধি আমার মা। সে কাকতালিয়ভাবে জানতে পেরেছিল আজ আমি শশীপুর আসবো। আর আমাকে দেখতে সে বাসষ্ট্যান্ডে গিয়েছিল। অথচ আমি তাকে দেখে ভয় পেয়েছি। কেউ কি মাকে দেখে ভয় পায়?'
'চল জয়িতা আমার স্নান শেষ। তুই তো পানিতে নামলি না। বেশ মজা হতো নামলে।' হঠাৎ রিপার কথায় জয়িতা আঁতকে উঠলো।
No comments