Header Ads

বিদেশি নোট




ঠিক চৌরাস্তার মাঝখানে নোটটা পড়েছিল। ভরদুপুরে লোকজনের এতটা ভিড়বাট্টা না থাকলেও দু’চারজন যে ছিল না তা নয়। তবে সবার নজর এড়িয়ে ঠিক তুলসির চোখে পড়েছিল নোটটি। দুপুরের মৃদু হাওয়ায় নোটটি যেন দুলছিল। এদিক ওদিক তাকিয়ে তুলসি নোটটা উঠিয়ে ব্লাউজের বাম দিকে ঢুকিয়ে ফেলল। নোটটি দেখামাত্র তুলসি আন্দাজ করে ফেলেছিল, এটি সাধারণ কোন দশ-পাঁচ টাকা কিংবা পাঁচশ টাকার নোট নয়। এটি ভিন দেশের নোট কারন নোটটি তার আচেনা। এরকম সাদা নোট এর আগে সে কখনও দেখেনি। তবে নোটটি হাতে নিয়েই তার কেমন যেন ভয়ভয় করতে লাগল। কেউ তো দেখে ফেলেনি? 
তুলসির বয়স পঞ্চান্ন ছুঁইছুঁই। তবে সে বয়সের হিসেব নিকেশ কিছুই জানে না। শুধু জানে গণ্ডগোলের সময় সে ঘরের পিড়া ধরে হাঁটত। সেই অনুযায়ী অনুমান করা যায় তুলসির বয়সটা। গণ্ডগোলের পরপরই নাকি তুলসির বাবা-মা ছোটছোট আরও দুই মেয়ে রেখে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। সেই থেকে তুলসি প্রথমে ভিক্ষা করে পরে মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে ছোট বোনদের অনেক কষ্টে মানুষ করেছে। বোনদের ভাল ঘরে বিয়েও দিয়েছে তবে নিজে আর বিয়ের পিঁড়িতে বসে নি। বোনেরা স্বামীর ঘরে সুখে সংসার করলেও তুলসি এখনও মানুষের বাড়ি কাজ করেই চলে। মাঝে মাঝে যায় বোনদের বাড়ি বেড়াতে। আজও তুলসি যাচ্ছিল ছোট বোনের বাড়ি আর পথের মধ্যে এই ঘটনা। নোটটি পেয়ে তুলসি বোনের বাড়ি যাবে কি-না দোটানায় থাকলেও শেষে বোনের বাড়ির দিকেই রওনা হল। তবে নোটটি কোন দেশের? কত টাকা হবে? নোটটা নিয়ে কার কাছে যাওয়া যায় বিস্তর চিন্তা করতে করতে তুলসির কপালে ভাঁজ পরে গেল। দিদিকে দেখে কিছু একটা যে ঘটেছে তা তুলসির ছোটবোন কমলা অনুমান করে ফেলল। তুলসি কমলাকে নোটটা দেখিয়ে ঘটনা খুলে বলল।

‘দিদি এ যে-সে নোট নয়, এ যে বিদেশি নোট। তা দিদি এটা এখন কি করবে?’
‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না।'
‘আমার শ্বশুর ঘরে আছে উনাকে একবার দেখাবে?’ 
‘কি যে বলিস, উনি যদি টাকাটা আর ফেরত দিতে না চান’ 
‘না না দিদি উনি এ ধরনের মানুষ নন। উনি খুব ভাল মানুষ। উনি তো বিদেশে কাজ করেছেন। নিশ্চয়ই উনি নোটটা দেখে চিনবেন। আমাকে নোটটা দাও। আমি একবার উনাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি।‘ 
‘না থাক আমি বাড়ি গিয়ে কাউকে দেখিয়ে নিব’ 
‘বাড়িতে কাউকে দেখালে সে যদি তোমাকে ঠকায়? তাই বলছি এখানে একবার যাচাই করে যাও এই নোটের দাম কত হবে। বাড়িতে গিয়ে না হয় আবার কাউকে জিজ্ঞেস করলে।‘ 
এই কথাটা তুলসির মনে ধরল। বোনের শ্বশুরকে নোটটা দেখাতেই তিনি উল্টিয়ে পালটিয়ে বললেন, ‘এটির তো অনেক মূল্য। প্রায় দুই লাখ তো হবেই।‘ 
এই কথা শুনে তুলসির বুক ধড়ফড়ানি আরও বেড়ে গেল। যে কোনদিন চোখে পঞ্চাশ হাজার টাকা এক সঙ্গে দেখেনি আজ তার হাতে কি-না দুই লাখ টাকার নোট? ভাবতে ভাবতে তুলসি মাথা ঘুরে পরে গেল। তুলসির বোন তুলসির মাথায় পানি ঢালতে লাগল। অসুস্থতার খবর শুনে পাড়া-পড়শিরা তুলসিকে দেখতে ভীর জমাল। জ্ঞান ফিরে আসতেই তুলসি ব্লাউজের বাদিকে হাত দিয়ে দেখে নোটটা নেই। 
‘কিরে কমলা আমার টাকা কই?’ 
‘দিদি আস্তে বল তোমাকে দেখতে পাশের বাড়ির মানুষ এসেছে।‘ 
‘আসুক তুই আমার টাকা দে’ 
প্রতিবেশিরা তো অবাক! ‘কি রে কমলা তোর দিদি কিসের টাকার কথা বলে? জ্বর কি আরও বাড়ল নাকি রে?’ 
তুলসি যেন আকাশ থেকে পড়ল। ‘কি আমার জ্বর কে বলল? কমলা আমার টাকা দে’ 
উপায় না দেখে দিদির জ্বর বেড়েছে অজুহাতে কমলা পড়শিদের বাড়ি পাঠিয়ে দিল। এদিকে কমলার কথা শুনে তুলসির মেজাজ গেল চড়ে। আমার টাকা হাতিয়ে নিয়ে বলে আমার জ্বর? কমলা বলল, ‘দিদি তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললে, বাড়ি ভরা মানুষ টাকাটা কোথায় পড়ে যায় তাই আমি তুলে রেখেছি।‘ বলেই দিদির হাতে নোটখানা দিয়ে মুখ কালো করে রইল। এমনিতে দিদি এলে কমলা একটু ভাল-মন্দ রান্না করে আজ আর তার কিছুই করল না। তুলসি রাতে কোনরকম একটু খেয়ে নোটটা হাতে নিয়ে সারারাত জেগে কাটিয়ে দিল আর ভাবতে লাগল বাড়ি ফিরে কার সাথে আলোচনা করা যায় নোটটি নিয়ে। 
সূর্য উঠার আগে তুলসি বাড়ির পথ ধরল। রাস্তাঘাটে তেমন মানুষজন নেই তবুও তুলসির কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল। এতোগুলো টাকা! কেউ কি তাকে দেখছে? 
সাত সকালে তুলসি গিয়ে হাজির হল বিমল মাতব্বরের বাড়িতে। বিমল মাতব্বর সবেমাত্র প্রাতঃভ্রমণ শেষ করে বাড়ি ফিরেছেন। তার স্ত্রী তখনও বিছানায়। গত সাতদিন ধরে তুলসি এই বাড়িতে কাজ করছে। তুলসি এমনিতে কাজে আসে সকাল নয়টায়। আজ এত সকালে কেন জিজ্ঞেস করতেই তুলসি বিমল মাতব্বরকে পুরো ঘটনা খুলে বলল। বোনের শ্বশুর নোটটির মূল্য যে দুইলাখ বলেছেন সেটি উল্লেখ করতেও তুলসি ভুলল না। তুলসির কথা শুনে বিমল মাতব্বরের চোখদুটো যেন একটু চকচক করে উঠল। তবে তিনি তেমন উৎসাহ দেখালেন না। বললেন, ’কই দেখি নোটখানা?’ 
তুলসি ব্লাউজের ভেতর থেকে পরম যত্নে নোটখানা বের করে মাতব্বরের হাতে দিল। বিমল মাতব্বর নোটখানা নেড়েচেড়ে বললেন, ‘আসলে ব্যাঙ্কে না দেখালে বলা যাবে না এর সঠিক মূল্য কত। আমি কাল পরশু একবার বাঙ্কে যাব তুই যদি বলিস তো আমি নিয়ে গিয়ে দেখাতে পারি।‘ 
তুলসি তার সব ডর-ভয়-চিন্তা বিমল মাতব্বরের হাতে সমর্পণ করে দুই চোখে দুই লাখ টাকার স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি চলে গেল। মনের আনন্দে সেদিন তুলসি আর কাজে গেল না। পরের দিন সকাল এগারটার দিকে তুলসি বিমল মাতব্বরের বাড়ি গিয়ে হাজির। মাতব্বর বাড়ি ছিলেন না। কোথায় গেছেন জিজ্ঞেস করতেই তার স্ত্রী বললেন, বাজারে গেছেন তবে আজ বিশেষ কাজের জন্য ব্যাঙ্কে যেতে পারবেন না বলেও জানালেন। তুলসি মনে মনে ভাবল নিশ্চয়ই তিনি ব্যাঙ্কে গেছেন, তার স্ত্রী মিথ্যে বলছেন। তুলসি মন খারাপ করে চলে গেল। পরের দিন তুলসি অন্য এক বাড়িতে কাজে গেল। বেলা বারটার দিকে তুলসি আবার বিমল মাতব্বরের বাড়ি এল। বিমল মাতব্বর কোটা দিয়ে গাছের আম পাড়ছিলেন। তুলসিকে দেখে বললেন, ‘তুলসি আজও ব্যাঙ্কে যেতে পারলাম না রে।‘ 
তুলসির বিরক্তির আর সিমা থাকে না। বুকে সাহস নিয়ে বলেই ফেলল, ‘তাহলে টাকাটা আমারে দিয়ে দেন। আমিই দেখব নে।‘ 
মাতব্বররের স্ত্রী বললেন, ‘তুই এটা নিয়ে কই যাবি? মানুষ তো তোকে সন্দেহ করবে। ভাববে তুই এটা চুরি করেছিস।‘
তুলসির মনে আবার ডর ঢুকে যায়। তুলসি মন খারাপ করে চলে যায়। যাবার সময় বিমলের স্ত্রী বলেন, ‘তুই বারে বারে আমাদের বাড়ি আসিস না তো। মানুষ সন্দেহ করবে। টাকাটা ভাঙ্গান হলে আমি তোকে খবর দিব।‘ 
এদিকে তিন চার দিন হয়ে যায় বিমল মাতব্বরের স্ত্রী আর খবর দেন না। রাগে একদিন তুলসি সকালে বিমল মাতব্বরের বাড়ি গিয়ে দেখে ঘরের সদর দরজায় তালা ঝুলছে। তুলসির মাথা গেল চড়ে। তুলসি অনেক সহ্য করেছে আর না। আজ প্রায় আটদিন বিমল মাতব্বর তুলসিকে ঘুরাচ্ছে। এবার তুলসি চিল্লাচাল্লি শুরু করে দিল। এদিকে তুলসির চেঁচামেচিতে আশেপাশের লোকজন ঘুম থেকে উঠে গেল। তারা তুলসির চেঁচামেচির কারন জিজ্ঞেস করলে তুলসি তেমন কিছু না বলে ঘরে তালা ঝোলানোর কারন জিজ্ঞেস করে। জানা গেল বিমল মাতব্বর আসুস্থ ঢাকা গেছেন চিকিৎসা করতে। তুলসি ভাবল নিশ্চয়ই বিমল মাতব্বর তার বিদেশি নোট ভাঙ্গিয়ে ঢাকা চিকিৎসা করতে গেছেন। 
এবার তুলসি গেল তার আরেক বিশ্বস্ত মাসির কাছে। এই মাসির বাড়িতে তুলসি প্রায় পনের বছর কাজ করেছে। মাসি সকালে সবেমাত্র চুলায় চায়ের পানি বসিয়েছেন। তুলসি নোটটি পাওয়া থেকে এর বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জানাল মাসিকে। মাসি আবার তুলসির চেয়ে আরেক কাঠি উপরে। তিনি তুলসিকে আরও উস্কে দিলেন। 
‘বলিস কিরে তুলসি? প্রায় দুই লাখ টাকা? অসুখবিসুখ কিচ্ছু না, ঐ ব্যাটা তোর টাকা মেরে দিয়েছে। এখন ঢাকা গিয়ে অসুখের নাম করে ফুর্তি করছে তোর টাকা দিয়ে।‘ 
 এই কথা শুনে তুলসি কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মত জ্বলে উঠল। 
‘তুই এই মাসিকে রেখে ঐ ব্যাটাকে নোটটা দিতে গেলি? এই মাসি তোকে কত বিপদে-আপদে সাহায্য করেছে। আর তুই টাকার ব্যাপারে আমাকে বিশ্বাস করতে পারলি না?’ 
তুলসি মনে মনে ভাবে সত্যি বড় ভুল হয়ে গেছে। মাসিকেই নোটটা দেওয়া দরকার ছিল। মাসি তুলসিকে বুদ্ধি দিল। ‘শুন তুলসি তুই খবর নে কবে বিমল মাতব্বর বাড়ি ফিরবে। নোটটা তুই আমার কাছে নিয়ে আয়। আমি তোকে যখনতখন ভাঙ্গিয়ে দিব। একটা নোট ভাঙ্গাতে এত সময় লাগে? নিশ্চয়ই ব্যাটার মনে কুমতলব আছে।‘ 
ব্যাটার মনে যে কুমতলব আছে এ ব্যাপারে তুলসির মনের ধারনা আরও পাকাপোক্ত হল। এরপর মাসির সাথে মিলে তুলসি বিমল মাতব্বরের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে মাসির হাতের বানান এক পেয়ালা চা খেয়ে তুলসি বাড়ির পথে রওনা হল। এই টাকার ব্যাপারে কাউকে কিছু না বলতে মাসি তুলসিকে কঠিনভাবে সতর্ক করে দিলেন। তুলসি মাসির বাড়ি থেকে বের হতেই মাসির ছেলে সিঙ্গাপুর থেকে ফোন করল। মাসি তার ছেলেকে তুলসির ঘটনা পাই-টু-পাই বলে আরও কিছুটা বাড়িয়ে বললেন। মাসির ছেলে রবিন ঘটনা শুনামাত্র ফোন করল গ্রামে থাকা তার এক বন্ধু সুজনকে। সুজন তখন তার আরেক বন্ধুকে সাথে নিয়ে পুকুরে মাছ ধরছিল। ফোনে রবিন তার মায়ের কাছে শুনা ঘটনার বিস্তারিত বলে আরও কিছুটা যোগ করল। দুই বন্ধুর কথা শেষ হতে না হতেই দেখা গেল পুকুরের পাড় দিয়ে তুলসি বাড়ি ফিরছে। সুজন আর তার বন্ধু গিয়ে ধরল তুলসিকে।
‘কিরে তুলসি কোন সাহায্য লাগবে?’ 
তুলসির বুকটা ধক করে উঠল, ‘কিসের সাহায্য?’
‘বিমইল্যা মাতব্বর নাকি তোর দুই লাখ টাকার ডলার মেরে দিছে?’ 
‘তোমাগো কে কইল?’ 
‘সব খবর আমাগো কাছে আছে। শুন আমরা তোর টাকা আইনা দিব। তুই অর্ধেক টাকা আমাগো দিবি। কি রাজি?’ 
‘না না আমি কোন টাকা-পায়সা পাই নাই।‘
‘মিছা কথা কবি না। আমরা সব জানি। ঐ বিমইল্যা তোর টাকা আর ফিরত দিব না। টাকা যদি পাইতে চাস তো আমরাই আইনা দিব। তবে অর্ধেক আমাগো দিতে হইব। আর শুন বিমইল্যা করে গ্রামে ফিরব রে?’ 
‘আমি জানি না।‘ 
‘ঠিক আছে তুই যা। কোন চিন্তা করিস না।‘
তুলসির চিন্তা আর উৎকণ্ঠা আরও কয়েকগুন বেড়ে যায়। কি সমস্যা এরা জানল কিভাবে? সে তো মাত্র মাসিকে বলে এল। আর এরা ছিল পুকুরপাড়ে। খবরটা তো এত তাড়াতাড়ি আসার কথা না। নাকি মাসিকে বলার সময় কেউ আড়াল থেকে শুনে ফেলেছিল। কি জানি? এই বিদেশি নোটটা পাওয়ার পর থেকে তুলসি এক দিনের জন্যও শান্তি পেল না। একটা না একটা সমস্যা লেগেই আছে। না পাচ্ছে টাকাটা হাতে, না সমস্যার সমাধান হচ্ছে। তুলসি ভেবে রেখেছিল সে দুইটা রিক্সা কিনে ভাড়া দিবে। এক লাখ টাকা দিয়ে একটা জমি কিনবে আর বাকি টাকা সুদে খাটাবে। এখন কি হল! এদের নাকি অর্ধেক টাকা দিতে হবে। 
তুলসির সাথে সাথে গ্রামের আরও দুই ছেলে বিমল মাতব্বরের বাড়ি ফেরার পথ চেয়ে থাকে। অবশ্য পরের দিনই বিমল মাতব্বর ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরলেন। বিমল মাতব্বর বাড়ি ফিরে কাপড় ছাড়তেও সময় পেলেন না। দুই ছেলে এসে হাজির। 
‘কি ব্যাপার?’ 
‘তুলসি আমাদের পাঠিয়েছে ‘
‘কেন?’ 
আপনি নাকি তুলসির দুই লাখ টাকা মেরে দিছেন’ 
বিমল মাতব্বর উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘মানে?’ 
'তুলসি নাকি আপনাকে দুই লাখ টাকার ডলার ভাঙ্গাতে দিয়েছে আর আপনি নাকি তাকে ঘুরাচ্ছেন?’ বিমল মাতব্বর প্রেসারের রোগী ডাক্তার দেখিয়ে মাত্র ফিরেছেন। ছেলেদের কথা শুনে তিনি রেগে আগুন হয়ে গেলেন। বিমল মাতব্বরের স্ত্রী স্বামীকে শান্ত করে ছেলেদের বললেন, ‘যার টাকা আমরা তাকেই দিব তোমরা এখন যাও।‘ 
বিমল মাতব্বরের শারীরিক অবস্থা বেগতিক দেখে ছেলেরা কেটে পড়ল। 
সেইদিন বিকেলে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারের বাড়িতে তুলসির ডাক পড়ল । তুলসির বিরুদ্ধে অভিযোগ সে বিমল মাতব্বরের বাড়িতে গুন্ডা পাঠিয়েছে টাকা উদ্ধারের জন্য। অসুস্থতার জন্য বিমল মাতব্বর তুলসির কাজটা করে দিতে পারেন নি কিন্তু তুলসি নিজে না এসে গুন্ডা পাঠিয়েছে। তাই বিমল মাতব্বর তুলসির বিরুদ্ধে মামলা করবে। এই কথা শুনে তুলসির তো আরও একবার হার্ট অ্যাটাক করার অবস্থা। তবুও তুলসি মেম্বারকে পুরো ঘটনা খুলে বলল। মেম্বার তুলসিকে বিমল মাতব্বরের বাড়ি গিয়ে বিষয়টা মিটমাট করে আসার পরামর্শ দিলেন। 
তুলসি গেল বিমল মাতব্বরের বাড়িতে। বিমল মাতব্বরের বউ তুলসির চৌদ্দ গুষ্টি ধুয়ে দিয়ে নোটটা ফিরিয়ে দিলেন এবং জানিয়ে দিলেন তারা প্রতারক বা চোর নন। 
সুকান্ত মাস্টার সবে মাত্র স্কুল থেকে ফিরেছেন। তখনও ভাত খাওয়া হয়নি। ঠিক সেই সময় তুলসি এসে কেঁদেকেটে তার পুরো গল্প শুনাল। সে এখন আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই শেষমেশ এসেছে মাষ্টারের কাছে। মাষ্টার সব শুনে বললেন, 
‘নোটটা নিয়ে তো দেখছি অনেক ঝামেলা। শেষে আমি তো আবার কোন ঝামেলায় পরবো না?’ 
‘না না স্যার আপনিই এই নোটটা ভাঙ্গিয়ে দেন। ‘ 
‘দেখি কোন দেশের নোট?’ 
তুলসি আবার তার ব্লাউসের ভেতর থেকে সযতনে নোটটি বের করে সুকান্ত মাষ্টারের হাতে দেয়। মাষ্টার নোটটি হাতে নিয়ে দেখে পাঁচ হাজারের একটা নোট। লেখা আছে ‘ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড’। তিনি তো অবাক! পাঁচ হাজার পাউন্ড! সুকান্ত মাষ্টার তুলসিকে বললেন, ‘আমি কাল স্কুলের কাজে ব্যাঙ্কে যাবো। তুমি যদি চাও তো আমি জিজ্ঞেস করে দেখতে পারি। তাহলে তুমি নোটটা এখন বাড়ি নিয়ে যাও কাল আমি সকাল নয়টায় ব্যাঙ্ককে যাব।'
তুলসি নোটটি আর বাড়ি নিল না। মাষ্টারের কাছে রেখেই চলে গেল। তুলসি মাষ্টারের বাড়ি থেকে বের হতেই মাসি এসে উপস্থিত। আর এই মাসি ছিল মাষ্টারের মায়ের আপন বোন। মাসি এসেই মাষ্টারকে বললেন, ‘তুলসিকে দেখলাম তোদের বাড়ি থেকে যেতে।‘ 
‘হা এসেছিল একটা কাজে’ 
‘নিশ্চয়ই ঐ বিদেশি নোটের ব্যাপারে? দেখেছিস ঐ বিমল মাতব্বর গরিব মানুষটার টাকা মেরে দিতে চেয়েছিল। যাই হোক এখন তোর হাতে যখন আছে তাহলে আর কোন চিন্তা নেই। আচ্ছা কোন দেশের নোট একটু দেখি তো?’ 
সুকান্ত মাষ্টার তার মাসিকে নোটখানা দেখালেন। দেখে মাসির চোখ তো ছানাবড়া । ‘হায় হায় পাঁচ হাজার টাকা? আচ্ছা বাংলাদেশের কত টাকা হবে রে?‘ 
‘কি জানি পাউন্ড এখন কত করে কে জানে?’ 
মাসির ছেলে সিঙ্গাপুর থাকে তাই এসব ডলার বা বিদেশি টাকা সম্পর্কে মাসির কিছুটা জ্ঞান আছে। মাসি সুকান্ত মাষ্টারের টেবিলে রাখা ক্যালকুলেটর নিয়ে হিসেব করে ফেলল, যদি এক পাউন্ড ৮৬ টাকা হয় তবে ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। মাসি মাষ্টারের দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘তুলসি তো জানে যে এতে প্রায় দুই লাখ টাকা হবে। শুন বাকি টাকা আমরা দুই জনে ভাগ করে নেই। ‘ 
‘ছি ছি কি সব বলছ মাসি। গরিব মানুষের টাকা। না না এটা ঠিক না।‘ 
‘কেন ঠিক না? এটা তো আর ওর নিজের টাকা না। আমরা ভাঙ্গিয়ে দিচ্ছি তাই এখান থেকে আমরা কিছু নিলে কোন সমসসা নেই।‘
সুকান্ত মাষ্টার কি যেন ভাবেন। হয় তো তার মনেও লোভ উঁকি দেয়। বলেন, ‘ব্যাঙ্ককে গিয়ে দেখি কি হয়।‘ 
'শোন তুই তুলসিকে বলবি দুই লাখ টাকা পেয়েছিস। দুই লাখ টাকা ওকে দিয়ে এক লাখ পনের হাজার টাকা তুই নিবি আর বাকি এক লাখ পনের হাজার টাকা আমাকে দিবি।‘ 
মাসি বাড়ি গেলে মাষ্টার নিজেও এক লাখ পনের হাজার টাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। পরের দিন সুকান্ত মাস্টার নোটটা নিয়ে ব্যাঙ্কে গেলেন। স্কুলের কিছু কাজ ছিল সেরে পরিচিত ব্যাঙ্ক ম্যানেজারকে নোটখানা দেখালেন। ম্যানেজার নোটখানা নেড়েচেড়ে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় পেয়েছেন নোটটি?’ 
‘আমাদের ওখানকার গরিব এক মহিলা পেয়েছেন। লেখাপড়া জানে না তাই আমাকে দিয়েছেন। ‘ ম্যানেজার বললেন, ‘এই নোটটি ১৯৪৭ সালে ইংল্যান্ডে ব্যান্ড করা হয়েছে। এটি একটি আচল নোট।‘ 

 সুকান্ত মাষ্টার বিষণ্ণ মনে বাড়ি ফিরে দেখে তুলসি আর মাসি তার জন্য অপেক্ষা করছে। নোটটি তিনি তুলসিকে দিয়ে ম্যানেজারের কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করলেন। মাসি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উদাস মনে বাড়ি চলে গেলেন। আর তুলসি? তুলসির মাথা অনেকটাই অগোছালো হয়ে গেছে। নোটটা নাকি এখনও তার ব্লাউসের ভেতরে বামপাশেই থাকে।


আরও পড়তে ক্লিক করুন




No comments

Theme images by Deejpilot. Powered by Blogger.